জেন্ডার ও আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট
লিখার শিরোনামটা যতটা খটখটে বিষয়টি কিন্তু ততটা খটখটে নয়। কারন "জেন্ডার" শব্দটা শুনলেই সবাই যেন কেমন কটমট চোখে তাকায়। যেন মনে করে এই বুঝি নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত কিছু উগ্র মহিলা স্বামী সংসার ছেড়ে রুগ্ন কিছু মহিলাকে ব্যানারের সামনে দাঁড় করিয়ে নতুন কোন ফন্দি আটছে। ভাই-বোনেরা একটু দম নেন। আসুন জেনে নেই জেন্ডার বিষয়ক কিছু বেসিক টার্ম।
জেন্ডার কি এবং কেন?
"Gender refers to the socio-cultural definition of man and woman; the way societies distinguish men and women and assign them social roles". সহজভাবে বলা যায়, জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গডে ওঠা নারী-পুরুষের পরিচয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক, সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত নারী-পুরুষের ভূমিকা, যা পরিবর্তনশীল এবং সমাজ, সংস্কৃতি, স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ জেন্ডার মানেই কিন্তু নারী অধিকার নিয়ে চিৎকার নয়। সমাজে যাতে চির-বিপরীত দু'টি চরিত্র সহঅবস্থানে, সুন্দরভাবে, সন্মানীতভাবে বাস করতে পারে তার ধারনা দেয় মাত্র।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান যেহেতু অনেক অনেক দূরে তাই জেন্ডার শব্দটার কিছুটা সুবিধাভোগী কিন্তু মেয়েরা। তাই বলে পুরুষের দু:খ পাওয়ার ও আবশ্যকতা নেই কারন জেন্ডার রাতারাতি মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে ও স্বীকৃতি দেয় না। শুধুমাত্র সহঅবস্থানে, সুন্দরভাবে পরিবেশের প্রতি জোর দেয়।
বাস্তবতা ও আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট !
৫০ ভাগ নারী শিশুর এ হতদরিদ্র দেশে যেখানে অর্ধেক পরিবারেরই প্রধান সংগ্রাম দৈনিক খাদ্য জোগাড় সেখানে জেন্ডার শব্দটা সত্যিই বিলাসিতা। তারপরও এ বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা আছে কারন শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার মাঝে যখন এটি ছড়িয়ে পড়বে তখন নিজের অজান্তেই একটা সচেতনতা বাড়বে সমাজে। আর এ সচেতনতাটাই পারবে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে, মেয়ে শিশুদের সত্যিকারের শৈশব গড়তে।
আর সত্যিকারের এ সচেতনটা কিন্তু তৈরী হতে হবে পরিবার থেকেই। তারপর তা ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। যেমন, আমার পরিবারে যখন দেখবো আমার মা'কে সন্মান করছে আমার বাবা সহ পুরো পরিবার, পরিবারের যেকোন বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাঁর মতামতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাহলে সন্তানরা ও সেভাবে মা'কে সন্মান করতে শিখবে, মা'কে সমানভাবে গুরুত্ব দিবে। একটা সামাজিক ভারসাম্য তৈরী হবে, পরবর্তীতে সে সন্তানরা তাদের সন্তানদেরও একই শিক্ষা দিবে। পরিবারের কন্যা সদস্যদের সন্মান না করে বা মূল্যায়ন না করে কি কোন পরিবার ভালো থাকেতে পারবে? না পারবে না, পারতে পারে না।
মেয়ে শিশু ও জেন্ডার বৈষম্য:
সত্যিকারে এখন সামাজিক পেক্ষাপটে মেয়ে শিশুরা একটা ভালো অবস্থানে আছে। কারন রাস্ট্র যেমন তাদের ফ্রি শিক্ষার সুযোগ দিয়ে সমাজে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরীতে সাহায্য করেছে তেমনি অনেক এনজিও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র ও সমাজে আছে। এখনো সমাজে মেয়েরা অবহেলা বা বৈষম্যর স্বীকার প্রতিটি ক্ষেত্রে, কি পরিবারে, কি রাস্তা-ঘাটে, কি স্কুল আদালতে, কি অফিসে। প্রতিদিনের দৈনিক প্রত্রিকা খুললেই অসংখ্য নারী নির্যাতনের খবর চোখে পড়ে।
কিছুদিন আগে টিভি জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব আব্দুর নুর তুষার তাঁর এক লিখায় এক ষাটোর্ধ রোগীর গল্প বলছিলেন যেখানে রোগীটি ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধরত। তাঁকে ডাক্তার এক পর্যায়ে জিঙ্গাসা করছিল কিছু খেতে মন চায় কিনা। উত্তরে রোগীটি বলেছিল, "বাবা, দুঙ্গা ভাত মুরগীর ঝোল দিয়ে খাইতে চাই, সেই ছোডকালে খা্ইছিলাম মা'য়ের কাছে আর খাইনি এতো বছরে"। কৈাতুহলী ডাক্তার জানতে চাইলো কেন স্বামীর বাড়িতে খাননি? বৃদ্ধার উত্তর, "না বাবা, বাড়ির ছেলেরা খাওনের পর তো আমাগো বউ ঝিদের কিছুই ঝুটতো না"।
হাঁ, আমাদের এ অভাগা দেশে সমাজ মেয়েদের সবচেয়ে অবহেলিত প্রাণিই মনে করে। আর বিপরীতে বাড়ির বউ ঝিরা দিনের পর দিন অর্ধ পেটে অভুক্ত থেকে পরিবারের ছেলেদের খাইয়ে গেছেন। এতে মেয়েরা দু:খিত? উত্তরটা হলো, "না", মেয়েরা পরিবারের ছেলেদের খাইয়েই খুশি। তাহলে পরিবারের ছেলে সদস্যারা কি একবার ও ভেবেছে আজ ভালো খাবারটা আমি না খেয়ে আমার মা কিংবা বউ খেয়ে নিক। না ভাবেনি কারন তারা ভেবে নিয়েছে এটাই তাদের প্রাপ্য, এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়মটা কে বানিয়েছে? উত্তর মেয়েরা, কারন মেয়েরা ভালোবাসা থেকে এ নিয়ম বানিয়েছে আর তার বিনিময়ে কি কিছু পেয়েছে। না পায়নি, কারন সমাজ তাকে বলেছে পরিবারের সেক্রিফাইসটা মেয়েরাই করে, সন্তান পালন মেয়েরাই করবে, আয় বা সম্পদ সবই হবে পুরুষদের করায়ত্ব, পরিবারে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটি একমাত্র পুরুষ সদস্যদের, কষ্ঠ মেয়েরাই ভোগ করে, মেয়েদের চাকরী করা বা ছাড়ার সিদ্দান্তটি ও একান্তই পুরুষ সদস্যের। তাইতো জেন্ডার শব্দটি এসেছে, মেয়েদের ও যে কিছু পাওয়ার আছে তাই, মেয়েদের প্রতি বৈষম্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার জন্য, মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
রাষ্ট্র ও জেন্ডার !
