somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: অযান্ত্রিক

২৪ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডেনভার শহরের বাড়িটা বিক্রি করে শহরের বাইরে কোথাও নিরিবিলি হ্রদের কাছে বাড়ি কিনবেন ঠিক করলেন মি:নরম্যান। ব্রোকার-এর নাম স্টিভ পার্কার। সে লেকসাইড শহরে একটি বাড়ির খবর আনল। লেকসাইড শহরটা জেফারসন কাউন্টির পূর্ব প্রান্তে। মি: নরম্যান যেমন চাইছেন বাড়িটি নাকি ঠিক তেমনই । কলরাডো অঙ্গরাজ্যের কম্যুনিটি প্ল্যানিং বিভাগে চাকরি করেন মি: নরম্যান। অফিসের কলিগরা বাজী ধরে বলল, চাকরিটা তুমি ছাড়তে পারবে না নরম্যান। অথচ মি: নরম্যানকে ডাকছে কলরাডোর নীল পাহাড়, ডাকছে নির্জন হ্রদ । অফিসের কলিগদের ধারণা, মি: নরম্যান-এর মাছ ধরার নেশা আছে, চাকরি ছেড়ে হ্রদের পাড়ে বাস করে বাকি জীবন মাছ ধরে কাটিয়ে দেবেন। না, মি: নরম্যান ঠিক মাছ ধরবেন না। লেকের পানিতে এমনি এমনি ছিপ ফেলে বসে থাকবেন। কখনও মাছ উঠলেও ছেড়ে দেবেন তিনি। বরং তিনি দেখবেন কলরাডোর নীল আকাশ, দেখবেন ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়শ্রেনি, দেখবেন হ্রদের স্বচ্ছ জল; দূরের সেই হ্রদ-দ্বীপটি দেখবেন। আর ...আর হ্রদের পাড়ের মাছ ধরার কাঠের সেতুর মাঝখানে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের একটি পোষ্টার সাঁটবেন মি: নরম্যান । কেউ পানির ধারে যেতে চাইলে তাকে ঐ পোস্টারটি মাড়িয়েই যেতে হবে।
জানালার কাছে মৃদু খসখসে শব্দ। মুখ তুলে সেদিকে তাকালেন মি: নরম্যান । জানালার কাচে তুষার আবার মুখ ঘষঁতে শুরু করেছে। বাইরে আবার তুষার ঝরতে শুরু করেছে। মি: নরম্যান এতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলেন বলে টের পাননি। সেই সঙ্গে ঘরের ভিতরে শীতটাও বাড়ছে খেয়াল করলেন। সকাল থেকে অফিসের ডেস্কে বসে ছিলেন মি: নরম্যান । একটু আগে এক কাপ কফি খেয়েছেন। এখন একটা সিগার ধরালেন । আগুনের আলোয় মি: নরম্যান-এর সাতান্ন বছরের লালচে মুখের বলিরেখাগুলি সব স্পস্ট হয়ে উঠল। একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে তিনি দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেন। ২০ মার্চ, ২০০৩; ম্লান হাসলেন মি: নরম্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ কলঙ্কিত একটি দিন । আজই মি: নরম্যান সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দেবেন, সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। আজই শেষবারের মতন অফিস করছেন তিনি।
একহাতে কালো ব্রিফকেসটা নিয়ে আধ ঘন্টা পর নিচে নেমে এলেন মি: নরম্যান। ডেনভার শহরের আকাশটিতে কে যেন সাদাটে ধূসর রং লেপে দিয়েছে। সকাল থেকে থেমে থেমে তুষার পড়ছিল। রাস্তা, গাছগুলি আর দালানের ছাদ শুভ্র তুষারে ছেয়ে সাদা হয়ে আছে। অদূরে গাড়িটা পার্ক করা। নীল রঙের পুরনো মডেলের একটা শেভ্রলে: ভালোই সার্ভিস দিল এ কয় বছর; এখন বিক্রি করে দিতে হবে। তিনি ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। গাড়িতে ওঠার আগে শেষবারের মতন সরকারি অফিস ভবনটা একবার দেখে নিলেন মি: নরম্যান। বুকের ভিতরে কোনও ধরনের নস্টালজিক অনুভূতি টের পেলেন না।
