নোঙর ফেলার ঘর ঘর শব্দটা কানে আসার পর বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। মাঝারি সাইজের সাদা রঙা একটি জাহাজ নোঙর ফেলছে। কিসের জাহাজ কে জানে। এক মাসেও জাহাজ দেখে এর প্রকৃতি চেনা হয়ে উঠলো না। এগুলোর বিশেষ কোন চিহ্ন টিহ্ন আছে কি-না কে জানে। জাফর কিন্তু জাহাজগুলোর দিকে একবার তাকিয়েই মাছ ধরা, বালু টানা কিংবা লবণ টানা ট্রলার বলে চট করে বলে দিতে পারে। অবশ্য তার সব কিছুতেই অতি আত্মবিশ্বাস, সেদিন বলছিল একবার দেখিয়ে দিলে প্লেন চালাতে পারবে। সুতরাং ঐ মাছধরা বা লবণটানা কিংবা বালু টানা পরিচয়গুলো আসলেই কতটুকু জেনে বলা সে সন্দেহ থেকেই যায়। জাহাজটার দিকে ভালো করে তাকালো সে, হঠাৎ করে ভোঁ করে বেজে উঠা ভেঁপুটার তীক্ষ্মতা ছাড়া আর কোন বিশেষত্ব ধরা পড়লো না। 'মামা কি দেখেন'? তার কথা ভাবতে ভাবতেই জাফর এসে পাশে দাঁড়ালো।
কি রে তুই না বাজারে গেলি?
বাজার শ্যাষ, অহন রান্না বান্না;।
সে কি দেখছে সেটা জানার আর কৌতূহল দেখাল না জাফর। চলে গেল রান্না ঘরে। জাফরের পিছু পিছু রান্না ঘরে খেতে গিয়ে থমকে দাড়াল সে, যা পারে করুক নিজের মত করে। বারো তেরো বছর বয়সে আর যে পারুক বা না পারুক অন্তত: সে রান্নার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। অথচ বছর বারোর জাফর এ অল্প ক'দিনেই তার অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
আবার নদীর দিকে তাকালো সে, এখানে থাকা অনেকের চোখেই এখানকার অসাধারণ দৃশ্যটা গতানুগতিকতার বাইরে নয়, হয়তো এখনো মাস পেরুনো হয়নি বলেই, দিন বা রাত যেকোন নদীর দিকে তাকালে ভাবালুতা ভর করে।
এখন যেমন করলো। শুধু নদী নয় আদিগন্ত খোলা আকাশও এখানে দৃশ্যমান। ভুলে থাকতে চাইলেও তুলনাটা চলে আসে। মাত্র ক'মাস আগে ছেড়ে আসা তার বাড়িটা ও এরকম আদিগন্ত খোলা আকাশের সামনে ছিল। এক পাশে খোলা আকাশ আর আরেকপাশে ছোট্ট পাহাড়ি নদী, সেটা পেরুলে, একের পর এক পাহাড়ি টিলা। সেদেশে ঠাণ্ডা এমনিতেই বেশি, তা যেন আরো বেশি বেড়ে যেত ঐ পাহাড়ি সান্নিধ্যে।
এখানেও ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, এদেশিয় প্রেক্ষাপটে তো-তাই বলা যায়। নীচের রাস্তা দিয়ে চলাচল করা বেশির ভাগই শীত বস্ত্র পরা। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা নিজের দিকে তাকালো সে। আট বছরে অনেক কিছু বদলেছে। বেশি বদলেছে আবহাওয়াগত অভ্যাসটা। ধুম করে সেটা আবার বদলে ফেলা সম্ভব না। অথচ শুরুতে তার বিপরীত চিন্তা ছিল। ভেবেছিল দেশে আসা মানেই একেবারে আগের সেই ভেতো বাঙালির পুরনো রূপ নিয়ে ফেরা।
