somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন প্রসঙ্গে: বিষয়টি লজ্জার, কথাগুলো অপমানের, লড়াইয়ের প্রয়োজন এখানেই - বেলায়াত হোসেন মামুন

০৫ ই মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কৈফিয়ত

চলচ্চিত্র মাধ্যমকে গুরুত্বের সাথে যখন থেকে জানতে চেয়েছি তখন থেকেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি বাস্তবতা বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। কেন? কারণ বাংলাদেশে আজ থেকে ৪০ বছর আগে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জানা-বোঝার জন্য চলচ্চিত্র সংসদ ছাড়া আর কোনো রাস্তাই ছিল না। এই সত্যটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। বাংলাদেশে ৫০ বছরের অধিককাল ধরে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে অথচ এখানে কোনো ‘ফিল্ম ইন্সটিটিউট’ গড়ে তোলা হয় নি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র চর্চার জন্য কোনো ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ গড়ে তোলার প্রয়োজন বোধ করছেন না আমাদের সরকার বাহাদুররা। আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বে যখন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীরা বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও সংরণশালা বা ‘ফিল্ম আর্কাইভ’ গড়ে তোলার দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরতে থাকেন তখন সরকারের আমলা ও তৎকালীন মতাসীন সরকারের লোকজন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ফিল্ম আর্কাইভ আবার কী জিনিস; এটা খায় না মাথায় দেয়’? যখন চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা সৃজনশীল ও জীবনমুখি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে চলচ্চিত্রে অনুদানের দাবি তুলে ধরছিল তখনও আমলা ও মতাসীন সরকারের লোকজন বলেছেন, ‘বারে! সরকার কেন ছবি বানাতে পয়সা দেবে? তোমরা ছবি বানাবা তোমাদের পয়সায়, ব্যবসা করবা-লাভ করবা সব তোমাদের ব্যাপার, সরকারকে ট্যাক্স ঠিকমত দিচ্ছ কী না আমরা শুধু তাই দেখব’।

এইসব তো আমাদেরই ইতিহাস। এই রকম পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র সংসদ ১৯৬৩ সাল থেকে আন্দোলন করে করে আজ ২০১১ সালে এসেছে। অর্জন যেমন অনেক, ব্যর্থতাও তো কম নয়। কিন্তু যেকোনো আন্দোলনের মতই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনও অগ্রগামীতার লড়াইয়ে-সংগ্রামে সব সময় হাজির থেকেছে। এই আন্দোলন কারা করেছেন? কোন মানুষগুলো সংসদ আন্দোলনের আদর্শিক ও নৈতিক লড়াইয়ের চেতনাকে ধারন করেন, বহন করেন। আন্দোলনতো হাওয়া থেকে পয়দা হয় না। যে কোনো আন্দোলনেরই ধারক থাকেন যাদের ছাড়া সে আন্দোলনকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কথা মনে আসলেই মুহূর্তে মনে আসে কিছু সংগঠন, কিছু ব্যক্তি এবং কয়েকটি বিশেষ চলচ্চিত্রের নাম যা সংসদ আন্দোলনের মর্যাদা, গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তির নামগুলো যেমন অনুপ্রেরণার ঠিক তেমনি তা নতুন সংসদকর্মীদের জন্য আদর্শিক ও নৈতিক লড়াইয়ের পাটাতনের শক্তির ইঙ্গিতও দেয়। যা লড়াইয়ে উদ্ধুদ্ধ করে প্রত্যেক নতুনকে; যে এখনো বিশ্বাস করে লড়াই ছাড়া মুক্তি নেই। আছে দাসত্ব, আছে গোলামী, তা হতে পারে ব্যক্তির, হতে পারে প্রতিষ্ঠানের, হতে পারে রাজনৈতিক অথবা সামরিক স্বৈরশাসনের।

তাই চলচ্চিত্র সংসদ মানে, ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি’ বা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ। চলচ্চিত্র সংসদ মানে, মুহম্মদ খসরু, আলমগীর কবির, মাহবুব জামিল, লায়লা সামাদ, বাদল রহমান, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, মাহবুব আলম. কাইজার চৌধুরী, মসিহ উদ্দিন শাকের, আনোয়ার হোসেন।

