উনিশ শতকের কলকাতা। শহরটির পশ্চিম প্রান্তে বইছে গঙ্গা নদী। সে নদী কত বিস্ময়কর ঘটনারই না সাক্ষী। ‘১৬৯০ সনের ২৪ আগষ্ট। জোব চার্নক নামলেন গঙ্গাতীরের সুতানুটির ঘাটে। 'বুনো, জংলী, জলাকীর্ণ সুতানুটি।’ (পূর্ণেন্দু পত্রী। পুরনো কলকাতার কথাচিত্র। পৃষ্ঠা,১০৯) জোব চার্নক গঙ্গাতীরে নামার পর থেকেই তো জেগে উঠল কলকাতা। ঠিক সে রকমই গঙ্গাতীরে আরেকটি রূপকথার মতন এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল। যে বিস্ময়কর ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিনজন বিশিষ্টি বাঙালি সাধক। এদের একজন রামকৃষ্ণ পরমহংদেব, অন্যজন সারদা মা এবং স্বামী বিবেকানন্দ।
সময়টা ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ। এগারো বছরের একটি ছিপছিপে সুশ্রী বালিকা নদীর তীরে জল নিতে এসেছে। অত্যন্ত রূপবতী শাড়ি পরা বালিকাটির দীঘল কালো চুল, চোখ দুটি যেন আয়ত হরিণ চোখ, গায়ের রং তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। নদীতে একটি বজরা নৌকা ভেসে চলেছে। বজরায় রাজচন্দ্র নামে এক যুবক বন্ধুদের সঙ্গে তীর্থে যাচ্ছিল। হাস্যজ্জ্বল বন্ধুদের মধ্যে রাজচন্দ্র কে কেমন বিমর্ষ দেখায়। তার কারণ আছে। তার পর পর দুটি স্ত্রী মারা গিয়েছে।তার আর বিবাহ করার ইচ্ছে নেই; রাজচন্দ্র দীর্ঘ এক নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে। সহসা রাজচন্দ্রর দৃষ্টি গঙ্গা তীরের সুশ্রী বালিকাটির দিকে পড়ে। সে গভীর বিস্মিত হয়ে পড়ে। রূপমুগ্ধ রাজচন্দ্র তৎক্ষনাৎ বজরা নদীর ঘাটে বাঁধার নির্দেশ দেয়। বন্ধুদের অতি সত্ত্বর বালিকাটি সম্বন্ধে খোঁজখবর করতে পাঠায়।
জানা গেল বালিকার নাম রাসমণি (জন্ম ১৭৯৩ সন)। বাবার নাম হরেকৃষ্ণ দাস, জাতি কৈবর্ত। হরেকৃষ্ণ দাস সব শুনলেন। তবু পাত্র সম্বন্ধে খোঁজখবর করলেন। জানা গেল রাজচন্দ্র বেশ ধনী। লবন ও চিনির ব্যবসা ছাড়াও আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে পাত্রের । তা ছাড়া ইংরেজদের কৃপাদৃষ্টি তো রয়েছেই । সবচে বড় কথা হল- রাজচন্দ্র মাহিষ্য গোত্রীয়- অর্থাৎ পালটি ঘর। ড. অতুল সুর লিখেছেন, ‘বর্তমানে চাষী কৈবর্ত্যরা, তার মানে উচ্চশ্রেণীর কৈবর্ত্যরা ‘মাহিষ্য’ নামে পরিচিত।’ (বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। পৃষ্ঠা ; ৪৯; জিজ্ঞাসা । কলকাতা।)
সুতরাং বিয়ে হয়ে গেল। রাজচন্দ্র টের পেলে তার নবপরিণীতা বধূটি অত্যন্ত তেজস্বিনী, ধর্মপরায়ণা এবং সুলক্ষণা। সুলক্ষণা এই কারণে যে- বিয়ের পর থেকে রাজচন্দ্রের ব্যবসাবানিজ্য যাকে বলে একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল।
দেখতে দেখতে রাসমণি চারটি কন্যার জননী হলেন । তিন মেয়ের বিবাহ দিলেন। তৃতীয় কন্যাটি অবশ্য বেঁচে রইল না। সে কন্যার জামাইয়ের নাম মাথুরনাথ বিশ্বাস। ছেলেটি বিনয়ী সৎ এবং ধার্মিক। রাসমণি চতুর্থ কন্যার সঙ্গে মাথুরনাথ- এর বিয়ে দিলেন। এবং মাথুরনাথ কে এসটেটের ম্যানেজার নিযুক্ত করলেন।