বালতি রাখার ঘষটে শব্দটা তার আত্মগত'র তালটা কেটে দিল, পাশের বারান্দা থেকে আসা শব্দটা অনুঘটক হয়ে সে বাসার বাসিন্দা মেয়েটির দ্রুত ঘরে ঢুকে যাওয়াটা দেখল। অথচ সে তাকিয়েছিল সামনে, মেয়েটি যদি বালতির সবগুলো কাপড়ও মেলে দিত তবু ঐ সময়ে তাদের বারান্দায় তার তাকানোর সম্ভাবনা ছিল না। আগেও লক্ষ্য করেছে সে, মেয়েটি খামাকাই তাকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে বার বার নজর কাড়ে। এ যেন, 'চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী' টাইপ ব্যাপার। এখনো বেনী দুলিয়ে কলেজে যাওয়া মেয়েটিকে সে প্রথমদিকে খেয়ালই করেনি। বিরক্ত হলো সে।
এ বিষয়ে নির্মোহ থাকার সিদ্ধান্ত ছিল তার। যদিও জোর করে, কারো দিকে তাকানো না জাতীয় কোন সিদ্ধান্ত নেই বরং পথ চলতি যদি কোন আঁখির ফাঁদে আঁখি পরে টাইপের ব্যাপার হয়ে যায়, তবে তা হতেই পারে। গতকালই কেন এতদিন বিয়ে করা হয়নি জাতীয় কথার জবাব দিতে গিয়ে একজনের কাছে অকপট হয়েছিল সে। মানুষের অতীত জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখানো অন্যদের কাছে একেবারে তুঙ্গে থাকে এ বিশেষ দিকটা। আসার পর থেকে এ পর্যন্ত এ একটি দশক সে কি পড়তো, কি ভাবতো, কি খেতো কিংবা কোথায় কোথায় থেকেছে এমন সব প্রশ্নের চেয়েও বহুগুণে বেশি জবাব দিতে হয়েছে কার সাথে তার সম্পর্ক ছিল কিংবা কাদের সাথে, কেউ কেউ আরো এগিয়ে জানতে চেয়েছে সে সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু ছিল।
গভীরতা শব্দটা যদি হৃদ্যতার সমার্থক ধরা হয়,... নিঃশ্বাস ছাড়লো সে, আবার মনে পড়লো আর্মানের কথা।
মেয়েটি তাকে পাগলের মত পছন্দ করতো। টিনএজ ও কালটা পেরিয়ে এলেও ঐ বয়সের সাথে মানায় এমন সব পাগলামি ছিল তার আচরণে। মজার ব্যাপার হলো সেসব পাগলামি তাকে মানিয়েও যেত। এ দেশে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস রুমের বাইরে অন্য ডিপার্টমেন্টের কেউ মিনি স্কার্ট পরে তার জন্য অপেক্ষা করবে আর ক্লাস থেকে বেরুলেই দৌঁড়ে এসে কণ্ঠ লগ্না হবে, এক কথায় এ কথা অসম্ভব কল্পনা, অথচ আর্মানের এসব কাণ্ডকীর্তির বিপরীতে কেউ কেউ তাকে ঈর্ষাও করতো, অন্তত: মুখে তাই জানাত।
