somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুশদেশের সত্যিকথা ৬

১৮ ই জুন, ২০০৭ বিকাল ৩:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গুপ্তহত্যা নিয়েই যখন কথা হচ্ছিল তখন কিছুটা আগে চলে যাওয়া যেতে পারে । জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মত তাঁর পুত্র জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে ১৮৮৭ সালে উড়িয়ে দেবার পাঁয়তারা করেছিল নিহিলিস্ট (নৈরাজ্যবাদী) সংস্থা 'নারোদনায়া ভলিয়া' ।

'নারোদনায়া ভলিয়া' কথাটার তর্জমা হতে পারে 'জনগনের ইচ্ছা বা মুক্তি' । আসলে জনগনের সাথে এর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না । খুব বেশি হলে হাজার দুয়েক সমর্থক এবং কয়েকশো সংগঠক ছিল এতে । বস্তুত এটি ছিল কতিপয় সমাজবিচ্ছিন্ন, ছাত্র ও (অতি) বুদ্ধিজীবির সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সংস্থা । ডারউইন-মিলস-মার্ক্সের সব কেতাব পড়ে, অনেক ভেবে, মাথা চুলকে তাঁরা এই 'বৈজ্ঞানিক' (?) সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র যাই বলি না কেন জিনিসগুলো কতিপয় কতিপয় লোকের খেলার পুতুল ও লুন্ঠনের ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে ।

সমাজকে পাল্টাতে হলে তাই প্রথমে সমাজের মাথাগুলোকে খতম করে দিতে হবে । আজকের দিনে হয়তো এদেকে বলা যেতো সেক্যুলার মৌলবাদী । জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে মেরে (১৮৮১) এই দেশপ্রেমিকরা খুব ফুর্তিতে ছিলেন । পালের গোদাটা গেছে! বাকিগুলোও যাবে!

তবে একটা বড় ভুল হয়েছিল তাঁদের । সম্রাটদের মধ্যে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার মন্দের ভাল ছিলেন । তিনি সত্যিই যথেষ্ট লেখাপড়া জানা উদারপন্থী ও সংস্কারকামী ছিলেন (কতটুকু সফল হয়েছিলেন বা হতে পারতেন তা তর্কের বিষয়ে ) । তাঁর পুত্রটি তাঁর থেকে বহুগুনে প্রতিক্রিয়াশীল (এবং মাথামোটা) ছিলেন এবং তিনি বাবার সমস্ত উদারপন্থী সংস্কার একের পর এক উল্টে দিতে থাকেন । 'জনগনের ইচ্ছার' ইজারাদাররা জার তৃতী আলেকজান্ডারকেও বোম মেরে বৈতরণী পার করে দেবার পাঁয়তারা আঁটলো । কিন্তু সম্রাট তাঁর বাবার চেয়ে অনেক সেয়ানা ছিলেন ।

পরিকল্পনা আঁটা হলো সেইন্টপিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসবেন সম্রাট । ভারী ভারী কিছু বইয়ের ভিতর কাগজ ছিঁড়ে সেখানে বোমা নিয়ে ঢুকবে তারা (অনেকটা টিনটিনের ক্যাপ্টেন হ্যাডক যেভাবে চাঁদে হুইস্কি নিয়ে গেছিলেন সে ভাবে!) । কিন্তু টিকটিকি ছিল দলের ভিতর । গুপ্তপুলিশ তখন খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছিল রাশিয়াতে । ১৮৮৭ সালের ১ লা মার্চ প্রায় দশ বারোজন কে আটক করা হলো । দেশদ্রোহের কেস, দ্রুত বিচার এবং ফাঁসির রায় । পাখোমি আন্দ্রেউশকিন, ভাসিলি ওসিপানভ, ভাসিলি গেনেরালভ, পিওতর শেভিরেভের সাথে আলেক্সান্দার উলিয়ানভ নামে সেইন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন একুশ বছর বয়সী ছাত্রের ফাঁসি কার্যক করা হলো মে'র ৮ তারিখে, শ্লিসেলবুর্গ দুর্গে ।