রাজচন্দ্র মারা গেলেন । স্বামীর শ্রাদ্ধের সময় দু’হাতে দান করলেন রাসমণি। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘শূলপানির মতে, সম্বোধন পদের দ্বারা আহুত উপস্থিত পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে হবিত্যাগের নাম শ্রাদ্ধ।রঘুনন্দন বলিয়াছেন যে, বৈদিক প্রয়োগাধীন আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাপূর্বক অন্নাদি দানের নাম শ্রাদ্ধ।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস। ২য় খন্ড। মধ্যযুগ। পৃষ্ঠা ২৪৩) তো, শ্রাদ্ধ কয়েক ধরণের হতে পারে। যেমন, দানসাগর নামে এক ধরনের শ্রাদ্ধ আছে। এটি প্রয়াত স্বামীর হিতকামনায় করা হয়ে থাকে। তো, বিধবা রাসমণি সেই দানসাগর শ্রাদ্ধে দুদিন ধরে মুঠো মুঠো ধন ধান করলেন। তারপর করলেন তুলট। ‘বড় একটি দাড়িপাল্লা-শুদ্ধ বস্ত্র পরিহিতা রাসমণি বসলেন একটি পাল্লায়, অন্যটিতে মুদ্রা তোলা হল। রাসমণি দেহের ওজন হল ছয় হাজার সতেরোটি মুদ্রার সমান। পন্ডিত ব্রাহ্মণদের মুদ্রাগুলি দান করা হল।’ (রণজিৎ কর: সনাতনধর্ম : মত ও মতান্তর। পৃষ্ঠা;১২০)
রাজচন্দ্র মৃত্যুর আগে কলকাতার মানুষ রাসমণির নাম জানত না। কারণ রাজচন্দ্রের মতো ধনী কলকাতা শহরে আরও অনেকেই ছিল। ধনীদের বউঝিদের নাম দিয়ে কে মাথা ঘামায়। কিন্তু, কলকাতার মানুষ রাজচন্দ্রের শ্রাদ্ধের পর বলাবলি করতে লাগল: ‘হ্যাঁ, রাণী রাসমণি দয়ালু বটে।’ স্বামীর নাম রাজচন্দ্র হওয়ায় রাসমণির নামের আগে মুখে মুখে ‘রাণী’ যোগ হয়ে গেল। রাণী রাসমণি সত্যিকারের রাণী ছিলেন না বটে, তবে পৃথিবীর অনেক রাণীই তাঁর সমকক্ষ ছিল না। কেননা, রাণী রাসমণি অকাতরে দান করছেন। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিষয়-সম্পত্তি। অতুল বিত্ত বৈভবে মধ্যে থেকেও রাণী রাসমণি অত্যন্ত শুদ্ধাচারিণী। বিশেষ বিশেষ তিথিতে ভূমিশয্যা গ্রহন করেন।
রাণী রাসমণি ছাড়া তৎকালীন কলকাতার ধনীদের মধ্যে আরেকটি ঋষিসম মানুষ বিলাসব্যসন ত্যাগ করেছিলেন । তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।তবে রাণী রাসমণির সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কিছু দ্বন্দের কথা জানা যায়।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর রাণী রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্রের কাছ থেকে দু লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন। সেই টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না -পারাতে ঠাকুরদের জমিদারির একটি পরগণা রাণী রাসমণি অধিগ্রহন করেন।দ্বন্দের এই কারণ। আবার সেই অর্থনৈতিক দ্বন্দ ধর্মীয় রূপ নিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নিরাকার ব্রাহ্ম ধর্মে বিশ্বাসী। অপরদিকে রাণী রাসমণি পুজা করতেন সাকার ঈশ্বরের । এ নিয়ে দুটি বনেদি পরিবারের সূক্ষ্ম রেষারেষি থাকতে পারে। এবং সেজনেই হয়তো রাণী রাসমণি বিশাল একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছিলেন। এবং এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সূত্রেই রাণী রাসমণি পরিচিত হবেন রামকৃষ্ণ নামে এক বিদগ্ধ সাধকের সঙ্গে। দেহ ছাড়া যেমন আত্মাকে কল্পনা করা যায় না তেমনি রাণী রাসমণি ছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা ভাব অকল্পনীয় ...