অথচ, অবাক ব্যাপার মেয়েটির নামই আর্মান নয়। তার জাতীয়তার কাছে মুছে গিয়েছে তার সার্টিফিকেটের নাম। জন্ম সূত্রে আর্মেনিয়ার নাগরিকত্বের কারণে পরিচয়ের ক'দিন পরেই যখন সে জানিয়েছিল আর্মান বলে ডাকবো, আর্মান! সেটা আবার কি; অনুমিতভাবেই প্রাথমিক একটা বিস্ময় শুনতে হয়েছিল। কারণটা ব্যাখ্যা করার পর, এটা আবার কোন রেসিজম নয়তো; বলে সন্দেহও প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু ঐ একদিনই। তারপর আর কোন প্রশ্ন উঠেনি। কোন আকিকা ছাড়াই নামকরণটা হয়ে গিয়েছিল। শেষদিন পর্যন্ত ঐ নামই ছিল তার একমাত্র সম্বোধন।
তার দেশে ফিরে আমার কথায় কিংকর্তব্য চোখে তাকিয়েছিল আর্মান। একা ফিরে আসার দৃঢ়প্রতিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আর্মানকে দ্বিতীয় ভাবনা থেকে মুক্তি দিয়েছিল সে, কিন্তু সারা জীবনের জন্য যেন নিজেই তুলে নিয়েছে সে ভার। এখনো কারো দিকে তাকালেই মনে পড়ে আর্মানের কান্না ভেজা দুর্বোধ্য মুখটা। পথ চলতি যদি কিছু হয়ে যায় হতেই পারে কিন্তু এত সহজে দ্বিতীয় কোন আর্মানের সৃষ্টি চায় না সে।
বিশেষত: কারো টিনএজ রোমান্সের কল্পনা বিলাসী সঙ্গীত্বের দায় রীতিমত অসন্তুষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য পরমুহূর্তে, এইমাত্র চিন্তা করা অসন্তুষ্টির প্রদর্শন নয় বরং লঘুস্বরে ডেকে উঠা মোবাইলের ডাকে সাড়া দিতে ঘরে ঢুকলো সে।
কিরে ডব্লিউ, ঘুমাঘুমির মুড কি শেষ হলো নাকি এখনো বিছানায়, আমি কি উপরে উঠবো? সম্বোধনটা হকচকিয়ে দিল তাকে। 'ডব্লিউ!' অবশ্য সে সম্বোধনই সেভ না থাকা নাম্বারটা খেকে আসা কলের ওপারে কে তার শনাক্তকরণে সাহায্য করলো। তার ফিরে আসার খবর পেয়ে প্রথমদিন যখন দেখা করতে এসেছিল, সেদিনই তার নতুন নাম কি জিজ্ঞাসা করেছিল রবি। নতুন নাম মানে তার অবাক জিজ্ঞাসার জবাবে নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে নতুন নামটাও তখন বানিয়েছিল সে-ই। 'আরে ব্যাটা ইউরোপ আমেরিকায় গিয়েই মানুষ সবার আগে নিজের নামটা নিয়ে টানাটানি শুরু করে, আর তুই পুরা একটা দশক কাটাইয়াও কোন উন্নতি করতে পারলি না। যা তরে এখন থেকে ডব্লিউ বলে ডাকবো, সেদিন যতক্ষণ ছিল ডব্লিউ ডব্লিউ করছিল, আজ আবার শুরু করলো।
বিষয়টা অবশ্য তার খারাপ লাগলো না। বরং 'শালা তোর এখানে প্রথমদিন আসার পরই সেই যে বাইরে গেলাম তাতে গেল পুরা আঠারো দিন, আইজ পুরা দিন ছুটি তাই তোর এখানে গ্যাজাইতে আইলাম বলে রবি যখন গ্যাট হয়ে বসলো ভালো লাগলো তার।
তা সেদিন যে বলেছিলি তোর মাথায় ইদানিং সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটা কি এখনো আছে, সেই ছাত্রজীবনের না বদলানো গলায় বললো রবি, নাকি দু'দিনের বায়ুচাপ পেটে দেশি পানির ঠেলায় হাইওয়ে ধরে বেরিয়ে গেছে সি ডব্লিউ?
