যেখানে বাংলাদেশ সরকার ঋন নেয় ইন্ডিয়ান বেসরকারি ব্যাংক থেকে সেখানে যদি শুনি কোন বাংলাদেশী নাগরিক ঋন দেয় ইউরোপিয়িন ব্যাংক গুলোকে!!
এটি হচ্ছে আরব্য রজনীর অকল্পনীয় ও নিবিড়ভাবে গ্রন্থিত এক রাজকীয় লোকহিনীর এক বাস্তব জীবনী চিত্র। তিনি হচ্ছেন একজন রক্ত-মাংসের জীবন্ত কিংবদন্তী ও এক মহা অমিমাংসিত রহস্য। তিনি হীরক খচিত জুতো পরেন যার প্রতি জোড়া লক্ষ ডলার বলে ধারনা করা হয়। তাঁর সংগ্রহে এমনি হাজারো রত্ন খচিত জুতো রয়েছে। তাঁর পরনের কয়েকটি সু্যট স্বর্ণ সুতা খচিত। ভারতীয় দৈনিক 'দি হিন্দু' পত্রিকায় এ নিয়ে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রাশিদা ভাগৎ।
তিনি নিত্য গোসল করেন নির্জলা গোলাপ পানিতে। তিনি হচ্ছেন মুসা বিন শমসের। তিনি পৃথিবীর এক স্বল্প উন্নত রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক এবং এখানেই তিনি বসবাস করেন।
আমি জানি এমন একজন সৌখিনদার ব্যক্তির কথা যার পোশাক, পছন্দ-অপছন্দ ও নিদের্াশ হেয়ালীপনা বৃটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্যার এন্থনি ইডেনের মত। ঊনবিংশ শতাব্দির সেরা ফ্যাশনরাজ বিউব্রামেল এর সাথেই তাঁর কেবল তুলনা চলে।
আমরা আরো শুনেছি ফিলিপাইনের এক সময়ের ফাষ্ট লেডি ইমেল দ্য মারকোসের ফ্যাশন-প্রিয়তার কথা এবং যাঁর ওয়্যারড্রব ভরে থাকত ১০০ জোড়া সৌখিন জুতো। তবে কিন্তু মুসা বিন শমসেরের অবাক বিস্ময়কর বিলাসিতার কাছে ইমেল দ্য মারকোসের ফ্যাশন প্রীতি অনেকাংশে অলিক কল্পনা মাত্র।
এজন্যই বনেদী সংবাদ পত্র-পত্রিকায় তাঁর পরিচ্ছদ সম্পর্কে লিখেছে যে তাঁর সংগ্রহে অসংখ্য মূল্যবান সু্যট রয়েছে; তাঁকে কখনো এক সু্যট পরিহিত অবস্থায় দু'বার দেখা যায় না। এমনি মূল্যবান প্রতিটি সু্যটের দাম ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার পাউন্ড। যা শুধু তাঁর জন্য তৈরী করা হয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজাইনার বলে খ্যাত প্রিওনী বেলভেস্ট এবং ইটালীর আবলা এবং ফ্যান্সিসকো স্মলটো ও খ্রিস্টিয়ান ডিয়রের বিশেষ ব্রান্ডের অতি মূল্যবান পোশাক-আশাক দিয়েই তাঁর সারি সারি ওয়্যারড্রব ভর্তি। তাঁর হাতের সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির ডায়াল এবং ব্রেসলেট হচ্ছে হীরক খচিত। যার মূল্য অর্ধ মিলিয়ন ডলার এবং তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান ঘড়ির বেল্ট, কাফলিঙ্ক-এর সেটের মূল্য ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেবল তাঁর জন্যে প্রস্তুতকৃত এই মূল্যবান ঘড়িটি তৈরী করা হয়েছিল ২৭ মাসেরও বেশী সময় ধরে। বিশ্ব বিখ্যাত রোলেক্স কোম্পানী এই অত্যাশ্চার্য্য ঘড়িটির প্রস্তুতকারক।
কেবল মাত্র বড় বড় অংকের চেক সই করতে তিনি পুরো ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরী মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কলম ব্যবহার করে থাকেন। অতি মনোমুগ্ধকর এই কলমটিতে ৭৫০০ হীরক খন্ড বসানো রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ২৬০ হাজার মার্কিন ডলার। লন্ডনের দৈনিক দি সানডে টেলিগ্রাফ ম্যাগাজিনের এক জরিপে বলা হয়, এই আশ্চর্য্যজনক মূল্যবান ঘড়িটি পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত ঘড়ির মাঝে সর্বোৎকৃষ্ট।