রাণী রাসমণি একবার কাশী গিয়ে তীর্থ করবেন বলে মনস্থ করলেন। কাশী অনেক দূরের পথ। এবং সে পথ নিরাপদ নয়। কাজেই বজরায় অস্ত্রধারী প্রহরী এবং ছয় মাসের জন্য দরকারি খাদ্যদ্রব্য তোলা হল ।গঙ্গায় পঁচিশটি বজরা ভাসল । সে যা হোক। বজরা ভেসে চলেছে। এক রাতে রাণী রাসমণি স্বপ্ন দেখলেন। স্বয়ং মা কালী তাকে বলছেন, ‘গঙ্গাতীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা কর। আমি তোর হাতের পুজা গ্রহন করব।’ তারপর ঘুম ভাঙল বটে কিন্তু রাণী রাসমণির ঘোর কাটে না। স্বপ্নকে একেবারে সত্যি মনে হল।
পরদিনই রাণী রাসমণি বজরা থামানোর নির্দেশ দিলেন। সমস্ত জিনিসপত্র স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কলকাতার জানবাজারের বাড়িতে ফিরে এলেন । ম্যানেজার (মেয়েজামাই) মথুরবাবুকে ডেকে রাণী রাসমণি বললেন গঙ্গার তীরে জমি দেখতে।
গঙ্গার পূর্বতীরে দক্ষিণেশ্বর গ্রামে সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি পাওয়া গেল বটে তবে দাম হাঁকা হল সাড়ে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা। রাণী রাসমণি কিনে নিলেন চুয়ান্ন বিঘা জমি এবং অবিলম্বে মন্দিরের কাজ শুরু করার নির্দেশ দিলেন । শ্রমিকরা গঙ্গার তীর বাঁধিয়ে ফেলল। তৈরি হল বিরাট স্নানের ঘাট; নির্মিত হল দ্বাদশ শিবমন্দির, বিষ্ণুমন্দির, নবরতত্ন চূড়াযুক্ত কালী মন্দির ও নাট মন্দির। শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত বইতে এসব মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
এদিকে ব্রাহ্মণরা বলল, জানবাজারের জমিদার পত্নী রাণী রাসমণি জাতে শূদ্র। তিনি মন্দির নির্মাণ করলে তা হবে অশাস্ত্রীয়। রাণী রাসমণি হতাশ হলেন। এদেরই স্বামীর শ্রাদ্ধে নিদের দেহের ওজনের সমান ছয় হাজার সতেরোটি মুদ্রার সমান ধনরত্ন দিয়েছিলেন।রাণী রাসমণি হতাশ হলেন তবে ভেঙে পড়লেন না । তিনি আরও মুদ্রা ব্যয় করে ব্রাহ্মণদের মুখ বন্ধ করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণরা এবার বললেন, মন্দিরের যাবতীয় সম্পদ কোনও ব্রাহ্মণকে দান করতে হবে।তারপর সেই ব্রাহ্মণ যদি মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন আর অন্নভোগের ব্যবস্থা করেন তবেই মন্দির প্রতিষ্ঠা শ্রাস্ত্রসম্মত হবে । নৈলে নয়।
তো, সেরকম একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিতে খোঁজ করা হল। এবং পাওয়াও গেল। তো সেই ব্রাহ্মণের নাম রামকুমার ভট্টাচার্য। রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরটি রামকুমার ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করলেন। রামকুমারের বাড়ি যদিও হুগলীর কামারপুকুরের জয়রামবাটি গ্রামে। তবে তিনি কলকাতাতেই থাকেন। কলকাতার ঝামাপুকুরে একটি টোল খুলেছেন তিনি । গ্রাম থেকে সতেরো বছর বয়েসি ছোট ভাই কে নিয়ে এসেছেন। ভাইয়ের নাম গদাধর। চমৎকার গান করে গদাধর। যাত্রাপালার গান একবার শুনলেই মনে রাখতে পারে। তো, গদাধর সর্ম্পকে আরও কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার । কারণ গদাধরই ভবিষ্যতের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
