somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সান্দ্রো বতিচেল্লি: আদি রেঁনেসা যুগের অসাধারণ এক ইতালিয় চিত্রকর

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সান্দ্রো বতিচেল্লি (১৪৪৫-১৫১০) অসাধারণ এক ইতালিয় চিত্রকর । বতিচেল্লির পুরো নাম আলেসান্দ্রো দি মারিয়ানো ফিলিপেপি। বতিচেল্লির সময়কাল ছিল পঞ্চদশ শতকের শেষ- যখন ইতালিয় রেঁনেসা বা নবজাগরণের প্রারম্ভ। সে আদি রেঁনেসা যুগেরই অন্যতম আঁকিয়ে ছিলেন বতিচেল্লি। ছন্নছাড়া প্রকৃত শিল্পীর মতোই জীবদ্দশায় বতিচেল্লি যেমন অভিজাত সমাজের সান্নিধ্য লাভ করে বিত্তশালী হয়েছিলেন, তেমনি মৃত্যুর সময় ছিলেন কপর্দকশূন্য! চিরকুমার বতিচেল্লি বিবাহপ্রথার কট্টর সমালোচনা করলেও নিজের চিত্রকর্মে পুরুষের তুলনায় প্রাধান্য দিতেন নারীকে । জীবনভর ছবি এঁকে জীবদ্দশায় তুরীয় সম্মান লাভ করলেও মৃত্যুর পর প্রায় ৪০০ বছর বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে বিলম্ব হলেও ইউরোপ বতিচেল্লির অনন্য প্রতিভা বুঝতে পেরেছে ...



ইটালির মানচিত্রে ফ্লোরেন্স শহরের অবস্থান

সান্দ্রো বতিচেল্লির জন্ম ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। সারা জীবন ফ্লোরেন্স শহরেই কেটেছিল । পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সান্দ্রোর বাবা ছিলেন ‘ট্যানার’, মানে চামড়া পাকা করার কাজ করতেন। বালক সান্দ্রোর ছবি আঁকতে ভালো লাগত অথচ বাবা এক স্বর্ণকারে কাছে বালক সান্দ্রোকে শিক্ষানবিশি করতে পাঠালেন। সেই স্বর্ণকার কি কারণে সান্দ্রোরর নাম রাখল বতিচেল্লি : যার মানে, ‘ছোট পিঁপে।’ যাক। কিছু কাল পরে সান্দ্রো বাবাকে বোঝালো যে ছবি আঁকার ব্যাপারটাই ওকে খুব টানে। সে সময়কার ফ্লোরেন্স শহরের একজন প্রখ্যাত চিত্রকর হলেন ফ্রা ফিলিপ্পো লিপ্পি। ইনি গির্জের বেদিতে রং চড়িয়ে দারুণ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাবার অনুমতি নিয়ে সান্দ্রো তাঁর কাছেই গেল শিক্ষানবিশি করতে।
শুরু হল সান্দ্রোর ছবির ব্যাকরণ শেখা।


ফ্লোরেন্স শহর। এখন ...




প্রিমিভেরা (ডিটেইল) বালকের আঁকা চিত্রে মুখে ও অবয়বে কোমাল স্পর্শ দেখে স্বয়ং গুরু মুগ্ধ। অলঙ্করনে ডিটেইল-এর কাজ ভারি সূক্ষ্ম। ফ্লোরেন্স শহরের লোকে বালক সান্দ্রোর প্রতিভা ঠিকই বুঝতে পারল।

বয়স মাত্র ১৫ বছর । নিজের কাজের জন্য ওয়ার্কশপ খুলে বসল বালক বোতিচেল্লি। সে কর্মশালায় অন্যরা বতিচেল্লির কাছে শিক্ষানবিশি করতে আসত। শিষ্যরা বতিচেল্লিকে সাহায্য করত। প্রচুর ছবি আঁকার কাজ পেতেন বতিচেল্লি। কখনও শিষ্যরাও আঁকত- তবে বতিচেল্লির নিবিড় পর্যবেক্ষনে।