ডঃ মুসা তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে কোন ব্যাংক থেকে কখনই কোন ঋণ গ্রহণ করেননি বরং তিনি ইউরোপিয়ান ব্যাংকেগুলোকে ঋণ দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ বিষয়টি ভারতের বিখ্যাত দি হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক রাসিদা ভাগৎ-এর বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বব ডোলকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত গালফ-ইস্টিম জেট বিমানটি নির্বাচনী প্রচারণার সাহায্যার্থে ধার দিয়েছিলেন। যদিও ডোল নির্বাচনে জয়ী হননি।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ডঃ মুসার চারিত্রিক গুনাবলী নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এসব প্রতিবেদনে তাঁকে বিভিন্ন শিরোনামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছে নানা মুখরোচক শিরোনামঃ "প্রাচ্যের রাজকুমারের রূপকথার গল্প", ''মুকুটহীন এক রাজার প্রতিকৃতি'', "বিশ্বের ধনী ও শক্তিধরদের বন্ধু"। কোনটার আখ্যায় আবার বলা হয়েছে, "বিলাসিতা যাঁর নিত্য জীবনের অঙ্গ।"
লন্ডনের দি সানডে ম্যাগাজিনে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছে এক আন্তর্জাতিক রহস্য মানব বলে। ইন্টারনেটের ওয়েব সাইটে তাঁকে "মহাজাগতিক যুগের প্রিন্স" বলা হয়েছে। টেলিগ্রাফ ম্যাগাজিনের উপ-শিরোনামে বলা হয়, "ডঃ মুসা বিন শমসের প্রচন্ড মাত্রার একজন ধনী এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি।"
তাঁর গুলশানস্থ বিলাশবহুল প্রাসাদোপম ভবনের পাহারায় নিয়োজিত আছে কেতাদূরস্ত ও সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী দল। বলা হয় তাঁর ভবনের প্রতিটি আসবাবপত্র বিশেষভাবে ইটালি থেকে প্রস্তুতকৃত। তাঁর প্রাসাদের আভ্যন্তরীণ মূল্যবান সব কারুকার্য ৬ মাস অন্তর পরিবর্তন করা হয়। তাঁর রাজোচিত খাদ্য ভান্ডার সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। একটি বিশেষ মজার ব্যাপার এই যে, বিশ্ব বরেণ্য এই ধনাঢ্য প্রিন্স জীবনে কখনও মদ্য স্পর্শ করেননি। পৃথিবীর সব শক্তিধর ও প্রভাবশালী নেতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি অতি নিকটজন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ সিনিয়র বুশ, টনি ব্লেয়ার, সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন, মারগারেট থ্যাচার, ডেভিড ফ্রস্ট, নেলসন মেন্ডেলা তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু মহলের অনর্্তভুক্ত। মার্গারেট থ্যাচার, ডেভিড ফ্রস্ট এবং নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁদের আত্মজীবনী গ্রন্থ সহস্তে স্বাক্ষর দিয়ে প্রিন্স মুসাকে উপহার দিয়েছেন।
এক সময়ে বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার সাথে তাঁর নাম জড়িত করে বেশ রসালো কিচ্ছা-কাহিনী ছাপিয়েছিল। মুসা বিন শমসেরকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব ঘটনার সত্য উদঘাটিত হয়েছে। জাতীয় এবং আনর্্তজাতিকভাবে এ পর্যন্ত প্রকাশিত অনেক বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের মুখে তিনি এক বিরাট রহস্যঘেরা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি যখন বৃটেনের লেবার পার্টিতে ৫ মিলিয়ন পাউন্ড দান করতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখনই তিনি বিশ্বময় সংবাদ মাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রস্তাবটি এড়ানো হয়েছিল শুধুমাত্র একটি কারণেই ঃ তিনি বৃটেনের ভূমিপুত্র নন।
তিনি আবারও বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিলেন। উপলক্ষ্য ছিল তিনি এক প্রস্তাবে সে দেশের ১৫০০ একরের বিশাল ঐতিহ্যবাহী জমিদারী 'লুটন হু' ২৫ মিলিয়ন স্টালিং পাউন্ড দিয়ে ক্রয় করতে চেয়েছিলেন। আসল কথা হল, বৃটিশ সংবাদ মাধ্যমগুলো আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার ধনী ব্যক্তিদের বৃটেনের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান সম্পত্তি কেনার আগ্রহটা আদৌ ভাল নজরে দেখে না। এ কারণেই মিশরীয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ডোডি আল-ফায়েদ যখন লন্ডনের হ্যারডস্ ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর ক্রয় করেন তখন সারা বৃটেনে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে এখনো ডঃ মুসা বৃটিশ সংস্কৃতির একজন অকৃত্রিম প্রেমী হিসাবেই রয়েছেন।