বলার ভঙ্গীতে হেসে ফেললো সে, কিন্তু কোন সমস্যার কথা বললো রবি ঠিক বোঝা গেল না, আরো খানিকক্ষণ একতরফা বকবকানির পর থামলে জিজ্ঞাসা করলো সে। আরে ঐ যে, সুখে থাকা অবস্থায় পেত্নীর ঠেঙানি খেয়ে এখানে থেকে যাওয়ার প্ল্যান করলি না, ঐটার কথা বলছি। আরে ব্যাটা সবাই ইমিগ্রেশন ভিসা বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর তাদের ঐ অজ্ঞান শরীরটাই ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার জন্য কোমর বেঁধে দৌঁড় মারে, আর তুই আসছস সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এখানে নতুন করে থিতু হবি বলে, হা।
অবশ্য রবি খানিকক্ষণ তাকে পাগল ছাগল বললেও যাওয়ার সময় ঠিকই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে সাহায্য করতে রাজী হল। তার পরিকল্পনা ছিল ঠিক একমাস কোন কাজ কর্ম নয়, শুধুই আলসেমি। আর আজ তার শেষ দিন। অনেকটা যন্ত্রের মত পরিশ্রমী জীবন কাটানো সময়ের ঝেরে ফেলাটা শুরু হবে বিপরীত আলসেমি দিয়ে তারপর শুরু তার জীবিকার সন্ধান। প্ল্যান ঠিক পথেই আছে। যদিও ঐ পরিশ্রমী জীবনের প্রেক্ষিতেই জমে উঠা সঞ্চয়টা এ দেশিয় প্রেক্ষাপটে স্বস্তির সাথে নিরাপত্তাও দিতে পারতো, তবু তাকে ভিত্তি করে থামতে চাওয়ার মত অতটা আলসেমি কারো পরবর্তী লক্ষ্য থাকে না। তারও হয়নি। তাছাড়া নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাওয়ায় যাবতীয় সব সঞ্চয়ের বিপরীতে দুটো মহাদেশে মাস দুয়েকের অসাধারণ ভ্রমণ এবং চমকপ্রদ সব অভিজ্ঞতা তাকে অর্থনৈতিকভাবে এগার বছর আগে প্রায় কপর্দকীনভাবে দেশ ছাড়ার আগের অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। নতুন করে সবকিছু শুরু করলেতো ভিত্তিটাও নতুনই হতে হবে। যে কারণে পরদিন তার নতুন জীবিকার সন্ধানে প্রথম পা ফেলার ক্ষণ আর সূচি ঠিক হল। আর রবি বেরুনোর খানিকক্ষণ পর আবার তাকে ফোন করতে হওয়ায় প্রি পেইড সিম এর ব্যালান্স না থাকায় নতুন নেয়া দ্বিতীয় সিম থেকে কল করতে হলো। রাস্তার কোলাহলে নতুন নাম্বার দেখে কে বলছেন কে বলছেন রবির দু'বার উচ্চারণের জবাবে সে নিজেকে ডব্লিউ বলে মেনে নিল, আরে ব্যাটা আমি ডব্লিউ বলছি; আর তাতে ফোনের ওপাশে উচ্ছসিত হলো রবি, এখন থেকে তুই পার্মানেন্ট ডব্লিউ। স্মিত হাস্যে মেনে নিল সে, হোক না ক্ষতি কি। অতএব তার নামেও পরিবর্তন ঘটলো।
এবং অবাক ব্যাপার পরদিন সকালে বেরুতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো তার হৃৎস্পন্দনের দ্রুততর হয়ে উঠা, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে দেয়া জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ'র কথা মনে পড়লো তার। পরদিন ক্যাম্পাসে অন্যদের সাথে হাসাহাসি করলেও কখনোই অস্বীকার করা যায়নি এর বিশেষত্ব যেমন অস্বীকার যায়নি ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন পূর্ব পরিচিত থাকা সত্ত্বেও রুমে ঢোকার সাথে সাথে তার গলা শুকিয়ে আসার কথা। বোর্ডের যিনি মধ্যমনি ছিলেন, কোন প্রশ্ন করার আগে বেলটিপে পিয়ন ডেকে পানি খাইয়েছিলেন। নিজের সেই নার্ভাস হয়ে পড়া পরবর্তীতে তাকে অনেকবার কৌতুককর অনুভূতি দিয়েছিল, অথচ আজ আবার যেন সে ফিরে গেল বারো বছর আগের সেই দুপুরে।
এবার হাসলো সে, বারো বছর পর তার ভূমিকা কিছুটা বদলে গেছে, এবার চাকরির প্রত্যাশায় কোথাও যাচ্ছে না। কিন্তু তবু নতুন পেশার সাথে সম্পর্কিত বলে, আলাদা হলেও কর্ম সন্ধান তো বলাই যায়। হাতের দিকে তাকালো সে, ঐ দিনের কাঁপাকাঁপি নেই, কিন্তু ভেতরের উদ্বেগতো বর্তমান আবার হাসলো সে, উপভোগ যদি উদ্দেশ্য হয়, তো সবপিঠ নিয়েই তো বাস্তবতা, তবে ধোঁয়াশার মাঝেই অজানা গতিতে অজানা পথে নির্ণীত হোক আপাত: গন্তব্য।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৫৯