মিশরে আসার পর থেকে মিশরীয়দের মুখে একক ভাবে যার নাম সব চেয়ে বেশি শুনেছি সেটা হলো 'অমিতাব বচ্চন'। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন এই অমিতাভ বচ্চনের জন্য সম্মানিত হয়েছি শতাধিক জায়গায়। অনেক মাইক্রোবাসে ভাড়া নেয় নি কেবল এই অমিতাভের জন্যে। অনেক অপরিচিত মিশরি চোখে চোখ পড়লেই জিজ্ঞেস করবে: তায়রিফ অমিতাববচ্চন? অমিতাভ বচ্চন কে চেনো? যদি বলেন, হ্যা চিনি। সাথে সাথেই বলবে, দা হাবিবি। মানে সে আমার বন্ধু। আন্ডা বাচ্চা থেকে শুরু করে যুবক বৃদ্ধ সবারই প্রিয় পাত্র এবং সবারই বন্ধু এই অমিতাভ। অনেকে বিশ্বাস করতে না চাইলেও বাস্তবতা বলে যে: মিশরের শতকরা ১০০% মানুষই অমিতাভকে চিনে এবং সবাই মন থেকে তাকে ভালবাসে। মিশরে গ্রামান্চলে এমন মানুষ আছে যারা ইন্ডিয়া কি জানে না, এশিয়া ইউরোপের পার্থক্য জানে না যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয়: এশিয়া অঞ্চল থেকে একটা দেশ বা একটা মানুষের নাম বলো কিংবা অন্য কোন কিছুর নাম বলো, বলতে পারবে না। তাকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, অমিতাভ বচ্চন কে চেন? সে এক বাক্যে বলে দিবে: হাবিবি। আমার এই কথা গুলো কারো মুখে শুনে না, কোথা পড়ে জানা না, এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা
প্রশ্ন হতে পারে, আট হাজার মাইল দুরের এই নীল নদের দেশের মানুষের কাছে অমিতাভ কি করে এত ভালবাসার পাত্র হলো ?। উত্তরে আসবে অবশ্যই মুভি। কোন মুভির নামে অনেক মুভির নাম আসলেও যেটা প্রথমে আসবে সেটা হলো: 'আমর, আকবর, এ্যন্টনি'র কথা। আমি অনেকের কাছে এমনও শুনেছি যে, মিশরীর অনেক বাবা মা আছে যারা তার সন্তানদের আদর্শ শিক্ষা দিতে গিয়ে আমর আকবর এ্যান্থনি মুভির উপমা দিয়ে থাকে, আবার আদর্শ শিক্ষা দেয়ার জন্যে তার ছেলে মেয়েদের আমর আকবর মুভি দেখতেও অনেক সময় চাপ দেয়। এভাবে 'শোলে' 'মর্দ' 'কুলি' 'দিবার' 'শাক্তি' মুভিগুলিও সমান প্রিয় মিশরিয়দের মধএ। এই সব মুভির মাধ্যমেই মিশরীয়দের অন্তরে গেথে গেছে অমিতাভের নাম। তবে অমিতাভের ব্যাপারে একটা ভুল ধারনাও ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে আছে এই নীল সভ্যতার মানুষদের মাঝে। আর সেটা হলো; অমিতাভ বচ্চন মুসলমান। এখানের অধিকাংশ মানুষই জানে যে সে মুসলাম। আমরা যখন বলি যে সে মুসলমান নয় সে হিন্দু অনেকে আমাদের বলে তুমরা জান না। যাই হোক ধর্মগত কারনে নয় অমিতাভকে তারা মুভির কারনেই ভালবাসে। সেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখলাম আজ কায়রোর অপেরা হাউজে।
ভারত সরকার গত তিন বছর ধরে 'ইন্ডিয়া বাই দা নীল'(নীল নদ) নামে একটি কালচারাল প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। যারই ধারাবাহিকতায় এবার অমিতাভ বচ্চনকে শুভেচ্ছা দুত হিসেবে আনা হয়েছে। আজ কায়রোর দুটি স্থানে অমিতাভ বচ্চনকে দেশার সুযোগ করে দেয়া হয়। একটি কায়রোর বিখ্যাত অপেরা হাওজে অপরটি পিড়ামিডে।
