চীনে তখন মাঞ্চু সম্রাটরা রাজত্ব করছেন । তাঁদের মধ্যযুগীয়, ঐতিহ্যবাহী শাসন-ব্যাবস্থা সাম্বরাজ্য লোলুপ, প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ইউরোপিয়ানদের থাবাতে ক্রমেই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল । ফরাসী ওলন্দাজ-পর্তুগিজ-রুশ এদের সাথে এই সাম্রাজ্য বিস্তারের মৃগয়াতে ইদানীং যোগ দিয়েছিল আমেরিকা আর জাপান । বিশেষ করে উদীয়মান সুর্যের দেশের সাথে রুশ সাম্রাজ্যের বিরোধ বাধাটা ছিল একেবারে অবধারিত ।
অণ্যান্য ঔপনোবেশিক শক্তি মুলতঃ বন্দর দখল করেই সন্তুষ্ট ছিল । কারন পশ্চিম-ইউরোপীয় সাম্রাজ্য প্রায় সর্বদাই বানিজ্য নির্ভর । 'সুবাসিত বন্দর' হং কং সেই ১৮৪২ সালেই ব্রিটিশ তার যুদ্ধ-জাহাজের কামানের মুখে চুক্তি করে নিজেদের বলে লিখিয়ে নিয়েছে । ম্যাকাউ অবশ্য আনেক কাল হয় পর্তুগিজদের হাতে । আনাম (ভিয়েতনাম) কব্জা করেছে ফরাসীরা । শাংহাই, নানকিং, আময় সবখানেই বহিরাগত শক্তি নিজেদের 'প্রভাবিত অঞ্চল' গঠন করে ছেড়েছে । তবে একেবারে গোড়া থেকেই জাপানীদের আগ্রাসনটা একটু অন্যরকম ছিল । এবং তাতে রুশদের টক্কর লাগাটা যাকে বলে খুব স্বাভাবিক পরিনতি ।
১৮৬৮ সালের ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে পনেরো বছর বয়স্ক প্রিন্স মুৎসোহিতো তাঁর বাবা সম্রাট কোমেইর স্থলে সিংআসনে বসে নতুন 'মেইজি' বা আলোকিত নতুন যুগের কথা ঘোষনা করলেন । এই 'মেইজি ডিক্লারেশানের' উপর আধুনিক জাপানের ভিত দাঁড়িয়ে আছে বললে খুব একটা ভুল হবে না । আর এই মেইজি ঘোষনার সাথে সাথেই দুইশো পয়ঁষট্টি বছর ধরে কায়েম তোকুগাওয়া শোগুন তন্ত্রের বিলোপ ঘটলো ও সম্রাট আবার তাঁর হারানো কর্তৃত্ব ফিরে পেলেন । তাই একে 'মেইজি রেস্টোরেশন' ও বলা হয় ।
শোগুনরা ছিলেন সেনাপতি ও শক্তিশালী সামন্ত শাসক । শোগুনতন্ত্রকের ইংরেজিতে বলা হতো 'শোগুনেট' আর জাপানীতে 'বাকুফু' । বাকুফু কথাটার অর্থ দাঁড়ায় 'তাঁবুর মধ্যে দফতর' । তাঁবু স্বাভাবিক ভাবেই মহড়ায় থাকা সেনাপতির দফতর । আর তাঁবু দিয়ে এরকম একটা রুপকও বলা যেতে পারে চালু ছিল যে শোগুনদের শাসন আসলে অস্থায়ী ।
প্রাচীনকালে, বলা যেতে পারে দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই সম্রাটরা তাঁদের বিশ্স্ত অনুসারীদের এই সন্মানসুক উপাধী দিয়ে এসেছেন । কিন্তু ষোলোশো সালের দিকে তোকুগাওয়া লেয়াসু নিজেই ক্ষমতা দখল করে শোগুন উপাধী নিয়ে দেশের কার্যকর ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন । তাঁর ঘাঁটি ছিল 'এদো' (আজকের টোকিও), ক্ষমতাহীণ সম্রাটরা থাকতেন প্রাচীন ও পবিত্র নগরী কিয়োতোতে । ১৬০০-১৮৬৮ এই সময়টাকে তাই 'এদো পিরিয়ড' ও বলা হয়ে থাকে ।
মুৎসোহিতো এই নতুন যুগের স্বর্নালী আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখতে নিজেই সম্রাট 'মেইজি' নাম নিয়ে নিলেন । সম্রাট মেইজি, কিয়োতো থেকে টোকিওতে রাজধানী সরিয়ে আনলেন । ঊনিশশো বারো সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ পয়ঁতাল্লিশ বছর রাজত্ব করবেন মেইজি । এবং এ সময়ের মধ্যেই একটি পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র থেকে আধুনিক বিশ্ব-শক্তিতে পরিনত হবে মেইজি-শাসিত জাপান ।
সে যাই হোক ১৮৭০ এর দশকে জাপান দ্রুত শিল্পায়ন ও আধনিকায়নের দিকে অগ্রসর হলো । ঐতিহ্যবাহী সামুরাই প্রথা (অনেকটা ভারতীয় ক্ষত্রিয়ের মতো) বিলোপ করে জাপান আধুনিক ও শক্তিশালী নৌ ও সেনা বাহিনী গঠনের দিকে নজর দিল । সে যুগের সেরা নৌ বাহিনী ছিল ব্রিটিশদের রয়্যাল নেভি আর শৃঙ্খলা ও কারিগরি দিক থেকে শ্রেষ্ঠ স্থল বাহিনী হিসেবে ধরা হতো প্রাশিয়ান তথা জার্মান সেনাবাহিনীকে । উদীয়মান জাপানী নৌ ও সেনা ক্যাডেটদের অনেককেই এই দুই দেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হলো ।
প্রচুর বিদেশী সামরিক প্রশিক্ষককেও মোটা টাকা দিয়ে আনা হলো জাপানীদের রণকৌশল আর ফৌজি কেতা কায়দা শেখানোর জন্য । আঠারোশো একাত্তর সালে ব্রিটেনে যেসব নৌ ক্যাডেটদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হেইহাচিরো তোগো (নামটা অনেক সময়ে 'তোগো হেইহাচিরো' এভাবেও লেখা হয় । 'তোগো' পারিবারিক পদবী), পরবর্তীকালে তিনি জাপানী নৌবাহিনীর প্রধানে পদ অলংকৃত করবেন । ১৮৭১ সাল থেকে সাতাত্তর সাল পর্যন্ত বিলাতে ছিলেন তোগো ।
*ছবি-সম্রাট মেইজি
গ্রুপছবি, ১৮৬৯ সালে যুদ্ধ-জাহাজ কাসুগাতে হেইহাচিরো তোগো (পিছনে, শাদা কিমোনো পরিহিত)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৭ সকাল ৮:৪৭