somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থোথ: প্রাচীন মিশরের চন্দ্রদেব

১২ ই মে, ২০১১ দুপুর ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রাচীন মিশরের চন্দ্রদেব থোথ। থোথ কে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতা মনে করা হত। অথচ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতা থোথকে প্রাচীন মিশরীয়রা কল্পনা করেছিল বেবুনরূপে। কি এর কারণ? আর যে আইবিস পাখি বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে কাদা খুঁটে খায়- সেই আইবিস পাখির মাথা জুড়ে দিয়েছিল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতার মাথায়! এও এক বিস্ময়। সুপ্রাচীন কালে প্রাচীন মিশরের হার্মোপোলিস নগরে গড়ে উঠেছিল চন্দ্রদেব থোথ- এর উপাসনা। আজও সেই নগরে বেবুনরূপী চন্দ্রদেব থোথ-এর ভাস্কর্য চোখে পড়ে। প্রাচীন মিশরের মানুষ মনে করত আইবিস পাখির রূপ ধরে দেবতা থোথ একটি বিশ্বডিম পেড়েছিল। এরপর দেবতা থোথ-এর সংগীতের ঐকতানে চারটে ব্যাঙ দেবতা এবং স্বর্পরাণীর সৃষ্টি হয়েছিল। এরাই পরবর্তীকালে একটানা দেবতা থোথ-এর গান গেয়েছিল। এতে নাকি আকাশে সূর্যদেবে যাত্রা সম্ভ ব হয়েছিল। এমনই ধারণা ছিল প্রাচীন মিশর বাসীর ...



চন্দ্রদেব টরথ। চন্দ্রদেব থোথ-এর পিতামাতা নেই। কারণ কালের ( অর্থাৎ সময়ের) শুরুতে চন্দ্রদেব থোথ আত্বনির্মিত (বা স্বয়ম্ভু) । তবে কারও কারও মতে চন্দ্রদেব থোথ দেবতা রা- এর পুত্র। আবার কেউবা মনে করে সেথ এর মাথা থেকে নির্গত হয়েছেন চন্দ্রদেব থোথ। থোথ চন্দ্রদেব হওয়ায় মাথায় একটি চন্দ্রাকৃতির চাকতি। প্রজ্ঞার দেবতা বলেই চন্দ্রদেব থোথ-এর হাতে লেখার পাত্র এবং নলখাগড়ার কলম।

চন্দ্রদেব থোথ- এর গুণের যেন শেষ নেই। তিনি পৃথিবী ও আত্মার মহান পরিমাপকারী। জ্ঞান ও দৈব ভাষার দেবতা ; প্রাচীন মিশরের কথ্য ও লিখিত ভাষারও উদ্ভাবক চন্দ্রদেব থোথ এবং গ্রন্থের প্রভূ হিসেবে তিনিই দেবতাদের লিপিকার (বা পবিত্র গ্রন্থের দলিললেখক) । তিনিই যাবতীয় প্রাচীন পান্ডুলিপির সংরক্ষণ করেন এবং তিনিই জ্যোর্তিবিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং ঔষধের উদ্ভাবক; নক্ষত্রের গণনাকারী, সর্বপ্রকার জ্ঞানের রক্ষক। মনে করা হয় প্রাচীন মিশরের রহস্যময় এবং বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বুক অব ডেড’ চন্দ্রদেব থোথ এর লেখা ।



দেবী মাত। ইনি চন্দ্রদেব থোথ এর স্ত্রী। ইনি সত্য, ন্যায়বিচার ও ঐক্যতানের দেবী।

প্রাচীন মিশরীয় উপকথার দেবতা সেথ এবং হোরাস এর যুদ্ধের কথা আমরা জানি।
যারা জানেন না তাদের জন্য:

...দেবতা রা ছিলেন পৃথিবীর শাসক। জেব এবং নুট এর সেথ এবং অসিরিস নামে দুটি ছেলে হল এবং আইসিস এবং নেফথিস নামে দুটি কন্যা হল। কালক্রমে পৃথিবীর শাসন করবার উত্তারিধকার পেয়েছিলেন অসিরিস । আইসিস তাকে সাহায্য করেছিল। আইসিস কেবল অসিরিস-এর বোনই না, স্ত্রীও। অসিরিস কে ঘৃনা করত সেথ। যে কারণে সেথ অসিরিসকে হত্য করে। আনুবিসের সহায়তায় আইসিস স্বামী মরদেহ মমিতে পরিনত করে। এবং যাদুবলে অসিরিস-এর উত্থান ঘটায়। এর পর থেকে অসিরিস পাতালের রাজা। আইসিস এবং অসিরিস- এর পুত্র হোরাস। হোরাস সেথকে পরাজিত করে এবং পৃথিবীর রাজা হয়।

