somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: চোরা-শিকারি

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জিপের গতি সামান্য কমিয়ে নয়ন চাকমা বলল, কক্সবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চোরা-শিকারীরা তৎপর। রামুর রির্জাভ ফরেস্টে পোচাররা ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে প্রায় ৪০টি হাতি হত্যা করেছে।
অজন্তা চমকে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলল, চল্লিশ!
হ্যাঁ, চল্লিশ। চোরা-শিকারীরা হাতির দাঁত ও হাড় বিদেশে পাচার করেছে। হাতির দাঁত অনেক দামি। একেকটা দাঁত কম করে হলেও ৩ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়।
সামনের সিটে অজন্তার পাশে বসেছিল তানিম। ও হাতিদের অসহায় মৃত্যুর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। ও বুঝতে পারে- ও ওর পরিচিত জগৎ ছেড়ে সম্পূর্ন ভিন্ন এক জগতে চলে এসেছে। যে জগতে চোরা শিকারীরা হাতি শিকার করে হাতির দাঁত বিদেশে পাচার করে। ও জিজ্ঞেস করে, নয়নদা, পোচাররা কীভাবে হাতি মারে? গুলি করে না?
হ্যাঁ।
ওহ্ ।
অজন্তা বিষন্ন বোধ করে। কলেজের ছুটিটাই বুঝি ম্লান হয়ে গেল। অজন্তার কাজিন হাসনাত ভাই শখের প্রকৃতি বিজ্ঞানী। রামুর গর্জনিয়া জঙ্গলে বুনো হাতি নিয়ে গবেষনা করছেন। অজন্তার ওর বন্ধুদের নিয়ে অনেক দিন ধরেই রামু আসার কথা; নানা কারণে আসা হচ্ছিল না। এবারের শীতে কলেজ ছুটি হতেই ও আর সুযোগ হাতছাড়া করেনি। ঘন্টাখানেক আগে ওর সঙ্গে হাসনাত ভাইয়ের মোবাইলে কথা হয়েছে। গর্জনিয়া পৌঁছতে এখনও ঘন্টা খানেক বাকি।
নয়ন চাকমা বাঁ দিকে টার্র্ন নেয়। নীল টি-শার্ট পরা ২২/২৩ বছরের এই শান্ত শিষ্ট প্রকৃতির চাকমা তরুণটি হাসনাত ভাইয়ে গবেষণা সহকারী। নয়ন চাকমার বাড়ি কচ্ছপিয়া। কচ্ছপিয়া জায়গাটা নাকি রামুর বাকখালী নদীর দক্ষিণে। কচ্ছপিয়ার দক্ষিণে দক্ষিণ কচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সেখানেও নাকি চোরাশিকারীরা সমানে হাতি নিধন করে চলেছে। এসব নিয়েই হাসনাত ভাই উদ্বিগ্ন।
দীপন পিছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে;ওর কানে সাদা রঙের হেডফোন। অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে ও। চোখ জানালার বাইরে। শীতের দুপুর। বুনো পাহাড়ি এলাকায় মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে আছে। রামু ছাড়িয়ে পুব দিকে ছুটছে নীল রঙের টাটা সুমো। রাস্তার দু’পাশে ইউক্যালিপ্টাস গাছ, ছোট ছোট টিলা; টিলায় রাবার গাছ, আনারস ক্ষেত।
তানিম জিজ্ঞেস করে, পোচারদের হাত থেকে হাতিদের বাঁচানোর জন্য সরকারি ভাবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নয়নদা?