১৯৭৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক সনদ বা কনভেনশন। ইংরেজীতে একে বলে, "CEDAW (Convention of the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women)"। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ই নভেম্বর সিডও কে অনুমোদন করে স্বাক্ষর করে। যা একটি মাইলফলক এবং এরপর থেকে মূলত নারীর প্রতি বৈষম্য বিষয়টি সামনে আসে ও প্রতিকার নিয়ে রাষ্ট্র ও এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে দাতা ও বিভিন্ন সংস্থা, উইমেন্স ও জেন্ডার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যা।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট কিছু করণীয় !
বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী বিষয়ে অনেক বেশী সচেতন পরিবার তথা সমাজ। বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজ এখন মেয়ে সন্তানকে আশীর্বাদ হিসেবেই দেখে। কিন্তু সমাজের রুটে বা একেবারে সমাজের মূল স্রোতে এখনো এ সমস্যা রয়ে গেছে যার কারনে ইভ টিজিং, পারিবারিক ভায়োলেন্স বা চাকরী ক্ষেত্রে বৈষ্যম্য দেখা যায়।
এ সমস্যা কোনক্রমেই রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়। আগেই বলেছি পরিবারই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে; যেমন আমার ছেলে সন্তানটি যখন কোন মেয়েকে টিজ করবে তখন প্রথম শাসনটা আমার কাছ থেকেই আসতে হবে এবং তারপর সমাজ বা রাস্ট্র তার ভার নিবে। আর আমি যদি অন্ধের মতো এক পাক্ষিক হই তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু বাড়তেই থাকবে।
তারপর এগিয়ে আসতে হবে সমাজকে। একটি মেয়েকে সন্মান দিলে সমাজপতির সন্মান বাড়বে বৈ কমবে না এ সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আবারো উদাহরন দেই, পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় গ্রামে প্রায় সালিশের ঘটনা ঘটে কিন্তু সে বিচার হয় এক পাক্ষিক। সেখানে মেয়েদের কিছুই বলতে দেয়া হয় না্। এতে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ে। সঠিক বিচার না হবার কারনে যে অপরাধী সে ছোট থেকে বড় আপরাধে জড়িয়ে পড়ে আর সমাজ হয়ে পড়ে ভারসাম্যহীন।
সবার শেষে বলবো রাস্ট্র এগিয়ে আসতে হবে সর্বোতভাবে। কারন রাস্ট্রের পৃষ্ঠপোসকতা ছাড়া কোন বৈষম্যই দূরীকরণ সম্ভব নয়। উপযুক্ত আইন, কঠোর তার প্রয়োগ ও ব্যাপক প্রচারই পারে নারীর প্রতি বৈষম্য, সর্বোপরি সহিংসতা কমাতে। একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই মেয়েরা তার প্রাপ্য সন্মান পেলে তার সুবিধা মেয়েটি একলা ভোগ করবে না এ সুবিধা ভোগ করবে পুরো সমাজ বা জাতি।
তাই আসুন, সবাই নারীর প্রতি বৈষম্য বন্ধে এক হই, তাহলেই এ সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে ও জেন্ডার সাম্যতা আসবে এবং সমাজ হবে সুন্দর, রাস্ট্র হবে সার্থক।
সোহানী
এপ্রিল, ২০১৫
http://www.somewhereinblog.net/blog/belablog
সূত্র সমূহ:
১) সিডও এবং বাংলাদেশ- বেলা নবী ও শাহীন রহমান (প্রকাশক: স্টেপস্ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট, প্রকাশ:১৯৯৬)
২) Understanding Gender by Kamla Bhasin (Publisher: Pauls Press, 2000)
৩) জেন্ডার পলিসি- কেয়ার বাংলাদেশ
৪) জেন্ডার ও সমতার অভিমুখে- আইসিডিডিআরবি
৫)নারীবাদ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন এবং দক্ষিন এশিয়ায় এর প্রাসঙ্গিকতা - কমলা ভাসিন ও নিঘাত সাঈদ খান (প্রকাশক: প্রশিকা, প্রকাশ:২০০২)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৫৮