সে যুদ্ধের সময় চন্দ্রদেব থোথ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। হোরাস এবং আইসিস এর প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিলেন থোথ। থোথ মনে করতেন সিংহাসনের প্রতি হোরাস- এর দাবিই ন্যায়সঙ্গত এবং সেথ অন্যায় ভাবে অসিরিসকে হত্যা করেছে।




আইবিস পাখি। প্রাচীন মিশরের মানুষ চন্দ্রদেব থোথ-এর মাথা কল্পনা করেছিল এই পাখির মাথার মতো । থোথ-এর দেহটি অবশ্য পুরুষের। থোথ চন্দ্রদেব হওয়ায় চাঁদের কলার সঙ্গে আইবিস পাখির বাঁকানো ঠোঁটের সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়েছে।

প্রাচীন মিশরীয় পুরাণে চন্দ্রদেব থোথ কে বিবাদমান দুপক্ষের মধ্য মধ্যস্থতাকারীরূপে এবং শান্তি স্থাপনকারীর ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। মৃতের বিচারেও চন্দ্রদেব থোথ-এর ভূমিকার রয়েছে। মৃতের আত্মার ওজন করার আগে আত্মাটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন চন্দ্রদেব থোথ। ফলাফল আত্মাটির পক্ষে গেলে আত্মাটিকে পূণ্যবান ঘোষনা করতেন তিনি।



বেবুন। চন্দ্রদেব থোথ কে বেবুনরূপে কল্পনা করা হয়েছে । তার কারণ খানিকটা উদ্ভট। মিশরীয়রা মনে করত বেবুন রাত্রীকালীন পশু, যে প্রত্যহ সকালে চেঁচিয়ে সূর্যকে স্বগত জানায়!

আমরা জানি, গূঢ়লিপি বা hieroglyphs হল প্রাচীন মিশরের লিখন পদ্ধতির নাম। গূঢ়লিপিকে পবিত্র লেখনি বলা হত। তার কারণ, hieros অর্থ: পবিত্র এবং glyphe অর্থ: লেখনি। গূঢ়লিপি তে কাজ বস্তু শব্দ বা কোনও ধারণা বোঝাতে ছবি ব্যবহার করা হত। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০ গূঢ়লিপি ছিল। কোনও কোনও ছবি গোটা শব্দকে বোঝাত। গূঢ়লিপিও প্রাচীন মিশরে চন্দ্রদেব থোথ-এর আবিস্কার বলে মনে করা হয়।



প্রাচীন মিশরের গূঢ়লিপি।

চন্দ্রদেব থোথ যাদুকরী শক্তির অধিকারী-প্রাচীন মিশরবাসীর বিশ্বাস এমনই ছিল। প্রাচীন কালে মিশরে ‘বুক অভ থোথ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রচলিত ছিল। ওটি পাঠ করলে নাকি যাদুকরী শক্তির অধিকারী হওয়া যায় । কেননা, প্রজ্ঞার দেবতা নিজের হাতে ‘বুক অভ থোথ’ লিখেছেন। যা হোক। ‘বুক অভ থোথ’ নাকি ভয়ানক বই; সেটি পাঠ করলে নাকি যন্ত্রণা আর দর্দশা নেমে আসে। কারণ দেবতাদের সমস্ত গুপ্ত কথা আর নক্ষত্রের মাঝে যেসব কথা লুকোনো থাকে- সে সবই নাকি ‘বুক অভ থোথ’-এ লেখা রয়েছে!



প্রাচীন মিশরের মানচিত্রে হার্মোপোলিস নগরের অবস্থান। সুপ্রাচীন কালে এ নগরেই গড়ে উঠেছিল চন্দ্রদেব থোথ- এর উপাসনা। চন্দ্রদেব থোথ ছিলেন দেবতাদের দূত। আর গ্রিক দেবতা হার্মেসের ছিলেন দেবতাদের দূত। এ কারণেই গ্রিকরা নগরটির নাম দেয় Hermopolis.