চলচ্চিত্র সংসদ মানে, চিপাচস, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ, চলচ্চিত্রম চলচ্চিত্র সংসদ, জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ, ঋত্বিক ফিল্ম সোসাইটি, রণেশ দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদ। চলচ্চিত্র সংসদের কর্মী মানে, মানজারে হাসীন মুরাদ, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, সুশীল সূত্রধর, শামীম আখতার, মোরশেদুল ইসলাম, মাহমুদুল হোসেন দুলাল, আনোয়ার হোসেন পিন্টু, আহমেদ মুজতবা জামাল, শৈবাল চৌধুরী, সাব্বির চৌধুরী, মুনীরা মোরশেদ মুন্নী।

এরপরের প্রজন্মের চলচ্চিত্র সংসদ মানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা চলচ্চিত্র সভা, জাহাঙ্গীরনগর স্টুডেন্টস ফিল্ম সোসাইটি। এই প্রজন্মের সংসদকর্মী মানে, ডা. জহিরুল ইসলাম কচি, জাহিদুল ইসলাম, বিপ্লব মোস্তাফিজ, ফাখরুল আরেফিন, রোদেলা নিরূপমা।

এরপর নতুন শতকের চলচ্চিত্র সংসদ মানে তো, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি, চোখ ফিল্ম সোসাইটি, খুলনা ফিল্ম সোসাইটি।

আমার জানামতে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও ব্যক্তিগুলো তো এরাই। আবার, এর মাঝে নাম উল্লেখ করিনি এমন অনেক চলচ্চিত্র সংসদ আছে যারা কর্মকান্ডের ব্যাপকতায় এক সময়ের গতিশীল চলচ্চিত্র সংসদ ছিল কিন্তু এখন নিষ্ক্রিয়। এমন অনেক অনেক অগ্রজ সহযোদ্ধার নাম এখানে উল্লেখ করিনি যারা তাদের সর্বোচ্চ শ্রম, মেধা ও ত্যাগ দিয়ে এই আন্দোলনের চাকাকে গতিশীল রেখেছেন।

চলচ্চিত্র সংসদ মানে যে সংগঠন ও মানুষগুলোকে আমরা আলাদাভাবে স্মরণ করছি তাদের বাহিরে এমন কিছু সংগঠন ও ব্যক্তির নাম কেউ যদি উল্লেখ করে ‘চলচ্চিত্র সংসদে’র নাম ব্যবহার করতে চায় তাহলে তাকে কী বলা যায়?

স¤প্রতি কিছু ঘটনায় দেখেছি বাংলা এবং ইংরেজী শব্দ ভান্ডারে আছে এমন শব্দরাশি দিয়ে যতখুশি ‘চলচ্চিত্র সংসদ’ ও ‘ফিল্ম সোসাইটি’ বানিয়ে একদল লোক চলচ্চিত্র সংসদ বা ফিল্ম সোসাইটির নামে যথেচ্ছ নোংরামী করে যাচ্ছে।

চলচ্চিত্র সংসদের বিগত ৪৭ বছরের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ও ব্যক্তি মানুষগুলো ছাড়া অন্য কারো এই আন্দোলনের নাম ব্যবহার করে যা খুশি তা করার যেকোনো চেষ্টাকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

যাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে তাদের ‘শয়তানের মোর্চা’র মধ্যে আছে ভ্রষ্ট সংসদকর্মী, নষ্ট সাংবাদিক এবং সুবিধাবাদী আমলা। এই মোর্চার নতুন সংযোজন চলচ্চিত্র ব্যবসায় আসা দেশীয় চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং তার বহুজাতিক পণ্য-সামগ্রীর বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান। তাই লড়াইয়ের প্রয়োজনেই জানা জরুরী এরা কারা?



