আমার দেখা বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির মধ্যে জার্মানীদের সবচেয়ে ভদ্র ও আনন্দ প্রিয় মনে হয়েছে। তাদের সেন্স অব হিউমার ও বেশ ভাল। এবং যথেষ্ট বন্ধু সুলভ।
ছবিটি তুলা ২০১১ সালে হাইস্পিড ট্রেনের দ্বিতীয় তলায়।
রাতে কায়রো থেকে ফ্রান্কফোটে নেমে পরের দিনই ট্রেন ধরেছিলাম 'লিভারকুজেনের'। গন্তব্য লিভারকুজেন স্টেডিয়াম, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে উইমেন ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ।
এটাই ছিল ইউরোপে আমার প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। কাজেই আবেগে আপ্লুত ছিলাম।
আমার বগিতে আরো বেশ কিছু ইয়াং ছেলে পেলে ছিল। যথেষ্ট পাগলামী আর হৈচৈ করে ট্রেন মাথায় তুলে রাখছিল। আমিতো ট্রেন, যাত্রী, প্রাকৃতিক দৃশ্য পুলাপানের দুষ্টামি সবই উপভোগ করতে ছিলাম।
পুলাপানগুলো হটাৎ আমাকে দেখে আমার দিকে আসল এবং কুশল বিনিমিয় পরে আমার সাথে ছবি তুলল। আমিও আমার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললাম। হয়ে গেল অঘোষিত বন্ধুত্ব।
তারা একে অপরের মাঝে বিয়ার ছুড়ে মারত, কারো মাথায় ঢেলে দিত, কারো গায়ের পোশাক খুলে সারা গায়ে বিয়ার ঢেলে দিত।
তাদের একজন আমাকে বিয়ার অফার করল। আমি বুঝাইলাম যে আমার অভ্যাস নেই। তখন তাদের থেকে একজন যে অপেক্ষাকৃত দুষ্ট আমাকে বিয়ার খাওয়াইতে কিছুটা জোড় করতে চাইল। আমি মনে মনে চিন্তায় পরে ভাবতে লাগলাম এই বুঝি আমার অপমানের পালা শুরু হলো। কিন্তু অপর একজন তার কানে কানে কি যেন বলল, সাথে সাথে দুষ্ট পুলাটা সরি বলল এবং বুঝাইলো যে সে আমার সাথে দুস্টামি করেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে সে বলেছে যে আমি মুসলমান, তাই হয়তো বিয়ার খাই না। অন্ন ধর্মের ও জাতির প্রতি তাদের সম্মান দেখে তাদের প্রতি ভালবাসার জন্ম নিল।
আমার সিটের পাশের সিটে ছিল খুবই সুন্দরী স্লিম ফিগারের কুড়ি বছরের একটি মেয়ে। অন্যরা ইংরেজী বলতে না পারলেও মেয়েটি ভাল ইংরেজী বলতে পারে। ফ্রান্কফোট থেকে সিটে বসেই হায় হ্যালো এবং হালকা পরিচয় হয়েছিল। আমি জার্মান ভাষা না পারাতে মেয়েটা আমাকে হেল্প করতে চেষ্টা করত।
হটাৎ ঐ ছেলে গুলা মেয়েটির সামনে আমাকে বলতে লাগলো: এটা কি তোমার গার্লফ্রেন্ড? আমি অবাক হয়ে স্পিসলেস হয়ে গেলাম। বললাম: নো নো নো, এই মাত্রই আমাদের পরিচয় হয়েছে এই ট্রেনেই। অমনি ঐ মেয়েটিকে ও একই প্রশ্ন করতে লাগলো: এটা কি তোমার বয় ফ্রেন্ড? মেয়েটির অবস্থাও ঠিক আমার মতই হয়ে গেল। লজ্জায় যেন ফুল কলিতে রুপান্তরিত হতে চললো। ইউরোপীয়ান মেয়েদের এত লজ্জা আছে আগে জানা ছিল না। মেয়েটেও ছেলেদের একই জবাব দিয়ে বললো> আমরা একে অপরকে চিনি না, এখানে ট্রেনে হালকা কথা বার্তা হয়েছে, এতটুকুই । ছেলে গুলা বলতে লাগলো ঠিকাছে তোমরা গার্ল ফ্রেন্ড বয় ফ্রেন্ড হয়ে যাও। তোমরা উভয় হ্যাংলা পাতলা আছো, তোমাদের মানাবে ভালো। এই বলে হু হু হা হা হা করে সবাই অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। আমাদের আসে পাশের সকল যাত্রীরা আমাদের হাসির সাথে যোগ দিল। এক আনন্দ ঘন মুহুর্তের সৃষ্টি হলো। আমি এবং মেয়েটি উভয়ই লজ্জায় কেবল তাদের হাসি দেখছিলাম এবং একে অপরের দিকে একবার তাকাতেই সবাই আরো হো হো করে হেসে উঠলো। সবার ভাবে মনেহচ্ছিল আমাদের বুঝি মামলাটা ফিট হয়েই গেলো, সেই খুশিতে তারা হাসছে। এমন অপরুপ আনন্দ ঘন মুহুর্তে মনে হচ্ছিল যেন, কুচ কুচ হোতা হে।
তখন ছেলেগুলা আমার ক্যামেরা নিয়ে বললো: দাও তোমাদের দুজনের ছবি তুলে দেই। আমি বললাম, নো নো নো.... দরকার নেই। কিন্তু এতক্ষনে কয়েকটা ক্লিক হয়ে গেছে। আমি বাম দিকে একটু সরে এলাম মেয়েটিও একটু ডান দিকে সরে গেল। ছেলে গুলো এই সরে আসা নিয়ে আরো মজা পেতে লাগলো। আর ধাক্কা ধাক্কি করে আমাদের একজনকে অপর জনের দিকে ঠেলে দিতে লাগলো। কিন্তু আমরা কেহই রাজি হতে পারছিলাম না। এভাবেই আমাদের দুজনকে নিয়ে মজা চলতে লাগলো অনেক্ষন।
একটু পরেই ট্রেন হুইশেল দিতে দিতে একটি স্টেশনে থামার জন্য স্পিড কমাতে লাগলো। ট্রেন থামতেই ছেলেগুলো বায় বায় বলে লাফিয়ে নেমে গেল। মেয়েটি ও আমার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটিও নেমে যাবে।
মেয়েটি কিছু না বলেই আমাকে পাশ কাটিয়ে নেমে যেতে লাগল। আমিও কিছু বলার সাহস ও ভাষা পেলাম না। মেয়েটি ট্রেনের নিচতলায় নেমে স্টেশনে পা দেয়ার আগে ট্রেনের হাতল ধরে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। আমিও তার চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারলাম সে বলতে চাচ্ছে: ওকে বায়, ভাল থেকো, মিস করবো। আমিও দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে মনে মনে বললাম: ওকে বায়, ভাল থেকেো, আমিও তোমাকে মিস করবো। এভাবেই জন্ম নিতে নিতে একটি লাভ স্টোরি খতম হয়ে গেলো।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:০০