শেষ নামটি খুব গুরুত্বপুর্ণ, আলেক্সান্দার, জার আলেক্সান্দারকে মারতে এসে ফাঁসিতে ঝুলেছে ছাত্র আলেক্সান্দার (সম্রাটকে আমরা 'আলেকজান্ডার' বলছি ইংরেজ রীতিতে) । তার বাড়ি সিমবির্স্ক শহরে । সেখানে তার একটা ভাই ছিল, নাম ভ্লাদিমির, ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ । বয়সকালে সে সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হবে । সেখানে লেনা নামে একটা নদীর প্রেমে পড়বে সে এবং ছদ্মনাম নেবে 'লেনিন' । সে ব্যাপারে আমরা পরে জানতে পারব ।

ভ্লাদিমির এবং আলেক্সান্দারের বাবা ছিলেন সেযুগের খুবই সফল ও প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক ইলিয়া নিকোলায়ভিচ উলিয়ানভ । জীবনের শেষ বারো বছর সিমবির্স্ক জেলার স্কুল পরিদর্শক ছিলেন তিনি । ১৮৩১ সালে জন্ম, ১৮৫৪ সালে কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন বিজ্ঞানে ।

আবহাওয়া বিজ্ঞানের উপর তাঁর দুটো বই আছে । প্রাথমিক শিক্ষার উপর তিনি অনেক গবেষনা করেছেন । খুব সামান্য অবস্থাতে জীবন শুরু করলেও মৃত্যুর সময়ে (১৮৮৬, ছেলের ফাঁসি দেখতে হয়নি একবছরের জন্য) তিনি শহরের গন্য-মান্য-প্রতিষ্ঠিতদের একজন ছিলেন । আলেক্সান্দার ব্লাংক নামে নামে এক ডাক্তারের মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন সেটাও প্রতিষ্ঠার একটা কারন ।

সিমবির্স্ক শহরটা আরো এক কারনে গুরুত্বপু্র্ণ । ফিওদর কেরেনস্কি নামে সেখানে আরেক স্কুল শিক্ষক থাকতেন, যাঁরও আলেক্সান্দার নামে একটি পুত্র ছিল--আলেক্সান্দার কেরেনস্কি । রাশিয়ার ইতিহাসে তিনিও নাম লেখাবেন ভ্লাদিমিরের উলিয়ানভের পাশাপাশি । তবে সে মুলতঃ ব্যার্থতার ইতিহাস ।

সে যাই হোক নিকোলাস যখন জাপান সফর থেকে ভ্লাদিভস্তকে এলেন তখন ভ্লাদিভস্তক ছিল (এবং এখনো) দূরপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে গুরত্বপুর্ণ বন্দর । পূবে যেভাবে রাশিয়া ভুখন্ড দখল করে চলেছিল (মুলতঃ চীনের) তাতে আশা (?) করা গিয়েছিল যে সারা বছর বরফমুক্ত কয়েকটা বন্দর তারা কব্জা করতে পারবে । অন্তত কোরিয়ান উপদ্বীপটা যে তারা কব্জা করতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না রুশদের মনে ।

সবচেয়ে উদার পন্থী রুশরাও এই সাম্রাজ্য বিস্তারে তেমন খারাপ কিছু দেখতে পেতেন না । রাশিয়া 'সভ্যতার' বিস্তার ঘটাচ্ছে এশিয়াতে । এতে কার কী বলার আছে? আর ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজরা যেভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা করছিল দুনিয়াটাকে সেখানে রুশ উচ্চাভিলাষ খুব একটা বিসদৃশ ঠেকবে না ঊনিশ শতকের পর্যবেক্ষকের কাছে । বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!