এক মিশরীয় বন্ধুর বিশেষ অনুরুধক্রমে তার জন্য টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই বাধ্য হয়ে ঢুকে পড়ি অপেরা হাউজে। কায়রোর ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারের দেয়া একটি সৌজন্য টিকিট পেয়ে ঢুকে পরলাম অপেরা হাউজের মেইল হলে। অমিতাব বচ্চনকে দেখার আমার যতটা না ইচ্ছে ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ইচ্ছে ছিল অমিতাভকে পেয়ে মিশরীরা কেমন মাতামাতি করে সেটা দেখার।
অপেরা হাউজের মুল ফটকেই দেখা মিললো বিশাল জানজটের। কারন ঐ অমিতাভ বচ্চন। বচ্চন সাব কায়রোতে আসার তিন দিন আগে থেকেই টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সোসাল মিডিয়া সর্বত্রই হই হই রই রই ভাব। ব্যপক প্রচারণার ফলে মানুষের জমায়েত হয়েছে অনেক কিন্তু পুর্বে সংরক্ষিত টিকিট ছাড়া ভিতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অনেক সাংবাদিককেও দেখলাম ভিতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না তাই মন খারাপ করে বসে আছে। যাই হোক সন্ধা ৬ টায় সময় দেয়া থাকলেও এর আগে থেকেই সবাই হাজির। আসন সংখ্যা পুরন হয়ে গেছে ৬ টা বাজার আগেই। ৬ টায় অমিতাভের উপর ছোট একটি ডকোমেন্টরি দেখানো হলো। ৬ টা বিশ মিনিটের দিকে অমিতাভ বচ্চন স্টেজে আসলেন। আর শুরু হলো দর্শকদের গলা ফাটানো চিৎকার আর শিশ দেয়ার কান ফাটানো আওয়াজ। মিনিট পাঁচেক কেউ বসতেও পারলো না উত্তেজনার চোটে। অমিতাভও ঠায় দাড়িয়ে রইলেন। সবাই শান্ত হলে ছোট্ট এক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর শুরু হলো ইন্টারভিউ পর্ব। ভারতের বিখ্যাত প্রবিণ সাংবাদিক 'সিদ্ধার্ত ভাটিয়া' ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নিতে লাগলেন।
প্রথমেই উপস্থাপক বলে দিলেন যে, সাংবাদিকের করা প্রত্যেকটি প্রশ্ন ও কথা মিশরীয়দের প্রাণের কথা, তাদের মনের প্রশ্ন। অমিতাভবচ্চনের এই প্রোগ্রামকে সামনে রেখে অন লাইনে বিভিন্ন ইভেন্ট খোলে জিজ্ঞাস করা হয়েছে যে তুমি অমিতাভের কাছ থেকে কি জানতে চাও? উপস্থাপকের ভাষ্যমতে আমরা প্রায় ১ লক্ষ প্রশ্ন পেয়েছি যা থেকে খুব অল্প কয়েকটি প্রশ্নই আমরা করতে পারবো। এভাবে ৪০ মিনিটের মতো ইন্টারভিউ চলতে থাকলো। একপর্যায়ে অমিতাভকে বলা হলো আপনার পছন্দের কোন এক মুভির কোন এক ডায়লগ সবাইকে শুনাইতে। তখন আবার দর্শকদের মাঝে উত্তেজনা শুরু হয়। সবাই চিৎকার করে তার প্রিয় ডাইলগ শুনাতে অনুরুধ করতে থাকে। শেষে, 'কাভি কাভি মেরে দিল মে খেয়াল আতা হে' কবিতাটি আবৃতি করে শুানান। এবারও প্রায় দুই মিনিট মানুষের করতালি আর চিৎকারে ওপেরা হাওজ আনন্দে ভাষতে থাকে। আবার শুরু হয় ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ চলাকালিন সময়েই কয়েকবার থেমে যেতে হয়েছে শুধু মাত্র 'অমিতাভ আই লাভ ইয়ু'র শব্দে। কিছুক্ষন পরপরও এদিক সেদিক থেকে চিৎকার করে বলতে শুনা যাচ্ছে 'অমিতাভ আই লাভ ইয়ু'। সবচেয়ে মজার বিষয় হটাৎ সামনের ভিআইপি থেকে এক মেয়ে চিৎকার করে বলতে থাকলো: অমিতাভ, তু মেরা বাপ হে.... তু মেরা বাপ হে...
