somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে এই বীরাঙ্গনা?

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েক সপ্তাহ আগে লন্ডনে প্রবাসী বাঙ্গালিদের আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তো অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার চেতনা-ধারী একদল মানুষ!

আমি অবশ্য জানতাম না যে, এইটা চেতনা বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান। আমি সচরাচর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলি। যাইহোক, প্রথমেই হালকা নাস্তা খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা-বাচ্চা কয়েকজন ছেলে-মেয়ে দেশাত্মবোধক গান এবং নাচের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৯৫২-১৯৭১ পর্যন্ত আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। ম্যানচেস্টারে অবস্থিত এই স্কুলটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশী কিছু পরিবার। উনারা বাঙালি ছেলে-মেয়েদেরকে দেশাত্মবোধ এবং স্বাধীনতার চেতনায় গড়ে তুলেন। খুবই ভাল লাগল দেখে!

এরপর একজন বাঙালি মহিলা বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা নারীদেরকে নিয়ে উনার অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করলেন। উনি বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদেরকে নিয়ে কাজ করে থাকেন। উনাদের খুবই মহৎ একটি পরিকল্পনা রয়েছে; আর তা হল, বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদেরকে পুনর্বাসিত এবং সার্বিক সহায়তা করা!

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বীরাঙ্গনা হলেন সেইসব নারী; যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন এবং প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতেন। আর তৎকালীন (বাঙালি) জামাতের নেতা-কর্মীদের কাজ ছিল, এইসব নারীদেরকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চিহ্নিত করতে পাকিস্থানিদেরকে সহায়তা করা। তাইতো পাকি-জারজরা বাংলাদেশের জামাতের নেতা-কর্মীদেরকে আদর করে ডাকতেন- “রাজাকার” বলে। “রাজাকার” একটি উর্দু শব্দ, যার বাংলা অর্থ হল- “সাহায্যকারী/ স্বেচ্ছাসেবক”!

এইবার মূল কাহিনীতে ফিরে আসি। বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদেরকে নিয়ে কাজ করা জনৈক ঐ মহিলার বক্তৃতা শুনে যা যা বুঝলামঃ

শুধুমাত্র ১৯৭২ সালেই নাকি, প্রায় ৬ লক্ষ বাঙালি নারী আত্মহত্যা করেছিলেন। ঐ নারীরা সবাই ছিলেন বীরাঙ্গনা। লজ্জা এবং অপমানে উনারা আত্মহত্যা করেন। এই তথ্য আমার জানা ছিলনা, শুনে খুবই মর্মাহত হলাম।

পরবর্তীতে আমাদের সমাজে অবশিষ্ট বীরাঙ্গনারা অনেক অনেক অবহেলিত হয়েছেন। উনাদেরকে কেউই সামাজিকভাবে গ্রহণ করত না। এদের অনেকেই করেছেন আত্মহত্যা, অনেকেই পালিয়ে গেছেন, অনেকেই আত্মগোপন করেছেন এবং বাকিরা এক অকথ্য-বিভীষিকাময় জীবন বেছে নিয়েছেন।

আমাদের সমাজে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা যতটা না সম্মান পেয়েছেন; বীরাঙ্গনারা ঠিক ততটাই অপমান এবং লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন কি, উনারাও কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পিছে অবদান রেখেছেন। প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেও, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন বাংলার। এইসকল বীরাঙ্গনা নারীরা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিকামী পরিবারেরই সন্তান। কারোর মা, বোন কিংবা স্ত্রী! মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের জন্য কোটা আছে, কিন্তু বীরাঙ্গনাদের জন্য নাই কিছুই।

সারাজীবন বীরাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা শুনেছি। কিন্তু বাস্তব কাহিনী আমরা অনেকেই জানি না। সাম্প্রতিক সময়ে উনারা প্রায় ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে খুঁজে পেয়েছেন। সকলের বয়স প্রায় ষাট-ঊর্ধ্ব! এই পর্যায়ে উনি বীরাঙ্গনাদের দুঃখ-গাঁথা আমাদের সামনে তুলে ধরছেন এক এক করে।

যেমন- একজন বীরাঙ্গনার সন্তানেরা তাঁকে ত্যাগ করেছেন। তাঁর ছেলে প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল, কোন যোগাযোগ রাখে না। অনেক কষ্ট এবং অনাহারে উনার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরকম কয়েকটি ঘটনা উনি বললেন। উপস্থিত সবাই খুব মর্মাহত। এঁদের জন্য কিছু করতেই হবে আমাদের। আমি মনে মনে ভাবছি, কিভাবে বীরাঙ্গনাদেরকে সহায়তা করা যায়। এইরূপ নানাবিধ চিন্তায় যখন মগ্ন, তখন উপস্থাপিকা বলে উঠলেন আরেকজন বীরাঙ্গনার কথা—

এই বীরাঙ্গনাকে এমনভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে যে, উনার পায়ু-পথ এবং যোনি-পথ, এক হয়ে গেছে! প্রতিদিন উনার চিকিৎসা-বাবদ ভাল পরিমাণ টাকা খরচ হয়। [আমি তো শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। এই জীবনে অনেক কাহিনী শুনেছি, কিন্তু আজকে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এ আমি কি শুনলাম!]

বলতে বলতে দেখলাম, উপস্থাপিকা কেঁদে দিলেন। চোখ তুলে দেখি- আমার সামনের দর্শক সারিতে সবাই কাঁদছেন; কেউবা আবার চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন! পুরা অডিটোরিয়াম জুড়ে যেন এক চাপা-কান্নার রোল এবং বিষণ্ণতা ভর করল! আমার পক্ষে ঐ মুহূর্তটা ভাষায় বলে বুঝানো সম্ভব নয়!

তখন আমার মনে শুধু বার বার একটিমাত্র প্রশ্নই উঁকি মারতে লাগল; এইভাবে এই ব্যাথা নিয়ে আজও কিভাবে ঐ মহিলা বেঁচে আছেন। এরপর আমি অডিটোরিয়াম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। আর শুনতে চাই না আমি বীরাঙ্গনার হাহাকার; আর শুনতে চাই না আমাদের ব্যর্থতার কথা!

আমি খুব একটা বই পড়ি না। তবুও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, হুমায়ূন আহমেদের ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’ ইত্যাদি অল্প কিছু বইয়ের মাধ্যমেই জেনেছি; পাকি-জারজ কর্তৃক বাংলার নারীদের উপর অত্যাচারের কথা। তবে কেন জানি মনে হল; আজকের এই শেষ কাহিনীটা আমাকে আবারও নতুন করে ভাবিয়ে তুলল! সেদিন থেকে আজবধি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি- প্রতিদিনই, প্রতিনিয়তইঃ

[১] আমরা কি এই সমাজে বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারি না?

[২] জানি শেষ মুহূর্ত; তবুও কি আমার এইসব অবহেলিত এবং মৃত্যু-পথযাত্রী বীরাঙ্গনাদের প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শন করতে পারি না?

[৩] আমরা কি উনাদের চিকিৎসা এবং জীবন-যাত্রার যাবতীয় খরচ বহন করতে পারি না?

[৪] উনাদের সামাজিক এবং ব্যক্তি-জীবনে এহেন দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য; আমরা কি জামাত নামক ঐ নরকের কীটকে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে নিষিদ্ধ এবং নিশ্চিহ্ন করতে পারি না?

[৫] আমরা কি আরও একবার চিৎকার করে বলতে পারি না- “রাজাকারের বিচার চাই”?
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×