বাঁচানোর ব্যবস্থা আর কী-স্থানীয় প্রভাবশালী মহল আর বনকর্মীরা যখন চোরাচালানীতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। বলে নয়ন চাকমা হর্ন দেয়।এক স্থানীয় মহিলা রাস্তা পাড় হচ্ছিল। কাঁধে শিশু।
তাই বলে ... তাই বলে ... অজন্তা বলে। ওর কথা শেষ হয় না।

গর্জনিয়ার রির্জাভ ফরেস্টে হাসনাত ভাইয়ের বাংলো- ‘প্রকৃতি’। কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা সবুজ রং করা একতলা কাঠের বাড়ি।ঝকঝকে লালটালির ছাদে সোলার প্যানেল। ছোট্ট আঙ্গিনায় দর্পিত ভঙ্গিতে একটা রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। আঙিনার উত্তর পাশে একটা উচুঁ কামরাঙা গাছ। গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা মাঝবয়েসি ছাই-ছাই রঙের একটা মাদী হাতি । হাতির নাম: ‘পাশা’। মাহুতের নাম নাকি দামু। এসব নয়ন চাকমার মুখেই শুনেছে ওরা। (তবে ঝর্নায় পানি আনতে গিয়েছে বলে দামু নামের মাহুতকে ওরা এখনও দেখেনি।)
সন্ধ্যা নামছিল। বেলা শেষের বনভূমিতে কাকপাখির তীব্র চিৎকার। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। আকাশে পূর্ণিমার মস্ত এক চাঁদ। চাঁদের আলোয় কাঁটাতারের ওপাশে একটা টিলা চোখে পড়ে । টিলায় আনারস ক্ষেত। হাসনাত ভাই স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে আনারস চাষ করেন। রাজহাঁসের খামাড়ও আছে। লাভের টাকায় গবেষনার কাজ চলে।
ওরা বাংলোর বারান্দায় বসেছে। বেতের টেবিলের ওপর একটা ট্রে। তাতে ধোঁওয়া ওঠা কয়েকটি কফির কাপ। আর একটা বড় প্লেটে চানাচুর। পাশে একটা ইংরেজি বই। ডেভিড থমসন- এর ‘হিস্টি অভ মুঘল ইন্ডিয়া’। বেশ ঢাউশ বই। হাসনাত ভাই পড়ছেন সম্ভবত। ওরা এরই মধ্যে রাজ্যের বাংলা-ইংরেজি বই ঠাসা এ বাড়ির লাইব্রেরিটা দেখেছে। হাসনাত ভাই কত যে পড়াশোনা করেন!
নয়ন চাকমা মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। হাসনাত ভাই কফির কাপ তুলে নিয়ে তার দিকে তাকালেন। হাসনাত ভাইয়ের শরীরটি হালকা-পাতলা। বেশ লম্বা আর ফরসা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর জ্যাকেট । হাসনাত ভাই বিজ্ঞানী হলেও চোখে অবশ্য চশমা-টশমা নেই।
নয়ন চাকমা ফোন অফ করে বলল, রতন ফোন করেছিল । ও বলল কচ্ছপিয়ায় এই মাত্র একটা হাতির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পোচাররা দাঁত কেটে নিয়েছে। রাতে হয়তো পুঁতে ফেলবে। বনবিভাগের লোকজন নাকি এখনও পৌঁছায়নি ওখানে।
অজন্তার ভুঁরু কুঁচকে যায়। তখন নয়নদা বলছিল যে কচ্ছপিয়ার দক্ষিণে দক্ষিণ কচ্ছপিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সেখানেও নাকি সমানে হাতি নিধন চলছে। এ নিয়ে হাসনাত ভাই ভীষণ উদ্বিগ্ন।
হাসনাত ভাইয়ের ফরসা মুখ কী রকম টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন, পোচাররা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে । নয়ন তোমার কি মেেন হয় কাজটা জয়নাল গ্রুপের?
হ্যাঁ।
জয়নাল গ্রুপ মানে?
জয়নাল হল রামুর পোচার দলটার নাটের গুরু। লোকটার বাড়ি নাইক্ষংছড়ি। লোকটা আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় স্মাগলিং করত। বেশ কয়েক বার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে সে। এখন লাখ লাখ টাকার লোভে বন্য হাতি হত্যাযজ্ঞে মেতেছে।
তানিম বলল, পোচাররা কীভাবে দেশের বাইরে হাতির দাঁত পাচার করে? বার্মার বর্ডার দিয়ে?
হাসনাত ভাই বললেন, না, না স্থলপথে নয়। হাতির দাঁত ওরা পাচার করে জলপথে ।
জলপথে! আশ্চর্য!
