হঠাৎ সেদিন ফোন করে অনেক আলাপ করলো এবং এক পর্যায়ে বল, 'কোথাও কোন চাকরি থাকলে জানাবেন তো। আমার এই চাকরি ভালো লাগছেনা। বড় বেশি বাইরে ট্যুর করতে হয়।' আমিও বল্লাম 'আচ্ছা দেখি।' তখন কি আর জানি, যে তার চাকরি নেই, ছেলে মেয়ে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছে? এই ঢাকা শহর তার করাল চেহারা নিয়ে এখন ওই বেচারার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?
কিছু লোকের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি যাদের চাকরি দেবার সুযোগ থাকতেও পারে। কিন্তু এই বাজারে নিজের চাকরিটা রাখতেই রাতদিন হিমসিম খাই - কিভাবে ওকে সত্যিসত্যি একটা চাকরি খুঁজে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করব, ভেবে বের করতে পারিনা।
কত অভিযোগ করি সবার কাছে - চাকরি করতে ভালো লাগেনা, এত খাটনি, এত স্ট্রেস, জীবনে শান্তি পেলাম না, ইত্যাদি।
ঐ টেলিফোনটা পাওয়ার পর ঝিম মেরে রইলাম। চাকরি চলে গেলে আমিও যে মানুষ থেকে না-মানুষে পরিণত হতে পারি এটা বুঝে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। কেমন অবস্থা হয় ওই সংসারগুলোতে যখন বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না - মায়ের কাছে এর কারণ জানতে চায়। মা সকালে উঠে মন খারাপ করে থাকেন বাচ্চাদের কি খেতে দেবেন ভেবে না পেয়ে। আর বাবাটির যে কি হয় - হয়তো ভোরে বেরিয়ে যান, বাড়িওয়ালাকে এড়াতে, অথবা হ্য়ত বাচ্চাদেরই এড়াতে!
উন্নতদেশগুলোতে অন্ততঃ খাওয়া-থাকাটুকু সরকার দেখেন। বাংলাদেশে আমাদের মত এই হতভাগা চাকরীজীবিগুলোর কেউ নেই। আত্মীয়দের কাছে হাত পাতা বা বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়া (ফেরত দেয়ার উপায় নেই), মনে মনে ছোট হতে হতে মরে যাওয়া, মানুষ থেকে ধীরে ধীরে না-মানুষ কিংবা জন্তুতে পরিণত হওয়া - এই গভীরতর ভয়ই কি মাঝরাতে আমাদেরকে ঘুম থেকে ঠেলে তোলে? পেটের ভেতর তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে থাকে? বাচ্চাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাই। হে আল্লাহ্ব, রক্ষা করুন।
চাকরীই তাহলে আমাদের মানুষ-জীবন যাপনের নিয়ামক! চাকরী থাকলে আমরা সিনেমা বা নাটক দেখি, সুনীলের বই পড়ি, বাচ্চারা গান বা ছবি আঁকা শেখে। কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবি। একদিন বাচ্চারা কেএফসি বা পিজাহাটেও যায়।
কিন্তু যখন চাকরি থাকে নাএই চাকরি করা চাকরদের মানুষ-সংসারগুলো আর মানুষের সংসার থাকে না। জন্তুরা কাঁদে না, কিন্তু এই না-মানুষ বাবা মা গুলো শুধুই কাঁদে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ২:৩৯