গাড়ি স্টাট নেওয়ার আগে একটা সিগার ধরালেন মি: নরম্যান । খুব শিগগির সিগার ছেড়ে দেবেন। এসব ভেবে তাঁর বুকের ভিতরে কেমন এক শূন্যতার দোলা টের পাচ্ছিলেন তিনি। অফিসের কলিগরা বাজী ধরে বলেছিল, চাকরি তুমি ছাড়তে পারবে না নরম্যান। মি: নরম্যানকে কলরাডোর নির্জন হ্রদ আর পাহাড় অপেক্ষা করে আছে। অফিসের কলিগরা জানে না।
কংগ্রেস পার্কের কাছে এসে গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিলেন মি: নরম্যান। তুষার আর শীত উপেক্ষা করে প্ল্যাকার্ড হাতে কয়েকজন নারী আর পুরুষ দাঁড়িয়ে। প্ল্যাকার্ডে লেখা: “নো ওয়ার।”, “নো ইরাক।” মি: নরম্যানের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। তাঁর একটাই ছেলে, জেফ; ইউ এস নেভিতে আছে, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ক্র জেফ: এখন পারসিয়ান গালফে । ওখান থেকে মার্কিন বোমারু বিমানগুলি এই মুহূর্তে বুশ প্রশাসনের নির্দেশে বাগদাদ শহরের ওপর বোমা ফেলছে । মি: নরম্যান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ডেনভার শহরের ভিতরেই অ্যাথমার পার্কের কাছে রুবি হিলে তার বাড়ি । বাড়ি পৌঁছনোর পর অত্যন্ত বিষন্ন বোধ করলেন তিনি। সাদা রঙের দোতলা বাড়ি; অত্যন্ত সখ করে তৈরি করেছিলেন তিরিশ বছর আগে। এখন বিক্রি দিতে হবে। খুব শিগগির ডেনভার শহর ছেড়ে চলে যাবেন মি: নরম্যান।
আজ সকালে লিভিং রুমের মেঝের ওপর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বড় একটা পোষ্টার সেঁটেছেন মি: নরম্যান । প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের পোষ্টার মাড়িয়ে ভিতরে ঢুকলেন মি: নরম্যান। সান অভ আ বিচ! সরকারি চাকরি করে ঐ পোষ্টারটি পা দিয়ে মাড়ানো যাবে না। কাজেই চাকরি ছেড়ে দিতে হল। শুনশান ফাঁকা ঘরটায় হালকা শীত। মি: নরম্যান-এর স্ত্রী মারা গিয়েছেন সাত বছর হল। জুডিথের ক্যান্সার হয়েছিল। গতরাতে, অনেক দিন পর জুডিথকে স্বপ্নে দেখেছেন, নির্জন হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে জুডিথ। স্বপ্নটা দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। আর তখনই অন্ধকারের মধ্যে তুষারপাতের মিহি শব্দ পেয়েছিলেন মি: নরম্যান । তার মনে হয়েছিল খুব শিগগির জুডিথের সঙ্গে তার দেখা হবে। কিন্তু, তা কি করে সম্ভব?
এক সকালে ব্রোকার স্টিভ পার্কার-এর সঙ্গে লেকসাইড শহরে রওনা হলেন মি: নরম্যান । দুপুরের আগে আগেই লেকসাইড শহরে পৌঁছলেন । শান্ত, নিরিবিলি শহর। লাঞ্চ করা দরকার। একটা রেস্টুরেন্টের বাইরে গাড়িটা পার্ক করে ঢুকলেন। ভিতরে বেশ ভিড়। নানা বয়েসি মানুষ। গুঞ্জন। সিগারেটের ধোঁওয়া । পিছনের এককোণে বসলেন মি: নরম্যান । স্টিভ পার্কার টয়লেটে গেল। ইষৎ বাদামী চুল, ঘন ভুরু, নীল নীল চোখ আর ফরসা গায়ের রঙ - একজন মাঝবয়েসি মহিলা অর্ডার নিতে এলেন। মহিলাকে দেখে মি: নরম্যান ভয়ানক চমকে উঠলেন। মহিলা দেখতে অনেকটা জুডিথের মতো। মহিলাকে ঠিক ওয়েট্রেস বলে মনে হল না। সম্ভ্রান্ত ঘরের নারী বলে মনে হয়। দিন কয়েক আগে জুডিথকে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আশ্চর্য! মহিলা নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, বিফ দেব?