হুমম। কক্সবাজারে চোরা-শিকারীদের স্পীডবোট তৈরি থাকে। কোনও বিদেশি জাহাজে তুলে দেয়।
এই সব আশঙ্কাজনক কথাবার্তার মধ্যেই একটা কাঠবেড়ালী আঙিনার ডুমুর গাছ থেকে আঙিনায় পার্ক করে রাখা টাটা সুমোর ছাদের ওপর লাফ দেয়। ওই গেছো জন্তুটা শুন্যে থাকতেই দীপন -এর আট মেগার সাইবার শটের ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে। কী সুন্দরর দৃশ্য। অজন্তা দেখছিল। কিন্তুু অসহায় হাতিদের জন্য ওর বেশি খারাপ লাগছিল। ও জিজ্ঞেস করে, কিন্তু ... কিন্তু হাতিদের বাঁচানোর কি কোনও ওয়ে নেই?
হাসনাত ভাই বললেন, আছে। প্রোবাবলি। আজ রাতেই আমি একটা স্টেপ নিতে যাচ্ছি। দেখি কী হয়। এখন চল, খেয়ে নিই। বলে ‘দামু’ ‘দামু’ বলে কাকে যেন ডাকলেন হাসনাত ভাই।
বেঁটে মতন তামাটে রঙের মাঝবয়েসি একটা লোক এল। পরনে খাকি হাফপ্যান্ট আর নীল রঙের গেঞ্জি। এই লোকটাই তাহলে মাহুত? কী ব্যাপার লোকটার শীতটিট করে না নাকি। অজন্তা অবাক হয়ে ভাবল। লোকটার মাথা মসৃনভাবে কামানো। কানে লোহার রিং। কব্জিতে পিতলের বালা। গলায় কাইতনে বাঁধা রুপার তাবিজ।
দামু বলল, জ্বী, বাবু।
তোর রান্না হয়ে গেছে?
জ্বী, বাবু।
ঠিক আছে। চল, তাহলে আমরা খেয়ে নিই। বলে উঠে দাঁড়ালেন হাসনাত ভাই
খাওয়ার ঘরটায় বাঁশের তৈরি চেয়ারটেবিল। ভাত, কুচো চিঙির ভর্তা, বনমোরগের ঝাল ঝাল তরকারি আর পাহাড়ি লেবু কচলে খেতে চমৎকার লাগল। অপূর্ব স্বাদ হয়েছে রান্নার। হাসনাত ভাই বললেন- রান্নাবান্না নাকি দামুই করে। মাহুতকে বেশ কেজো লোক মনে হল দীপন- এর।
খাওয়ার পর ওরা আবার বারান্দায় এসে বসল।আঙিনায় টলটলে জ্যোস্না। এক ঝলক হিমেল বাতাস বারান্দার টবের স্ট্রবেরি গাছের পাতা এলোমেলো করে দেয়।
একটু পর দামু বারান্দায় এল। হয়তো এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে এল। হাসনাত ভাই বললেন, তোরা তাহলে এখন যা দামু। ঝর্নার ধারে থাকবি।
দামু নিঃশব্দে আঙিনায় নেমে কামরাঙা গাছের দিকে যায়। তারপর পাশার বাঁধন খুলে হাতির পাশাপাশি ফটক দিয়ে বেড়িয়ে যেতে থাকে। ধবল জ্যো¯œায় হাতিটাকে কেমন যেন কালচে দেখাচ্ছিল।
দীপন বলে, হাসনাত ভাই?
বল।
চোরা- শিকারীরা রামুর জঙ্গলে হাতি ছাড়া আর কিছু শিকার করে?
হুমম। হরিণ। শুনলে তোরা অবাক হবি। চোরা-শিকারীরা হরিণ শিকার করে শখ করে।
কী! শখ করে?
হ্যাঁ। শ্রেফ শখ করে।
আশ্চর্য! এরা কি সবাই অন্ধ হয়ে গেছে! তানিমের কন্ঠস্বরে আর্তনাদ ফুটে ওঠে।
নয়ন চাকমা বলল, অন্ধই। নইলে ২০১৭ সালের মধ্যেই সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে কেন?