বতিচেল্লির আঁকা একটি প্রতিকৃতি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বতিচেল্লির শৈলীও পরিবর্তিত হতে লাগল। তাঁর আঁকা ছবির মানুষের মুখে বিষন্নতা জড়ানো। মনে হয় জীবন্ত। মনে হয় যেন অভিনয় করছে। ছবিতে বাস্তবতা এমন ভাবে ফুটে উঠত যে লোকে দেখলেই বুঝতে পারত কোনটি বতিচেল্লির কাজ।

মহত্তম দর্শন ব্যতীত উচ্চতর শিল্প সম্ভব না। বতিচেল্লির চিত্রে Neo- Platonist দর্শনের প্রভাব ছিল। এর মানে ... that he would bring together in one painting ideas that belong to both Christianity and pagan ideas which may have included mythology.




বতিচেল্লির আঁকা ক্রশবিদ্ধ খ্রিস্ট


প্রিমাভেরা। ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে বতিচেল্লি আঁকলেন প্রিমাভেরা বা ‘প্রতীকাশ্রয়ী বসন্ত’ ; ইউরোপে আজও এই ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সবচে বিতর্কিত ছবি। প্রিমাভেরা নিয়ে আজ অবধি সবচে বেশি লেখালেখি হয়েছে। সজীব এক বসন্তে চমৎকার এক উদ্যানে উপকথার চরিত্ররা সমবেত হয়েছে। কি এর মানে? কারও মতে প্রিমাভেরা নিও-প্লেটোনিক প্রেমের প্রকাশ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়।

আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুমকোমল
কার অনাদরে আজি ঝরে যায় !
কেন কাছে আস, কেন মিছে হাস' ,
কাছে যে আসিত সে তো আসিতে না চায়।
সুখে আছে যারা সুখে থাক্ তারা ,
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা
দুখিনী নারীর নয়নের নীর
সুখীজনে যেন দেখিতে না পায়।


আমরা প্লেটোনিক লাভ এর কথা শুনেছি। যা নিও-প্লেটোনিক দর্শনের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। রবীন্দ্রনাথ ও প্লেটোনিক লাভ এর সম্পর্ক ঘনিষ্ট। এভাবে বতিচেল্লির প্রিমাভেরা ও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনের মধ্যে একটি সাদৃশ্য আবিস্কার করা গেল।



বতিচেল্লি।


সেকালে মেডেসি পরিবার ছিল ফ্লোরেন্স শহরের অভিজাত পরিবার। এরা বতিচেল্লিকে শ্রদ্ধা করত, বতিচেল্লির আঁকা ছবি কিনত। মেডেসি পরিবারের সদস্যদের ছবিও আঁকতেন বতিচেল্লি। মেডেসি পরিবারের বদান্যতার জন্যেই বতিচেল্লি ফ্লোরেন্স শহরের অভিজাত সমাজে অবাধে মিশতে পারতেন। এভাবে ছবি আঁকার উপাদানও পেয়ে যেতেন। ছবির বিনিময়ে মেডেসিরা প্রচুর অর্থ দিতেন বতিচেল্লিকে।


১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আঁকা ‘বার্থ অভ ভেনাস।’ ভেনাস হলেন গ্রিক উপকথার দেবী আফ্রোদিতি। তখন একবার বলেছি বতিচেল্লির সময়টা ছিল ইতালিয় রেঁনেসা বা নবজাগরণের সূচনালগ্ন। আমরা জানি, রেঁনেসার সময়কালে ইউরোপীয় শিল্পীরা অনুপ্রেরণার জন্য গ্রিস ও রোমের ধ্রুপদী শিল্পের দিকে ফিরে তাকিয়েছিল।



বতিচেল্লির আঁকা একটি প্রতিকৃতি। এই মেয়েটির আশেপাশে কি ঘটছে সে সম্বন্ধে মেয়েটি সম্পূর্ন বেখেয়াল। মেয়েটি হয়তো মেডেসি পরিবারের সদস্য। বতিচেল্লির এক বড় বৈশিষ্ট্য অন্যমনস্কতা ...




