somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেদ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাচীন ভারত

ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো অতুলনীয়। আজ থেকে দু কি তিন হাজার বছর আগেও তো ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র অমলিন ছিল না। বরং আরও সমুজ্জ্বল থাকারই সম্ভাবনা। তখন তো কলকারখানা ছিল না। আকাশ ছিল নীলাভ ও নির্মল। মেঘেরাও। সে সময়ে শীতকালেও খুব বৃষ্টি হত নাকি।
মনে হয়, ভারতবর্ষের প্রাচীন মানুষেরা প্রাকৃতিক শক্তি বা সৌন্দর্য দেখে নিশ্চয়ই অভিভূত হয়েছিল ।
আর ঋষিরা?
ঋষিরা যেহেতু ব্যাতিক্রমী হৃদয়ের অধিকারী, কাজেই তারা সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ বা ভীত হয়ে গিয়ে রচনা করলেন মন্ত্র: যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়, স্তোত্র বা সূক্ত। কাজেই প্রাচীন ভারতের ঋষিরা, সর্বমোট যে ২০,৩৭৯ টি সূক্ত রচনা করেছিলেন তারই সংকলনকে বলা হয় বেদ। কেননা বেদ-এ রয়েছে সর্বমোট ২০,৩৭৯টি মন্ত্র বা ঋক।
প্রাচীন ভারতকে বলা হয় বৈদিক ভারত। ওই বৈদিক কথাটা এসেছে বেদ থেকেই। বৈদিক সমাজে দারুণ প্রভাব ছিল গ্রন্থটির।
সহস্র মন্ত্রের সমষ্টি বলেই বেদ অনির্বায ভাবেই ধর্মীয় গ্রন্থ । প্রাচীন ভারতেই গ্রন্থটি রচিত ও সঙ্কলিত হয়েছিল আজ থেকে ৩ বা সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে; গবেষকরা এমনই মনে করেন।
দীর্ঘকাল বেদ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পরে বেদ সঙ্কলন করলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ইঁনিই রচেছিলেন মহাভারত।
বেদ-এর ভাষা আদি সংস্কৃত। সাধারন মানুষ তো দূরের কথা; অতি শিক্ষিত পন্ডিতেও টীকাভাষ্য বাদে বেদ বোঝে না। সবচে ভালো টীকা নাকি লিখেছেন সায়নাচার্য। জানি না। আমি বেদজ্ঞ নই। তবে বেদ বোঝার জন্য টীকাভাষ্যের দরকার হয়। কেননা, বৈদিক যুগে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ হত। যেমন: “গো” শব্দের অর্থ হতে পারত জল রশ্মি বাক্য পৃথিবী গরু।
মনে করা হয় যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগে আর্যরা পারস্য হয়ে প্রাচীন ভারতে এসেছিল প্রাচীন । তার আগেই প্রাচীন ভারতে হরপ্পা ও মহেনজোদারো সভ্যতা প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে পৌঁছেছিল। তো, আর্যরা প্রথমে ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে; আরও পরে তারা পূবের গাঙ্গেয় অববাহিকা অবধি পৌঁছেছিল।
এভাবেই সূচিত হয়েছিল বৈদিক যুগের।
বৈদিক ঋষিরা বেদ লিখেছিল ভোজ নামে এক ধরনের গাছের পাতার ওপর। এই ভূর্জপত্র বা ভোজ পাতাই হল প্রাচীন ভারতের প্যাপিরাস।
সেই বৈদিক যুগেই গড়ে উঠেছিল বেদ-এর কনসেপ্ট।
তো বেদের কনসেপ্ট বা বিষয় কি?
বেদের কনসেপ্ট বা বিষয় হল দেবতা ও যজ্ঞ।
দেবতা কি তা জানি। কিন্তু, যজ্ঞ কি?
দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগই যজ্ঞ।
বৈদিক যজ্ঞে নাকি রাশি রাশি কাঠ, মন মন ঘি পুড়ত। শত শত ছাগ, শত শত ষাঁর রীতিমতো বলি হয়ে যেত।
বেদে নানা দেবতার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন, অগ্নি ছিলেন বেদ-এর একজন প্রধান দেবতা।অন্য দেবতারা হলেন: বায়ূ জল সূর্য উষা পৃথিবী আকাশ।
আগেই বলেছি, বৈদিক ঋষিরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে রচনা করেছিলে স্তোত্র বা সূক্ত বা মন্ত্র। তো, তখনকার সমাজে লোকে বিশ্বাস ছিল যে বিশেষ উপায়ে এসব দেবদের ভজনা করলে সুখশান্তি মেলে; বিপদ ধারেকাছেও ঘেঁষে না, উপরোন্ত ধনবৃদ্ধি হয়। কী করে দেবদের ভজনা করা যায় সে পথ দেখাত বেদ। কাজেই বেদ ছিল বেস্ট সেলার। তবে গ্রন্থটি সবাই পাঠ করতে পারত না। কেবল ব্রাহ্মণরাই এটি পড়তে পারত ব্যাখ্যা করতে পারত; অন্যরা নয়। বৈদিক সমাজে তখন বর্ণপ্রথা ছিল।
বৈদিক সমাজে সবচে নিচে ছিল শূদ্ররা। এরা আসলে ছিল আর্য-পূর্ব ভারতের অধিবাসী। আর্যরা এদের পরাজিত করে দাসে রুপান্তরিত করেছিল। শূদ্ররা বেদ শ্রবণ করলে বা শুনলে নাকি ওদের কানে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হত!