তিনি মনে করেন, বৃটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের মানব সভ্যতাকে অনেক কিছু দান করেছে এবং তাঁর ধারণা বিশ্বময় বৃটিশ সাম্রাজ্যে অব্যাহত থাকলে মানব সভ্যতার আরো অশেষ উপকার হত। ডঃ মুসার এই মতামতটি অনেক দার্শনিকের কাছেও গ্রহণযোগ্য।
ডঃ মুসার অর্জিত বিশাল ধন-সম্পদ ও বিলাসিতার কল্পকাহিনী তাঁর শিক্ষাগত অর্জনকে আড়াল করেছে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে কৃতিত্বের সাথে পি,এইচ,ডি লাভ করেছেন।
তাঁর পর্বতসম সম্পদের মূল্য নির্ধারণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ১ বিলিয়ন হতে ৩ বিলিয়ন ডলার কিংবা তারও বেশী বলে ধারণা করা হয়। যদি তা' হয়, কিভাবে তিনি এই লক্ষ কোটি টাকা অর্জন করলেন এটা এক মহা রহস্য হিসাবে রয়ে গেছে। জনৈক সাংবাদিক ডঃ মুসার অনেক আস্থা অর্জন করেছিলেন। সে কারণে তাকে তাঁর রক্ষিত সমস্ত স্বর্ণ, রৌপ্য, অলংকার ও মূল্যবান সম্পদ অবলোকনের সুযোগ দিয়েছিলেন। তার কাছে মনে হয়েছিল এসব যেন আরব্য রজনীর রাজা-মহারাজাদের স্তুপকৃত অত্যাশ্চার্য্য ধন-রত্নের মতো।
তাঁর সহধর্মীনি ফাতেমার অঢেল অলংকার এবং সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। তাঁর ব্যবসা সংক্রান্ত নিয়ে তিনি খুব স্বল্প কথাই বলে থাকেন। তাঁর বিপুল ধন-সম্পদ সম্পর্কে বলা হয়, এগুলো তার অস্ত্র ও আবাসন প্রকল্প থেকে অর্জিত ফসল। অবশ্যই তিনি স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে অস্ত্রের ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু বিস্তারিত আলোচনার অভাবে কেউ তাঁর বিশাল বিত্ত-বৈভবের কোন উপসংহার টানতে পারছে না।
ডঃ মুসা বিন শমসের দাবী করেন যে, তিনি কোন বেআইনী ব্যবসা করেন না এবং তিনি তাঁর ব্যবসা থেকে সরকারকে নিয়মিতভাবে যথাযথ কর প্রদান করে থাকেন। তাঁর আগেকার জীবন আরো স্বচ্ছ হয়েছে পরবর্তী দিনগুলোতে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে।
তিনি ফরিদপুরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একজন সরকারী কর্মকর্তার ছেলে তিনি। স্কুলে তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং শৈশবই তাঁর বুদ্ধি-দীপ্ততার পরিচয় প্রকাশ পায়। মাত্র ৪১ বছরের প্রিন্স তাঁর সম্পদ দিয়ে কি করবেন, তাঁর এ বিষয়ে পরিকল্পনা কি, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। তিনি যেন নিজেকে রহস্যাবৃত রাখতে পছন্দ করেন। দেশে তাঁর জনহিতকর বিশাল উদ্যোগ অতীতে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে। যেমনি তাঁর বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগটি সরকার হতে প্রত্যাখ্যাত করা হয়েছিল। কারণ, কতর্ৃপক্ষ মনে করেছিল তাঁর সম্পদের অর্জনটা ছিল অস্বচ্ছ। তবু প্রশ্ন জাগে মানবতার সেবায় তিনি কি সাড়া দিয়ে থাকেন? অনেকেরই ধারণা মুসা বিন শমসের তাঁর বিশাল অর্জন নিয়ে মহৎ ধ্যান ধারণা থেকে নিভৃত থাকতে পারেন না। পূর্বে বহু দার্শনিকের অসম্ভব দূরদৃষ্টি ছিল। কিন্তু ছিল না তাদের সাধ মিটানোর প্রয়োজনীয় অর্থ। ডঃ মুসা বিন শমসেরের বিপুল আর্থিক সঙ্গতি সম্পর্কে প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত তথ্যাদি যদি আমরা আংশিক ভাবেও সত্য বলে মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত থাকি, তবে দেখব তাঁর এক জীবনে এত অর্জন সত্যই সীমাহীন। দর্শন শাস্ত্রের আলোকে বলা যায়, যখন যে কেউ স্বীয় মহৎ কর্মকান্ড নিয়ে আলোকিত হন, তখন অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাঁর সুদূর প্রসারী দৃষ্টিশক্তি রয়েছে।
সৌজন্যেঃ, দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ঢাকা, ১৯ জুন, ১৯৯৮
অনুবাদে ঃ মুহম্মদ সিরাজউদ্দিন