মি: নরম্যান চাকরি ছাড়ার পড় থেকে মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বললেন, না। আমি ভেজ।
স্টিভ পার্কার ফিরে এল। সে অবশ্য বিফই নিল। ভারি বাচাল। ভিড়ের মধ্যে কে যেন গিটার বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করেছে । খেতে খেতে মি: নরম্যান কান পাতেন।

আসুন সিনেটর, কংগ্রেসম্যান
দয়া করে শুনুন আহবান
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন না
অবরোধ করবেন না হলরুম
কেননা, যে কষ্ট পাচ্ছে
তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাইরে একটা যুদ্ধ চলছে
এবং সে যুদ্ধটা তীব্র হচ্ছে
যে যুদ্ধের আঁচ আপনার জানালা কাঁপাবে
ধ্বসিয়ে দেবে আপনার দেওয়াল
কেননা, সময়ে পরিবর্তন আসে।


বব ডিলানের গান: দি টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিং ...কারা এরা? মি: নরম্যানের ভ্রুঁ কুচঁকে যায়। তার মনে পড়ে গেল কংগ্রেস পার্কের কাছে তুষার আর শীত উপেক্ষা করে প্ল্যাকার্ড হাতে কয়েক জন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল। প্ল্যাকার্ডে লেখা: “নো ওয়ার।” “নো ইরাক।” মি: নরম্যানের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়।
লাঞ্চ সেরে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেরিয়ে এসে মি: নরম্যান রেস্টুরেন্টের নামটা দেখলেন: “লেইক আইল্যান্ড।” আবার আসতে হবে মনে মনে বললেন।
রোহ্ডা হ্রদের পাড়ে পৌঁছে মি: নরম্যান মুগ্ধ হয়ে গেলেন। নীলাভ আকাশের নিচে পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছজলের বিস্তীর্ণ হ্রদ। নীকাকাশ যেন পাহাড় ও হ্রদের জলে চুম্বন করছে। পাড়ে তুলা গাছ, উইলো আর কলরাডোর বিখ্যাত নীল স্প্রুস। হ্রদের পাড়ে মাছ ধরার জন্য কাঠের সেতু। সবচে বড় কথা, জায়গাটি অসম্ভব নির্জন। পানিতে মাছ ঘাই দিলেও শোনা যায়। হ্রদের মাঝখানে দ্বীপের মতন। লেইক আইল্যান্ড? আশ্চর্য! দ্বীপের মাঝখানে পাহাড়ের মতন। এত সুন্দর। কে বলবে আমেরিকা একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন খুনি দেশ?
লেকের পাড়ে রাস্তা, রাস্তার পাশে সাদা রং করা কাঠের বেড়া। ভিতরে কাঠের দোতলা ছিমছাম বাড়িটির সামনে টিউলিপ ফুলের সুন্দর বাগান। স্টিভ পার্কার সব ঘুরিয়ে দেখাল। সত্তর হাজার ডলারে এর চে ভালো বাড়ি পাবেন না স্যার। সবচে বড় কথা বাড়িটি হনটেড নয়। বাড়ির ওনার লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টিভেন ক্যানেথ, ইউ এস আর্মিতে আছেন। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়াতে বেচে দিচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টিভেন ক্যানেথ এর স্ত্রীর নাম বারবারা স্যার।
মি: নরম্যান ব্রোকারের বকবকানি শুনছিলেন না। হ্রদের দিকে চেয়ে ভাবলেন: এখানেই কোথাও আমার মৃত্যু হবে। আশ্চর্য!