তো বেদ কিন্তু একটি গ্রন্থ নয়। বেদ চারটি। যথা:ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। বেদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্রচীনতম। এর অধিকাংশ সূক্তেই বিভিন্ন দেবতার বর্ণনা ও প্রশস্তি লিপিবদ্ধ আছে। যজুর্বেদ গদ্যে লেখা এবং এটি দুভাগে বিভক্ত। শুল্ক ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ; এতে নানা কাহিনী রয়েছে। যেমন গুরু বৈশম্পায়ণ ও শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যের কাহিনী আমরা যজুর্বেদ-এই পাই। শুল্ক যজুর্বেদ মন্ত্রের সঙ্কলন। আর কৃষ্ণ যজুর্বেদ এ মন্ত্র থাকলেও গল্প রয়েছে। এটিকে ভারতীয় পুরাণের উৎস বলা যেতে পারে। সামবেদ বিভিন্ন ঋষিরচিত সূক্তের সংকলন। এ জন্য এটিকে সামবেদ-সংহিতাও বলা হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। বৈদিক যজ্ঞে যে সঙ্গীতের প্রচলন ছিল তা সামবেদ থেকেই নেওয়া। সামবেদের ৭৫টি মন্ত্র বাদ দিলে বাকি সব সূক্ত ঋগ্বেদ
থেকে নেওয়া। অথর্ববেদ: আগের বেদগুলার বিষয় ছিল কেবল মোক্ষ। অথর্ববেদ-এ মোক্ষ ছাড়াও ধর্ম অর্থ ও কাম বিষয় হিসেবে প্রযুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া এটি ভারতীয় আয়ুবের্দ শাস্ত্রেরও উৎস। পাপক্ষয়, শক্রজয় বিষয়ক নানা বশীকরণ মন্ত্র রয়েছে এটিতে । সবচে বিস্ময় যে - অথর্ববেদ-এ রয়েছে আর্য ঐক্যের আহবান। অনার্যদের নিশ্চিহ্ন করার ইঙ্গিত!
প্রতিটি বেদ কয়েকটি মন্ডল বা অধ্যায়ে বিভক্ত। মন্ডলে রয়েছে সূক্ত। প্রতিটি সূক্তে রয়েছে বেশ কটি ঋক বা মন্ত্র। আগেই একবার উল্লেখ করেছি, বেদে সর্বমোট মন্ত্রের বা ঋকের সংখ্যা ২০,৩৭৯।
যা হোক। প্রাচীন বৈদিক সমাজেই বেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল। যিশুর জন্মের ৬০০/৭০০ বছর আগে বৈদিক সমাচে বেদবিরোধী প্রতিবাদী চিন্তাবিদের জন্ম হল। যেমন: চার্বাক মহাবীর বুদ্ধ। বৈদিকরা এদের বলল নাস্তিক।
পরবর্তীকালে বেদবিরোধীরা ভারতবর্ষে টিকে থাকতে পারেনি। ওদের যথা সময়ে হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। জৈনধর্ম কেবল ভারতবর্ষে আজও টিকে আছে; কারণ, ধর্মটি নানা বৈদিক আচারপ্রথা গ্রহন করেছিল বহুকাল আগেই। চার্বাক ঋষি কি বলেছেন না বলেছেন সে সব এখন পন্ডিতদের গবেষনার বিষয়। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।
কাজেই সংশয়ীদের হটিয়ে বেদ আবার ফিরে আসে। তাছাড়া বেদভিত্তিক ধর্মের উত্থান হয়েছিল খ্রিস্টীয় ষষ্টসপ্তম শতকে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পৌরানিক ধর্মের উত্থান ঘটে তখনই। পৌরানিক ধর্মের ভিত্তি ছিল ভারতবর্ষের সমাজে প্রচলিত পুরাণ। আগেই বলেছিকৃষ্ণ যজুর্বেদ কে ভারতীয় পুরাণের উৎস বলা যেতে পারে।
ভারতীয় সমাজে আজও বেদ-এর প্রাধান্য। তার কারণ বিশেষ উপায়ে দেবতার ভজনা করলে সুখশান্তি মেলে, বিপদ আসে না, ধনবৃদ্ধি হয়-ভারতের সাধারণ মানুষের এরকম বিশ্বাস। বেদের দেবতারা অপসৃত হয়ে গেছে কবে। তবে মূল কনসেপ্টটি আজও অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে- পূজো-অর্চনা করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা। বেদের প্রধানতম দেবতা ছিল অগ্নি; অগ্নির অর্চনা আজ ভারতবর্ষে কেউই করে না।
নিজেদের জন্য অনিল আম্বানিরা ৬০ তলা ভবন নির্মান করলেও ভারতীয় সমাজে আজও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়নি। ভারত আজ চাঁদে রকেট পাঠালেও ভারতীয় সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে বিজ্ঞানের বিকাশ তেমন হয়নি। কাজেই বহুলপঠিত না হলে বেদ এখনও ভারতীয় সমাজে অপ্রতিরোধ্য গ্রন্থ হিসেবেই টিকে রয়েছে।
এমন কী- পাকিস্থানি ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে জয়লাভের আশাতেও বেদপাঠ হয়!



উৎস:
ড. আর এম দেবনাথ রচিত সিন্ধু থেকে হিন্দু।

নিচের লিঙ্কে বেদ-এর পুরোটাই পাবেন। অবশ্য ইংরেজিতে।

http://www.sacred-texts.com/hin/

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:২৯
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×