এভাবে ইন্টারভিউ পর্ব শেষ হলে স্টেজেই দাড়িয়ে কিছুক্ষণ শুভেচ্ছা বিনিময় করে ও কিছু অটোগ্রাফ দিলে। তারপর হাত নারতে নারতে চলে গেলেন অমিতাভ বচ্চন। মজার বিষয় হলো, এ সময় অনেকের কান্নার শব্দও শুনতে পাওয়া গেল। অনেকের চোখেও পানি দেখা গেলো। এই ঠেকে প্রমাণ করে যে তারা কেবল অমিতাভকে শিল্পি হিসেবে ভালবাসে না, অমিতাভ মানুষটাকেই তারা ভালবাসে। তাই তো অনেকে তাকে পিতা সমতুল্য মনে করে। অপেরা হাওজের মানুষের আবেগ দেখে মনে হলো: অমিতাভ বচ্চন এমন এক ব্যাক্তিত্য যার এক কথায় দুতি দেশ ছোট খাট যুদ্ধ থেকে সরে আসতে পারবে। তার কথায় জনগণ সেক্রিফাইস করতে পারবে অনেক কিছুই।
যাই হোক, অমিতাবচ্চন চলে গেলেন আর সবার মুখে বিজয়ের এক ছাপ পাওয়া গেল। অমিতাভবচ্চন কে নিজ চোখে দেখার স্বপ্ন সাকসেস করার বিজয়। যাইহোক, অমিতাভ বচ্চন বের হয়ে গেলে পর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ি স্টেজেই 'আমর আকবর এ্যান্থনি' মুভিটা দেখানো শুরু করলো।
'ইন্ডিয়া বাই দ্যা নীল' প্রোগ্রামের সুচি দেখলেই বুঝা যায় তারা কত বড় পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে। মিশরের বাজার ধরতে ইন্ডিয়া খুব উঠে পরে লেগেছে। শাহরুখ খানের সর্বশেষ মুভি 'চেন্নাই এক্সপ্রেস' ভারতের সাথে সাথে মিশরের তিনটি জেলায় ১২ টি হলে এক যোগে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। সামনে এই সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েই বাৎসরিক এই কালচারাল এক্সচেন্জ প্রোগ্রাম, সেটা বুঝতে খুব বেশি চিন্তা করতে হওয়ার কথা না।
তবে ইন্ডিয়া বাই দ্যা নীল কেবল মুভির মধ্যেই সিমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অর্থনীতির একটি ফুল প্যাকেজ। কায়রোতে 'মাওলানা আজাদ সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান কালচারে' ইয়োগা ক্লাশ চালু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এবার থেকে খোলা হচ্ছে নতুন কয়েকটি ইন্ডিয়ান ডান্স স্কুল। ১ তারিখ থেকে ৪ তারিখ পর্যন্ত আল আযাহার পার্কে চলবে 'ইন্ডিয়ান স্ট্রিট ফুড ফেস্টিভল'। এছাড়াও আরো থাকছে:
- Bollywood Dance Workshop
- Indian Street food festival
- Bollywood Extravaganza (A Tale of passion, Love & Revange)
- Words on Water (Preserving Cultures)
- World Music (Advaita)
- Wellbeing Experience
- Craft of Marketing
- Manipuri Folk Dance
এভাবে চলতে থাকবে ১৬ তারিখ পর্যন্ত। ভাবে মনেহচ্ছে বৃটিশরা যেভাবে আমাদের শাষন করতো ঠিক সেইভাবেই মিশরের কালচারাল দখল নিতে বদ্ধ পরিকর ভারত সরকার।