বাকি কাজগুলো সারতে সারতে তুষার ঝরা দিনগুলি শেষ হয়ে গেল।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে লেকসাইড শহরের নতুন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন মি: নরম্যান । নতুন বাড়িতে উঠে পুরনো শেভ্রলে বেচে দেবেন। শহরের বাইরে বাস করলে তেলের দরকার হবে না। কি আছে শহরে? ডেনভার শহরে? আমেরিকার কলরাডো অঙ্গরাজ্যের ডেনভার শহরে? এখন শহরগুলি পরিত্যাগ করার সময় হয়েছে ...চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার আগেই। এইসব ভেবে ম্লান হাসেন মি: নরম্যান । ঝলমলে রোদ উঠেছে। হাইওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে। অবসর সময়ে গান শোনেন মি: নরম্যান । ঝুঁকে সিডি প্লেয়ারটা অন করলেন। ক্রিস রিয়ার গান বেজে উঠল। I am gone fishing/ I got me a line/Nothing I do is gonna make the difference/ So I am taking the time. ম্লান হাসেন মি: নরম্যান ।
রোহ্ডা হ্রদের নির্জন পাড়ের নতুন বাড়িতে এসে নিশ্চিন্ত হলেন মি: নরম্যান, তবে তাঁর মনের গ্লানি দূর হল না। ছেলে জেফ ইউ এস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ক্র। পুরনো শেভ্রলেটা বিক্রি করে দিলেন, বিক্রি করে দিয়ে নির্ভার বোধ করলেন।
আজকাল প্রায় সারাদিনই মি: নরম্যান কাঠের সেতুর শেষ মাথায় বসে থাকেন। মাছ ধরেন। আসলে মাছ তিনি ধরেন না। এমনি এমনি লেকের জলে ছিপ ফেলে বসে থাকেন। কখনও কাঠের বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে বসে রোদের আলোয় বই পড়েন। এখানে আসার পর পাওলো কোহেলোর, ‘দ্য ওয়ে অভ দ্য বো’ পড়ে শেষ করেছেন; এখন পড়ছেন রবার্ট এইটকেন-এর ‘ টেকিং দ্য পাথ অভ জেন’ বইটি ।
একদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। সময়টা বিকেল। মাথায় মেক্সিকান হ্যাট, হলদে গেঞ্জি আর বাদামী রঙের হাফ প্যান্ট পরে কাঠের সেতুর শেষ মাথায় বসে ছিলেন মি: নরম্যান । সেদিনের মতো মাছ ধরা শেষ। এখন ফিরবেন। উঠে দাঁড়িয়েছেন। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলেন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের পোষ্টারের ওপর সোনালি চুলের পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একটি ছিপছিপে ফরসা মেয়ে দাঁড়িয়ে। শাদা রঙের ওয়েডিং ড্রেস পরে আছে মেয়েটি । হাতে একগুচ্ছ টিউলিপ ফুল। মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গি আর তাকানোর ভঙ্গিতে মেয়েটিকে অন্ধ মনে হল। মেয়েটির অনেকটা পিছনে একজন মধ্যবয়েসি মহিলা ‘অ্যাঞ্জেলিসা’, ‘অ্যাঞ্জেলিসা’ বলতে বলতে দ্রুত এদিকেই আসছে। আশ্চর্য! লেইক আইল্যান্ড রেস্টুরেন্টের সেই ওয়েট্রেস। ইষৎ বাদামী চুল, ঘন ভুরু, নীল নীল চোখ আর ফরসা গায়ের রঙ। মহিলাও মনে হয় দূর থেকে মি: নরম্যানকে চিনতে পারলেন। থমকে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে এসে হেসে বললেন, আপনি এখানে?
মি: নরম্যান হাসলেন। বললেন, আমি এখানেই থাকি।
আমার মেয়ে। অ্যাঞ্জেলিসা। মহিলা বললেন।
ও।
আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো?