গদাধরের পুরো নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায় । ওই হুগলীর কামারপুকুর জয়রামবাটি গ্রামেই জন্ম ১৮৩৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বাবার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়, মায়ের নাম চন্দ্রমনি দেবী। পরিবারটি অতিশয় দরিদ্র। বালক গদাধরকে পাঠশালায় পাঠানো হয়েছিল ; সে অংকে ভালো ছিল। তুখোর উপস্থিত বুদ্ধি। নতুন নতুন ধাঁধাঁ তৈরি করার বিরল প্রতিভা ছিল। তবে ওই দারিদ্রের কারণেই লেখাপড়া বেশিদূর এগুলো না। পারিবারিক পেশা মূর্তিগড়া। বালক তাই করতে লাগল। তারপর তো বড়ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় চলে এল।
রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরটি রামকুমার ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন ধার্য করা হল জ্যৈষ্ঠ পৌর্ণমাসী তিথিযোগে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার দিন (৩১ মে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ)। এক লক্ষ অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা হল। সেই সঙ্গে আর ও অনেক মানুষ যোগ দিয়েছিল সে উৎসবে। রাণী রাসমণির নির্দেশ ... কেউ যেন না খেয়ে যায়, দান গ্রহন না করে যায়। একজন ধর্মপরায়ণা ও দানশীলা নারী হিসেবে রাণী রাসমণির নাম এরই মধ্যে কলকাতা ছাড়িয়ে গয়া-কাশী-মথুরা বৃন্দাবন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
দক্ষিণেশ্বর রানী রাসমনির মন্দিরের ওপর ব্লগার রাজীব দে সরকারের একটি পোস্ট
রামকুমার ভট্টাচার্যই নিযুক্ত হলেন দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের প্রথম পূজারী। কিন্তু মন্দিরের প্রতিদিনের পুজা এবং অন্যান্য কাজ তিনি একা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি গ্রাম থেকে মেজভাই রামেশ্বরকেও ডেকে আনলেন। সেই সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই গদাধরকে মাসিক ৫ টাকা বেতনে মন্দিরের সেবায়েত নিযুক্ত করা হল। গদাধর ছিলেন সহজ সরল এবং সৎ। সবাই তঁাঁকে সমীহ করত। এমন কী রাণী রাসমণির জামাতা /ম্যানেজার মথুরবাবুও। গদাধর রাণী রাসমণির দৃষ্টি আকর্ষন করলেন। রাণী রাসমণি গদাধরকে স্নেহ করতেন। হয়তো গদাধরের চোখে নির্মল ধ্যানী দৃষ্টি দেখে বিস্মিত হয়ে যেতেন। পরে রাণী রাসমণির স্নেহ পর্যবেশিত হল শ্রদ্ধায় ।
১৮৫৯ সন। গদাধরের বয়স ২২ কি ২৩। বিয়ে করলেন সারদাদেবীকে। সারদাদেবীর বয়স তখন মাত্র ৬। ছেলেপুলে হয়নি। সারদাদেবী বাঙালির কাছে সারদা মা নামে পরিচিত। সারদা মা পরম প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। বলেছিলেন, “সন্তোষের সমান ধন নেই, আর সহ্যের সমান গুণ নেই।" এ পোস্টের শুরুতে বলেছিলাম ... কলকাতা শহরটির পশ্চিম প্রান্তে বইছে গঙ্গা নদী। সে নদী কত বিস্ময়কর ঘটনারই না সাক্ষী। রাণী রাসমণি, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, সারদা মা, স্বামী বিবেকানন্দ, বেলুর মঠ ... এতগুলি দেবালয় এবং এতগুলি আলোকিত মানুষ গঙ্গাপাড়ের দক্ষিণেশ্বর গ্রামে একসূত্রে বাঁধা পড়ল -এ কি বিস্ময়কর নয়?