চীন ছিল পশ্চাদপদ মাঞ্চু সম্রাটদের লুন্ঠনভুমি । মাঞ্চুরা নিজেরাও খাস চীনা (হান চীনা) ছিলেন না, তারা ছিলেন মাঞ্চুরিয়া থেকে আগত মোঙ্গল, সতেরোশো শতকে মিং রাজবংশকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন । তাঁরা সাধারন লোকদের সেটা মনে করিয়ে দেবার জন্য নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে চুল বেণী করার নির্দেশ দেন! এমন দেশে মানুষ শাসককে ভাল বাসবে কেন?

তবে ভারতের মতো বিদেশীরা একেবারে সার্বভৌম ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করেনি, দেশে নামকা ওয়াস্তে সম্রাট ছিলেন । আর ছিলেন প্রায় স্বাধীন ও সর্বদা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত সামন্ত বর্গ । দেশের বেশ একটা বড় সংখ্যক লোক আফিমে বুঁদ হয়ে থাকত ।

ওদিকে ইংরেজরা ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল হংকংএ । শাংহাইতে সমস্ত বিদেশী শক্তিরই (গ্রেট পাওয়ার্স!) ঘাঁটি ছিল রুশ-ফরাসী-আমেরিকান-ইংরেজ এবং হালে জাপানী । সেখানে শহরের একটা বড় এলাকা (কনসেশন জোন) পুরো বিদেশীদের ছিল এবং সেখানে সন্ধ্যার পরে কোনো চীনা দেখা গেলে (ভৃত্য-পতিতা বা ইত্যকার 'প্রয়োজনীয় জনতা' বাদে) সটান তাকে ফাটকে পাঠিয়ে দেবার সুবন্দোবস্ত ছিল । (আইনশৃঙ্খলা রক্ষার এই মহান কর্মে বিশেষত ভারতীয় শিখ-ভোজপুরি সিপাইরা নিয়োজিত ছিল) ।

চীনা মালি চর্চিত পার্কগুলোর ফটকে লেখা ছিল সেই বিখ্যাত সুমধুর বাণী "অনলি ডগস অ্যান্ড চাইনিজ আর ফরবিডেন (কেবল কুকুর আর চীনাদের প্রবেশ নিষেধ) ।" সাইনবোর্ডের বাণীটি আফ্রিকাতেও রফতানী হবে ।

১৮৯১ সালে, সাত সাগর তেরো নদীর পারে লন্ডন মহানগরীতে একজন অল্পবয়্সী ছাত্র ডাক্তার স্বপ্ন দেখছেন দেশে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গনতন্ত্র আনবেন, বিদেশীদের উৎপাত বন্ধ করবেন । তরুনটির নাম ডক্টর সান ইয়াৎ সেন । তবে তাঁকে আরো একুশ বছর অপেক্ষা করতে হবে । বিদেশীরা যাবে আরো চল্লিশ বছর পর ।

সে যাই হোক আমরা তো রাশিয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম, চীন নিয়ে নয় । তবে রুশ ভানতে কেন এই চীনের গীত? এসব কিছুই সে যুগের বাস্তবতা । রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তারেই তার শাসকদের ধ্বংস, কথাটা অদ্ভুত মনে হলেও কথাটা অনেকাংশে সত্য । নিউটনের তৃতীয় সুত্র ।

পশ্চিমে যেহেতু সাম্রাজ্য কঠিন বা প্রায় অসম্ভব তাই পুবে তাকাও । আর পুবের সম্প্রসারণ করতে হলে চাই উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা । নদী পথে সম্ভব নয় । সাগরে যেতে হলে গোটা দুনিয়া ঘুরে যেতে হবে । তাহলে রেল লাইন পাতা হয় । নিকোলাস যখন ভ্লাদিভস্তকে এসে পৌঁছেছেন তখন ট্র্যান্স সাইবেরিয়ান রেল লাইনের একটা গুরুত্বপুর্ন উদ্বোধন অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেখানে ।


সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০০৭ রাত ১০:০৫
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×