না, না।
মহিলা বললেন, আমি এখন মেয়েকে নিয়ে লেকসাইড শহরে থাকি। আগে এখানেই থাকতাম। আজ মনে হল ঘুরে দেখে যাই। আমার নাম বারবারা।
আমার নাম অসকার, অসকার নরম্যান ।
আজ কি মাছ ধরলেন মি: নরম্যান? বারবারার মুখে চাপা হাসি।
আজ ভাগ্যে তেমন কিছুই জোটেনি ম্যাডাম।
ও।
মি: নরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাঞ্জেলিসা মনে হয় ...কথা শেষ করলেন না।
হ্যাঁ। তবে ওর সেন্স খুব শার্প। সব বুঝতে পারে। দেখলেন না কেমন গাড়ি থেকে নেমে একাই এখানে চলে এল। এই জায়গাটি ওর খুব প্রিয়। ওর মেয়েবেলা এখানেই কেটেছে ।
মি: নরম্যান অ্যাঞ্জেলিসার দিকে তাকালেন। অন্ধ মেয়েটি দূরের দ্বীপের সেই পাহাড়ে দিকে তাকিয়ে আছে। অসকার নরম্যান বললেন, চলুন, কাছেই আমার বাড়ি। এক কাপ কফি খাবেন।
বারবারা বললেন, যেতে পারি, কফিও খেতেও পারি, তবে একটা শর্ত আছে।
মি: নরম্যান অবাক। বললেন, কি শর্ত- বলুন।
বারবারা বললেন, রবার্ট এইটকেন-এর ‘ টেকিং দ্য পাথ অভ জেন’ বইটি আমাকে পড়ার জন্য ধার দিতে হবে। অনেক খুঁজেছি। পাই নি।
মি: নরম্যান হেসে বললেন, আচ্ছা দেব। এই নিন।
বইটি নিয়ে বারবারা বললেন, আজ আপনার বাড়ি চিনে রাখব। পড়া শেষ হলে ফেরত দিয়ে যাব।
মি: নরম্যান কেঁপে উঠলেন। মাস কয়েক আগে জুডিথকে স্বপ্নে দেখেছেন, নির্জন হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে জুডিথ । জুডিথ কি ফিরে এল? মি: নরম্যান বললেন, ঠিক আছে। ও নিয়ে ভাববেন না।
লেকের পাড়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে নির্জন রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সার সার দীর্ঘপাতার পাইন গাছ। সেই পাইন পাতাগুলি বাতাসে দুলছিল আর সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল । বাড়ির বাইরে পুরনো আমলের একটি বাদামী রঙের পন্টিয়াক পার্ক করা। টিউলিপ বাগানে শেষ বিকেলের রোদ। আর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে।
কাঠের বারান্দায় উঠে বারবারা বললেন, আমরা বরং এখানেই বসি। একটু পর সূর্য অস্ত যাবে। তখন লেকের জলে রঙের খেলা দেখা যাবে।
ঠিক আছে। বলে মি: নরম্যান ভিতরে ঢুকে গেলেন। মাছধরার সরঞ্জামগুলি রেখে অতিরিক্ত দুটি চেয়ার নিয়ে এলেন। লক্ষ করলেন বারবারার মুখে কী রকম বিষন্নতা জমেছে । বারবারা বললেন, বাড়িটি তাহলে আপনিই কিনেছেন?
মি: নরম্যান বসতে বসতে বললেন, হ্যাঁ। আগে আমি ডেনভার শহরে ছিলাম। শহরের জীবন আর ভালো লাগছিল না আমার। এখানেই নিরিবিলি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। আপনি এখানেই ছিলেন বললেন?
হ্যাঁ। এই বাড়িতেই ।
ও। মি: নরম্যানের মনে পড়ল, ব্রোকার কি সব বলছিল। সত্তর হাজার ডলারে এর চে ভালো বাড়ি পাবেন না স্যার। সবচে বড় কথা বাড়িটি হনটেড নয়। বাড়িটা ইউ এস আর্মির এক লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ...বারবারা বললেন, অ্যাঞ্জেলিসার বাবার নাম স্টিভেন ক্যানেথ, ইউ এস আর্মিতে আছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল । একটু থেমে বারবারা বললেন, ক্যানেথ এখন ইরাক। গত বছর আমি অ্যাঞ্জেলিসার বাবাকে বললাম: আর্মির চাকরি ছাড়ো। প্রেসিডেন্ট বুশের মতলব ভালো না, হিজ গোয়িং টু ক্রিয়েট সাম ক্রাইসিস ইন দ্য মিডিল ইস্ট। নেভাডায় আমার বাবার একটা অ্যাবানডোনেড র‌্যাঞ্চ আছে, ওটাই দাঁড় করাই না কেন? ক্যানেথ শুনল না। তারপর ...তারপর আমি ডির্ভোস চেয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে রিভারসাইড শহরে চলে যাই, রেস্টুরেন্টে কাজ নিলাম। এখন ... এখন মেয়েকে নিয়েই বেঁচে আছি।