মুঠোফোনের দুনিয়ায় ঘুমানো হারাম

২৩ ফেব্র“য়ারি, ২০১১ সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই মুঠোফোন বেজে উঠেছে। প্রথম ফোন কলটি পেয়েছি সিলেট থেকে। ফোন ধরা মাত্রই ওপাশ থেকে জানতে চাইল, ‘ভাইয়া, ফেডারেশনের কমিটি করা হয়েছে, জানতেও তো পারলাম না। আর কমিটিতে যারা এসেছেন তাদের কাউকেই তো চিনি না’! আমি প্রথমত হকচকিয়ে গেলাম। বললাম, ফেডারেশনের কমিটি মানে? কমিটি তো যা ছিল তাই আছে। আর রাতারাতি কমিটি বদলের-তো কোনো কারণ নেই। ফেডারেশন-তো রাষ্ট্র নয়, যে যখন-তখন সেনাবাহিনী ক্যু করে রাতারাতি সরকার বদলে ফেলবে। ওপাশ থেকে বলল, আপনি পত্রিকা দেখেন। আমি বললাম, ‘কোন পত্রিকা’? ওপাশ থেকে বলল, ‘কালের কণ্ঠ’। আমি জানতে চাইলাম, ‘সে না হয় দেখব, কিন্তু ঘটনা কী’? ওপাশ থেকে জানাল, ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ-এর নতুন কমিটি হয়েছে, সভাপতি হাবিবুর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শিহাব সিরাজী। সহ-সভাপতি গিয়াসউদ্দিন সেলিম, ও শংকর রায়’। আরো অনেকেই আছে যাদের কাউকে চিনতে পারছেন না ফোনকল-দাতা।

আমি তাকে বললাম, ‘আমি বুঝলাম। কিন্তু আপনি তো ভুল বুঝেছেন। ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজে’র কমিটি হতেই পারে। তাতে আমাদের তো কিছু করার নেই। আমাদের জানারও কথা নয়। কেননা, আমরা যে ফেডারেশনের সাথে যুক্ত তার নাম ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ’। বাংলাদেশে এই নামে যে ফেডারেটিভ বডি আছে তার সাথে আপনি যেমন যুক্ত, আমিও যুক্ত। এই নামের সংগঠনটির কিছু হলে আমরা জানতে পারব, এর বাইরে কে, কোথায়, কী করছে তা তো না জানালে জানার কোনো উপায় নাই’।

ওপাশ থেকে বলল, ‘আমিও বুঝলাম, কিন্তু এসব কেন হচ্ছে তা তো বুঝতে পারছি না। দুর্বল চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নিয়ে এত কেন তোড়জোড়? হাবিব খান, গিয়াসউদ্দিন সেলিমদের মতো ব্যস্ত মানুষদের ফিল্ম সোসাইটির ফেডারেশনের কর্তা হওয়ার ইচ্ছা জাগল কেন? আমি তাকে বললাম, প্রশ্ন বটে!

যা হোক এই দিন দেশের আরও কিছু বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ-সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আমাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানতে চেয়েছে। আমি তাদের প্রশ্নের উত্তরে যে কথাগুলো বলেছি তার কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। তার আগে প্রথম ফোনকলটির কর্তার পরিচয় জানিয়ে রাখি, তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ ‘চোখ’ এর একজন কর্মী। এই কর্মীর শেষ প্রশ্নটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কেন হাবিব খানের মতো একজন চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ীর চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার ‘খায়েশ’ মেটে না।

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে...

২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন একটি বিশেষ জায়গায় এসে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তা হল নতুন শতকের অভাবিত প্রাযুক্তিক বিকাশের কালে, ব্যক্তিতন্ত্র, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বহুজাতিক পণ্যায়নের ডামাঢোল, সর্বগ্রাসী টিভি সংস্কৃতি যখন দেশের সকল ধরনের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলনকে বানের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যখন সাহিত্য, নাট্য এবং সংগীতের েেত্র আর আন্দোলনের ‘আ’ টুকুও শোনা যায় না, যখন প্রায় সকল সংস্কৃতিকর্মীর আরাধ্য টেলিভিশনের ‘চাঙ্ক’ অথবা একটি চাকরি অথবা বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিজ্ঞাপন নির্মাণের ঠিকাদারি অথবা নিদেনপে টিভি নাটক বানানোর একটি সুযোগ, তখন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন কোন পথে এগোবে? সে কি তার পুরনো ধারায় কাজ করে যাবে? নাকি কাজের ধরন ও ভঙ্গি বদলাবে?