১৮৬২ সন। রাণী রাসমণি মারা গেলেন। ততদিনে গদাধর চট্টোপাধ্যায় আপন আত্বিক শক্তিতে ঠাকুর রামকৃষ্ণে উত্তীর্ণ হয়েছেন, ভক্তদের কাছে পরমহংসদেব নামে পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু এই পরমহংসদেব শব্দটির অর্থ কি? উইকিপিডিযায় লিখেছে: Paramahamsa (পরমহংস), also spelled paramahansa or paramhansa, is a Sanskrit religio-theological title of honor applied to Hindu spiritual teachers of lofty status who are regarded as having attained enlightenment.
মথুরবাবু অবশ্য রাণী রাসমণির মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের দেখাশোনা করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর অবশ্য রাণী রাসমণির পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম রামকৃষ্ণের আর কোনও খোঁজখবর নেয়নি।
কিন্তু, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কেন এত বিখ্যাত?কেন আমি একুশ শতকে বসে তাঁর কথা লিখছি? কেন তাঁর বাণী শ্রবণ করার জন্য আজও ভক্ত বাঙালি এত ব্যাকূল বোধ করে, অস্থির হয়ে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যায়। কেন তাঁর জীবনী ও বাণী অনুদিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ? বোধকরি এর প্রথম কারণ ঠাকুর রামকৃষ্ণ সমাজের বিদ্যমান অনাকাঙ্খিত অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণটি অত্যন্ত স্পস্ট করেই চিহ্নিত করেছিলেন। সমবেত ভক্তদের সামনে ক্রমাগত ধনসম্পদ (কাঞ্চন) ও নারীলিপ্সার (কামিনী) বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখতেন । মধুর ভাষায় বলতেন, ‘কামিনী -কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়, এই পর্যন্ত। কিন্তু এতে ভগবান লাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এর নাম বিচার। বুঝেছ।’(শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। পৃষ্ঠা, ১৮)
রামকৃষ্ণ নিজে কিছু লিখেননি। ভক্তদের সামনে কথা বলতেন একেবারে তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে, ভাষায়। অত্যন্ত সহজ সরল যে ভাষাটি ছিল হুগলী জেলার গ্রামীণ ভাষা। ভক্তদের রামকৃষ্ণ বলতেন:
‘ঈশ্বরের নাম গুণ গান সর্বদা করতে হয়। আর সৎসঙ্গ -ঈশ্বরের ভক্ত বা সাধু, এঁদের কাছে মাঝে মাঝে যেতে হয়। সংসারের ভিতর ও বিষয় কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মন হয় না। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হ’লে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন।
যখন চারাগাছ থাকে, তার চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে।
ধ্যান করবে মনে কোণে ও বনে। আর সর্বদা সদসৎ বিচার করবে। ঈশ্বরই সৎ, কিনা নিত্যবস্তু, আর সব অসৎ, কিনা অনিত্য। এই বিচার করতে করতে অনিত্য বস্তু মন থেকে ত্যাগ করবে।
সব কাজ করবে। কিন্তু মন ঈশ্বরে রাখবে। স্ত্রী পুত্র বাপ মা সকলকে নিয়ে থাকবে ও সেবা করবে। যেন কত আপনার লোক। কিন্তু মনে জানবে যে তারা তোমার কেউ নয়।
কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায় কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান? -আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি পড়ে আছে। সংসারের সব কর্ম করবে কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে।