হার্মোপোলিস নগরটি নীল নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল। নগরটির অবস্থান ছিল থিবস এবং মেমফিস নগরের মাঝামাঝি । (যেহেতু আমরা প্রাচীন মিশরের ইতিহাস এবং উপকথা সম্বন্ধে জানছি, কাজেই কিছু বিষয়বর্হিভূত তথ্যের উল্লেখ হয়তো এক্ষেত্রে অসঙ্গত হবে না) ... প্রাচীন মিশরীয় ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন। (সময়কাল ১৩৫১-১৩৩৪ খ্রিস্টপূর্ব) প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় চিন্তার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তাঁর সময়ে দেবতা আমুন ছিলেন মিশরের প্রধান দেবতা। চতুর্থ আমেনহোটেপ বহু দেবদেবী ভিত্তিক প্রাচীন মিশরীয় সমাজে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দেবতা আমুন-এর উপাসনার বদলে সূর্যদেব আতেন-এর উপাসনার উদ্যেগ নিয়েছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ । নিজের নাম বদলে রাখেন: ‘আখেনাতেন।’ অর্থাৎ ‘আতেন এর দাস।’ রাজধানী থিবস থেকে সরিয়ে আখেতাতেন নগরে নিয়ে আসেন। আখেতাতেন শব্দটির অর্থ ‘আতেন এর দিগন্ত’। এই আখেতাতেন নগরটি ছিল হার্মোপোলিস নগরটির ঠিক অপর পাড়ে, অর্থাৎ নীল নদের পূর্ব পাড়ে।



হার্মোপোলিস নগরের বেবুনরূপী দেবতা থোথ-এর ভাস্কর্য।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতার বেবুনরূপ আমাদের আধুনিক মনকে বিচলিত করে। তবে প্রখ্যাত মিশরতাত্ত্বিক Sir Ernest Alfred Thompson Wallis Budge মনে করেন যে দেবতা থোথ দেবতা রা -এরই প্রকাশ। এ কারণে তিনি লিখেছেন: ...Egyptian religion to be primarily henotheistic where all the gods and goddesses were aspects of the God Ra, similar to the devas in Hinduism. In this view, Thoth would be the aspect of Ra which the Egyptian mind would relate to the heart and tongue.



হার্মোপোলিস নগরের নকশায় দেবতা থোথ- এর উপাসনালয়ের অবস্থান।

চন্দ্রদেব থোথ-এর অনেক উপাধি ছিল। যেমন, ‘দেবতাদের সান্নিধ্যে মাত- এর দলিল লেখক’; ‘মাত-এর প্রভূ’;‘ স্বর্গীয় শব্দের প্রভূ’; ‘দুইজন যুদ্ধরত দেবতার বিচারক’; ‘দেবতাদের শান্তিরক্ষী’;‘ দ্বিগুন দেবতা’,‘অতি মহৎ দেবতা’ ইত্যাদি। ১২৪০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত ‘প্যাপিরাস অভ অনি’ নামক একটি প্যাপিরাস পান্ডুলিপির লেখক দাবি করেন, ‘আমি তোমার লেখার পাত্র, ওহ থোথ, এবং আমি তোমার কালির দোয়াত এনেছি। আমি তাদের মতো নই, যারা পবিত্র স্থানে পাপাচার করে; আমায় যেন অশুভ স্পর্শ না করে!’



htc Thoth

আশ্চর্য হলেও সত্যি-প্রাচীন মিশরের চন্দ্রদেব থোথ আজও আমাদের জীবন কে কোনও না কোনও ভাবে স্পর্শ করে । প্রখ্যাত সেলফোন নির্মাতা htc তাদের একটি স্মার্টফোনের নাম রেখেছে প্রাচীন মিশরের চন্দ্রদেব Thoth-এর নামে!

(Thoth শব্দটির যথার্থ বাংলা উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। প্রিয় ব্লগার অন্ধ আগুন্তকের কল্যাণে নিশ্চিন্ত হলাম। এখন আমি জানি Thoth এর সঠিক বাংলা উচ্চারণ থোথ। )




প্রাচীন সমাধি সৌধের দেওয়াল গাত্রে দেবতা Thoth.

ছবি: ইন্টারনেট।

তথ্যসূত্র:

http://www.egyptartsite.com/thoth.html

http://gwydir.demon.co.uk/jo/egypt/thoth.htm

Click This Link

http://www.pantheon.org/articles/t/thoth.html

Click This Link
http://looklex.com/egypt/hermopolis.htm
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১১ রাত ৯:৪৭
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×