২০১১ সালে এসে বলতে পারি, প্রশ্নগুলো কঠিন ছিল, উত্তরও সহজ ছিল না। তখন দেশে একটিই ‘ফেডারেশন’ ছিল। এবং দিন দিন চলচ্চিত্র সংসদগুলো কোনো নতুন কর্মপন্থা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছিল। আন্দোলনের এই যুগসন্ধিণে এই আন্দোলন নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।

ইতোমধ্যে (২০০১-০২ সাল) দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে এবং চারদলীয় জোট সরকার তার সরকার গঠন করেছে রাজাকার, আলবদরদের সাথে নিয়ে। তখন ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পুরোধা মুহম্মদ খসরু এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বিপ্লব। সে সময় চলচ্চিত্রে-অশ্লীলতা বিরোধী আন্দোলনে দেশের মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। ফেডারেশন থেকে জনমত গঠনের জন্য নানারকম কর্মসূচি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এই সকল কিছুর অভ্যন্তরে আরেক কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম রাব্বানী বিপ্লব চারদলীয় জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্যে তৎকালিন সরকারের সাথে কথাবার্তা চালাতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ফেডারেশনের তৎকালিন সভাপতি মুহম্মদ খসরু-এ ধরনের চেষ্টা থেকে গোলাম রাব্বানীকে বিরত থাকার কথা জানিয়ে দেন। কিন্তু ফেডারেশনের সভাপতির নির্দেশ পালন না করে সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী উৎসবের যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে ১৫ অক্টোবর ২০০২ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ফেডারেশনের সভাপতি মুহম্মদ খসরু দেশের চলচ্চিত্র সংসদসমূহের প্রতিনিধিদের এক সভা আহবান করেন। আহবানপত্রে তিনি উল্লেখ করেন,

‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের ল্েয বিগত চল্লিশ বছর যাবত চলচ্চিত্র সংসদসমূহ অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চলচ্চিত্র সংসদসমূহ নিজস্ব নীতি ও আদর্শ সমুন্নত রেখেছে। ইদানিং চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের যাত্রাকাল থেকে যে জনশ্রদ্ধা ও সুনাম অর্জন করেছে তা ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। এ প্রবণতা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মূল আদর্শ ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। আর এ-জন্য চলচ্চিত্র সংসদসমূহের সমন্বিত সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ’-এর নাম ব্যবহারের চেষ্টা চলছে’।

উক্ত সভায় দেশের সক্রিয় প্রায় সকল চলচ্চিত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এবং তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন, ‘রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী-অধ্যুষিত জোট সরকারের সাথে ফেডারেশনের নামে কোনো ধরনের উৎসব করা যাবেনা’।

এই সভার অল্প কিছুদিন পরেই ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজে’র নামে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির নাম ঘোষনা করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা মোফাজ্জল করিম। উৎসবের অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর সভাপতি ওয়াসিমুল বারী রাজীব। উৎসবে সিনেমা হলগুলোতে হিন্দি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ব্যাপক প্রদর্শনী করা হয়। সরকার ও এফডিসির সহযোগিতায় প্রায় কোটি টাকার এ উৎসব ১৮ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে সম্পন্ন হয়। বলা বাহুল্য যে, এই উৎসবে দেশের অধিকাংশ সক্রিয় চলচ্চিত্র সংসদ অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু যেখানে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী চারদলীয় জোট সরকারের ‘ইমেজ কিনিং’ ফ্যাক্টর যুক্ত সেখানে ‘প্যাড’ আর ‘নাম’-সর্বস্ব রাতারাতি গজিয়ে তোলা চলচ্চিত্র সংসদ দিয়ে এই উৎসব সম্পন্ন করায় কোনো কিছুই আটকে ছিল না। উৎসবের পূর্বেই ফেডারেশনের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন মনপছন্দ কমিটি করেছিল গোলাম রাব্বানী এন্ড গং। গোলাম রাব্বানীদের কমিটি নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন সাবেক আমলা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক উপদেষ্টা সুজাউদ্দিন আহমেদ। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে বিএনপি’র সাথে সংশ্লিষ্ট আমলাদের ‘পাশা’ খেলার প্রিয় বিষয়ে পরিনত হয় চলচ্চিত্র সংসদ।

নষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান, ভ্রষ্ট সংসদকর্মী গোলাম রাব্বানী এন্ড গং, সুবিধাবাদী আমলা মোফাজ্জল করিম ও সুজাউদ্দিন আহমেদের খপ্পরে পড়ে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন তার আদর্শিক ও নৈতিকভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়ে। চারদলীয় ঐক্যজোট সরকার কিছু ভ্রষ্ট সংসদকর্মীর সহায়তায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে তার ‘সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট’-এ পরিণত করার প্রয়াস নেয়। যা গোলাম রাব্বানী, মোফাজ্জল করিম, সুজাউদ্দিন, ওয়াসিমুল বারী রাজিব গংদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে পরবর্তীতে প্রকট হয়ে উঠে। চারদলীয় জোট সরকারের আশ্রয়ে তারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের নীতি, আদর্শ ও নৈতিকতার সকল কিছুকেই পদদলিত করে নিজেদের খেয়ালখুশি ও স্বার্থ চরিতার্থ করেছে। এ পর্যন্ত গোলাম রাব্বানী এন্ড গং তিনটি চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করতে সমর্থ হয়েছে। তিনটিই তারা করেছে বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকারের ছত্রছায়ায়। এরপরে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়ে তারা তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছে না। ফলে আর কোনো উৎসবও এখন পর্যন্ত তারা করতে পারেনি।

উল্টোস্রোতের পথিকবৃন্দ

গোলাম রাব্বানী এবং তার চ্যালা-চামুণ্ডারা যখন চারদলীয় জোট সরকারের মণ্ডা-মিঠাই খাওয়ার উৎসবে ‘হৈ-হৈ-রৈ-রৈ’ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তখন প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন মানুষ। মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন কে? সে কথায় না গিয়ে বলতে পারি ঐ প্রতিকূল সময়ে তাঁরা যা করেছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। প্রথমেই বলব মুহম্মদ খসরু’র কথা। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ ও গোলামদের ‘খারিজ’ করে দিয়েই রণকান্ত সেনানায়কের মত চলে গেলেন ঘরে, যখন মাঠে থেকে লড়াই করে যাওয়াই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় বিপ্লব মোস্তাফিজ পালন করেছেন একটি সাহসিক ভূমিকা। কোনো কোনো সময় এভাবেই হয়তো একজন দুইজন মানুষ সময়ের সাহসী মানুষে পরিণত হয়। গোলাম রাব্বানীদের বানানো তাঁবেদার ফেডারেশনের বিপরীতে অগ্রজ সংসদকর্মী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা মোরশেদুল ইসলামকে সভাপতি ও ডা. জহিরুল ইসলাম কচিকে সাধারণ সম্পাদক করে দেশের সক্রিয় চলচ্চিত্র সংসদগুলো গড়ে তোলে পাল্টা ‘ফেডারেশন’। ২০০৩ সাল থেকে জোট সরকারের সকল হুমকি-ধমকি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মোরশেদুল ইসলাম, সুশীল সূত্রধর, সাব্বির চৌধুরী, ডা. জহিরুল ইসলাম কচি, বিপ্লব মোস্তাফিজ, ফাখরুল আরেফিন, জাহিদুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন হাওলাদারসহ সে সময়ের সংসদকর্মীরা জারি রাখেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সৎ ও স্বাধীন ধারা। একই সাথে দলীয় লেজুড়বৃত্তির গোলামির দালালরা তাদের মতো করেই সে সময়ের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল। একই নাম ও লোগো নিয়ে মোরশেদুল ইসলাম ও ডা. জহিরুল ইসলাম কচি, বিপ্লব মোস্তাফিজদের লড়তে হয়েছে চলচ্চিত্রের আদার ব্যাপারি হাবিবুর রহমান খান ও গোলাম রাব্বানী বিপ্লবদের সাথে। সংগঠনের নাম তখনও একটিই- ‘বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ’।

(পর্ব ১। মোট চার পর্বে লেখাটি শেষ হবে।)


পরবর্তী লেখায় থাকবে,
ক. সোনার বাংলায় ‘অস্কার’ আবিষ্কার !
খ. আন্দোলনের সূত্রে ফেরা
গ. দুইটি ফেডারেশন নামে- কী কারণে
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১১ বিকাল ৩:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×