বতিচেল্লির আরেকটি বৈশিস্ট্য নারীর চরিত্রকে প্রধান করে দেখানো

১৪৮১। রোমে গেলেন। সিস্তিন চ্যাপেলের ছবি আঁকার জন্য। চ্যাপেল হল খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের প্রার্থনাগৃহ। পোপের বাসস্থান হওয়ায় ভ্যাটিকান সিটির সিস্তিন চ্যাপেল ছিল বিখ্যাত। স্থাপত্য শৈলীর জন্যও বিখ্যাত। চ্যাপেলটি দেখে ওল্ড টেস্টামেন্টের সলোমনোর উপাসনালয়ের কথা মনে পড়ে যায়। রেঁনেসা যুগের শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। বতিচেল্লির সঙ্গে ভ্যাটিকানে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোসহ অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। তিনটে বড় ছবি আঁকলেন বতিচেল্লি।


সিস্তিন চ্যাপেলের এই ছবিটি বতিচেল্লির আঁকা ; ছবির নাম ‘স্টোরিজ ফ্রম মোজেজ’ ...




সেকালের ফ্লোরেন্স শহর ।তৎকালে ফ্লোরেন্স শহরে সাধু গিরোলামো সাভোনারোলা নামে একজন খ্রিস্টান ধর্মগুরু বাস করতেন। বতিচেল্লি সাধুর শিষ্য হলেন। তিনি জাগতিক বিষয়াদি পরিত্যাগ করার জন্য বলতেন। সাধু গিরোলামো সাভোনারোলা ছিল গভীর ব্যক্তিমায়। সাধু গিরোলামো সাভোনারোলা মৃত্যুর কথা বলতেন এবং ঈশ্বরের ক্রোধের কথা বলতেন। বতিচেল্লির আগেকার অনেক ছবিই ঈশ্বরের ভূমিকা নেই বলে পুড়িয়ে ফেলা হল। যা হোক। সাধু গিরোলামো সাভোনারোলার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে তাকেও ফ্লোরেন্স শহরের কেন্দ্রে পুড়িয়ে ফেলা হল। তাঁর শিষ্যরা সব ফ্লোরেন্স শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বতিচেল্লি ফ্লোরেন্সে থেকে ছবি আঁকতে লাগলেন।


সাধু গিরোলামো সাভোনারোলা।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বতিচেল্লির আঁকা ধরন-ধারন ও শৈলীও বদলে যেতে লাগল। তবে বতিচেল্লির ছবিতে ধর্মের ছোঁয়া যেন লেগে রইল। ধর্মীয় গল্পের প্রতীকে অনেক কথা বললেন। গির্জের বেদিতেও ছবি আঁকতেন বতিচেল্লি। এভাবে প্রভূত অর্থ উপার্যন হল।

চিরকুমার বতিচেল্লির শেষ বছরগুলি ভালো কাটেনি। সময় বদলে যেতে লাগল। বতিচেল্লিও খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রাণপন লড়লেন। কঠিন কঠিন সব কাজ নিতেন- যা অন্যরা ফিরিয়ে দিত।



বোঝা যেত যে বতিচেল্লি সংগ্রাম করছেন । ছবিতে সংঘাত এর পাশাপাশি ফুটত আবেগ, নির্মলতা ও মায়া।

৬৫ বয়েসে মারা যান বতিচেল্লি। একেবারে কপর্দক শূন্য অবস্থায় । তখন রাফায়েল ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চির যুগ শুরু হয়েছে। মৃত্যুর পর ৪০০ বছর লোকে ভুলে থাকল এই প্রতিভাবান চিত্রকরকে। তবে বতিচেল্লি যে আদি রেঁনেসা যুগের অন্যতম সেরা শিল্পী ছিলে তা উপলব্দি করতে ইউরোপের শিল্পরসিকের বিলম্ব হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৫:১৬
১২টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×