মি: নরম্যান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অ্যাঞ্জেলিসার দিকে তাকালেন। অন্ধ মেয়েটি দূরের হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে দিকে তাকিয়ে আছে । তখনও অ্যাঞ্জেলিসা দূরের হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু, অ্যাঞ্জেলিসা ওয়েডিং ড্রেস পরে আছে কেন? কথাটা অবশ্য জিজ্ঞেস করলেন না।
একটু পর বারবারা ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কফি বানিয়ে ফিরে এলেন। সিগার ছেড়ে দিয়েছেন মি: নরম্যান। তামাকের ধোঁওয়ার অভাবে বুকের ভিতরে এখনও চাপা কষ্ট হয়। তবে সবকিছু বিবেচনা করে সহ্য করছেন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। বাতাসে টিউলিপ ফুলের গন্ধ ছড়িয়েছে। বারবারা বললেন, চলুন। লেকের পাড়ে যাই। চাঁদ উঠেছে। ভালো লাগবে।
চলুন।
হাঁটতে ভালো লাগছিল মি: নরম্যানের। বারবারার মুখটি অবিকল জুডিথের মুখ যেন। কেন? আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। ফুটফুটে জোছনা ফুটেছে। আর উথালপাথাল বাতাস। জোছনার আলোয় পরিস্কার দেখা যায়- হ্রদের জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি আর একটি নৌকা। এদিকেই আসছে। নৌকার একজন যাত্রী হাত নাড়ল। অ্যাঞ্জেলিসা উঠে দাঁড়াল। হাত নাড়ল। বারবারার দিকে তাকিয়ে মি: নরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, কারা ওরা?
বারবারা বললেন, যারা ডেনভার শহরের কংগ্রেস পার্কের সামনে তুষার আর শীত উপেক্ষা করে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকে: “নো ওয়ার।” “নো ইরাক।”
মি: নরম্যানের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়।
আজ অ্যাঞ্জেলিসার বিয়ে। বারবারা বললেন।
বিয়ে? মি: নরম্যান চমকে ওঠেন।
হ্যাঁ। ওর হবু বরের নাম বব। মিউজিশিয়ান। ববের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলিসার পরিচয় লেইক আইল্যান্ড রেস্টুরেন্টে । আপনার মনে নেই লেইক আইল্যান্ড রেস্টুরেন্টে বব ডিলানের ‘দি টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিং’ গানটি গাইল? ববই তো হাত নাড়ল। অন্ধ মেয়েকে কে বিয়ে করে বলুন। তবে ববরা একেবারেই অন্যরকম। ওই হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে ববের বন্ধুরা থাকে। সেই বন্ধুদের নিয়ে আসছে বব। আজ রাতে ওই হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ের ওদের বিয়ে হবে।
ওই ওই হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে কি আছে? মি: নরম্যানের বুকের ভিতর কেমন যেন করছে।
বারবারা বললেন, অনেক গাছ, পাখি, ঝরনা, হাজার বছর পেছনো সময়, সাদা-কালো মানুষ, তাদের সহজ সরল অযান্ত্রিক ও আদিম জীবনযাপন, আর গান। বিয়ের পর বব আর অ্যাঞ্জেলিসা ওখানেই থাকবে।
শুনতে শুনতে কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান মি: নরম্যান। চূড়ান্ত সর্বনাশ হওয়ার আগেই শহর ছেড়েছেন তিনি-এখন আরও আরও গভীর নির্জনে যেতে চাইলেন তিনি -একেবারেই অযান্ত্রিক ও নগ্ন হয়ে যেতে চাইলেন। যে কারণে মৃদুকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আমরাও কি যেতে পারি না ওই ওই হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে বারবারা?
পারি। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গভীর আবেগে বারবারা বললেন।
মি: নরম্যানও উঠে দাঁড়ালেন। নৌকাটি ক্রমেই পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের হ্রদ-দ্বীপের পাহাড়ে নিয়ে যেতে।

উৎসর্গ: সিনডি শিহান। ইরাক যুদ্ধে নিহত এক মার্কিন সৈন্যের মা এবং ইরাক যুদ্ধ বিরোধী মার্কিন অ্যাক্টিভিস্ট ।

৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×