তেল মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা না হলে হাতে আটা (গ্রামীণ উচ্চারণ) জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরের ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়।
কিন্তু এই ভক্তি লাভ করতে হলে নির্জন হওয়া চাই। মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয়। দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না। তারপর নির্জনে বসে সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয়। তবে মাখন তোলা হয়।
আবার দেখ, এই মনে নির্জনে ঈশ্বরের চিন্তা করলে জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয়। কিন্তু সংসারে ফেলে রাখলে ঐ মন নীচ হয়ে যায়। সংসারে কেবল কামিনী-কাঞ্চন চিন্তা।’ (শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। পৃষ্ঠা, ১৭)
শ্রীম কথিত রামকৃষ্ণের বাণী শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত পাঠ করতে করতে এই ভেবে বিস্মিত বোধ করি যে রাণী রাসমণি দেবী কালী কৃত্বর্ক স্বপ্নে গঙ্গা পাড়ের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার আদেশ পেলেন; কিন্তু রাণী রাসমণি স্বপ্নেও কি ভেবেছিলেন যে দক্ষিণেশ্বরের কালি মন্দিরের ৫ টাকা বেতনের গদাধর চট্টোপাধ্যায় নামে হুগলীর এক গ্রামের এক সেবায়েত ভবিষ্যতে হয়ে উঠবেন ভারতবিখ্যাত এক সাধক? যাঁর ভক্তেরা আজও আকূল হয়ে রামকৃষ্ণকথামৃত পাঠ করে, দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যান? এতে করে বোঝা যায় রামকৃষ্ণে ভক্তদের জীবনে রামকৃষ্ণের ভূমিকা আজও অটুট।
কিন্তু, বাংলার সামাজিক ইতিহাসে ঠাকুর রামকৃষ্ণে ভূমিকা ঠিক কোথায়?
ব্যাখ্যা করছি। রামকৃষ্ণ ছিলেন ভারতীয় ঐতিহ্যের দুটি বিরোধী ধারাক ধারক। তার মানে রামকৃষ্ণ ছিলেন একই সঙ্গে বেদান্তবাদী এবং তান্ত্রিক। ‘রামকৃষ্ণ’ নামটি তিনিই নিজেই গ্রহন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তাঁর দেহে লীন হয়ে রয়েছেন পৌরাণিক ত্রেতাযুগের অবতার রাম এবং দ্বাপর যুগের ভগবান কৃষ্ণ । রাম হলেন ভারতবর্ষের লোকায়ত ঐতিহ্যের প্রতীক এবং কৃষ্ণ হলেন বহিরাগত আর্য সংস্কৃতির প্রতীক। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজেকে এই দুই ধারার মিলনস্থল ভেবেছিলেন। বেদান্ত দর্শন আর্যদের চিন্তাভাবনা এবং তন্ত্র হল অনার্য লোকয়ত চিন্তাভাবনা । রামকৃষ্ণ ছিলেন এই দুটি চেতনার প্রচারক। অর্থাৎ তিনি ছিলেন পরস্পর বিরোধী ধারার একই অভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার পক্ষপাতী, বিরোধ কে জিইয়ে রাখা তাঁর মনঃপূত ছিল না। ‘যত মত তত পথ’- রামকৃষ্ণের এই গভীর উপলব্দিহাত উদ্ধতিটি বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহু উচ্চারিত এবং বাংলার ইতিহাসে এই উদ্ধৃতিটির এক গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ব্যাখ্যা করি। উনিশ এবং বিশ শতকের বাংলায় রাজা রামমোহন রায় থেকে বিধানচন্দ্র রায় বহু কীর্তিমান বাঙালির জন্ম হয়েছিল। এঁদের সাধনায় বাংলার সাহিত্য- বিজ্ঞান-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন উনিশ শতকে বাঙালির ধনসম্পদের ওপর চলছিল ইংরেজ বেনিয়াদের নিমর্ম শোষণ। ছিয়াত্তরের (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) মন্বন্তর বাঙালির স্মৃতিতে তখনও দগদগে ঘায়ের মতো বিরাজ করছিল। গ্রামীণ এবং শহুরে বাঙালি পরিনত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন-শোষনে জর্জরিত এবং দিশেহারা। জাতি হিসেবে নিঃশেষিত হওয়া আগে টিকে থাকবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা শোষিত বাঙালি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচন্ড তাগিদ বোধ করে । একটি মহাযুদ্ধ যে আসন্ন সেটি তারা উপলব্দি করে। তবে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি সমাজ নানা ধর্মমতে বিভক্ত। তা সত্ত্বেও সেই মহাযুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষসহ সাধুসন্ন্যাসী, ফকিরদরবেশ, আলেম উলামা পীরদরবেশ প্রত্যেকেই আত্মহূতি দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই সামাজিক বৃহৎ ঐক্যের মুহূর্তে রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’-এই সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত বাঙালি কে নিশ্চয়ই গভীর ভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল । কাজেই রামকৃষ্ণের এই অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণেই বাঙালি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতেই হবে। বাংলার সামাজিক ইতিহাসে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভূমিকা এখানেই ...
আগে একবার উল্লেখ করেছিলাম দেহ ছাড়া যেমন আত্মাকে কল্পনা করা যায় না তেমনি রাণী রাসমণি ছাড়া রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা ভাবও অকল্পনীয় .. ঠিক সেরকমই ঠাকুর রামকৃষ্ণের আলোচনায় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ বিশিষ্ট বাঙালি যোগী স্বামী বিবেকানন্দর (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) প্রসঙ্গটি অনিবার্যভাবেই এসে যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দর দীক্ষাদাতা, মন্ত্রদাতা, অর্থাৎ গুরু । কিন্তু, স্বামী বিবেকানন্দ ঠাকুর রামকৃষ্ণর অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা কতটা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন? এই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। এ প্রসঙ্গে ড. আর. এম দেবনাথ তাঁর ‘সিন্দু থেকে হিন্দু’ বইতে লিখেছেন: “রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ১৮৯৮ সালে কাশ্মীরে একটি সাত-আট বছরের মুসলমান মেয়েকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করেন। (কৃষ্ণ কুমার দাস:প্রবন্ধ: কুমারী যখন দেবী: সংবাদ প্রতিদিন: কলকাতা: ২৬.৯.৯৮)। এই নিষ্পাপ ও পবিত্র মেয়েটি ছিল মাঝির কন্যা।” (পৃষ্ঠা, ৯০)
বিস্তারিত পাঠ করুন-
Click This Link
তথ্যসূত্র:
শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (দে’জ পাবলিশিং । মাঘ ১৪০৮)
Click This Link
রণজিৎ কর: সনাতনধর্ম : মত ও মতান্তর (রুক্কু শাহ ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স; ফেব্রুয়ারি ২০১২)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: প্রথম আলো (আনন্দ পাবলিশার্স)
এ আর দেবনাথ : সিন্ধু থেকে হিন্দু (রিডার্স ওডেজ; ২০০১)
http://en.wikipedia.org/wiki/Ramakrishna
উৎসর্গ: দীপান্বিতা অনেক দিন ধরেই যে আমাকে বলে আসছিল উনিশ শতকের কলকাতার ওই আলোকিত মানুষগুলি সম্বন্ধে লিখতে
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ১২:৩৯