দীপন চমকে ওঠে। তানিম জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, হাসনাত ভাই। যখন কোনও হাতি মারা যায় তখন বনবিভাগের লোকজন কি বলে?
নয়ন চাকমা বলল, কী আর বলে। বলে হাতি অসুস্থ হয়ে মারা গেছে কিংবা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে ।
পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য!
হাসনাত ভাই বললেন, নয়ন, এখন যাও। ঘর থেকে ক্যামকোডারটা নিয়ে এসো।
নয়ন চাকমা ভিতরে চলে যায়। অজন্তা ভাবছিল তখন হাসনাত ভাই বললেন, হাতিদের বাঁচানোর একটা উপায় আছে। খুব শিগগির তিনি একটা স্টেপ নেবেন।কি স্টেপ? রামু আসার পরই এমন একটা অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ছে ভেবে অজন্তা মৃদু উত্তেজনা টের পায়।
নয়ন চাকমা একটু পরে ফিরে এল। হাতে একটা সনি হ্যান্ডিক্যাম ক্যামকোডার। ভিডিও করবে বলে মনে হল। কিসের ভিডিও? তানিমের কপালে ভাঁজ পড়ে।
হাসনাত ভাই ঘড়ি দেখলেন। তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, এখন বের হই।
ওরা ধবধবে সাদা রঙের চাঁদের আলোর ভিতর হেঁটে আঙিনা পাড় হয়ে মূল ফটকের বাইরে চলে এল। পায়ের নীচে শিশির ভেজা শুকনো পাতা। নির্জন জ্যোস্নাস্নাত স্তব্দ
বনভূমি। বাতাসে শিশির-মাখানো বুনো লতাপাতার মাদক গন্ধ।ঝিঁঝির একটানা ডাকে কান পাতা দায়।মাঝে মধ্যে শব্দটা হঠাৎই স্তব্দ হয়ে যাচ্ছে। যখন দূরে শেয়ালের ডাক শোনা যায়।
হাঁটতে-হাঁটতে অন্তরার জীবনানন্দ দাশ- এর একটি কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে যায়। কবিতার নাম ‘ক্যাম্পে’।

এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি-
কাহারে সে ডাকে!

কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রান পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকে
বসন্তের রাতে।

কত কত বছর আগে জীবনানন্দ দাশ অসহায় হরিণদের কথা ভেবে ব্যথিত হয়েছিলেন। উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। আজ এতকাল পরও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় নি। আজও রামুর বনেজঙ্গলে বছরে শতাধিক হরিণ প্রাণ হারাচ্ছে লোভী শিকারীদের নির্বিচার গুলিতে!
অজন্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তানিম সরসর জলের শব্দ শুনতে পেল। তখন হাসনাত ভাই দামুকে ঝর্নার কাছে যেতে বললেন। ও ভাবল- আমরা কোথায় যাচ্ছি? হাসনাত ভাই কোনও কারণে সাসপেন্সে রেখেছেন।
জঙ্গলের ভিতরে এঁকেবেঁবে পিচ রাস্তা চলে গেছে।একপাশে বুনো জাতের পাহাড়ি ঘন গাছপালার প্রাচীর । অন্যপাশে টিলা। টিলার ওপর থেকে গড়িয়ে ঝরনা পানি পড়ছে। নীচে জ্যেস্নার আলোয় আলোকিত ছোট্ট একটি টলটলে পানির জলাশয়। পাড়ে কয়েকটি বড় বড় পাথর। জলাশয়ে পাশা কে দেখতে পেল ওরা, শুঁড় দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে।চাঁদের আলোয় অপরূপ এক দৃশ্য। দামুকে অবশ্য আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না।
হঠাৎ দীপনের চোখে পড়ল দৃশ্যটা। ঝর্নাতলায় কয়েকটি ছায়ামূর্তি। একটি ছায়ামূর্র্তির হাতে বন্দুক। ওর শরীর হিম হয়ে আসে। হাসনাত ভাই চাপাস্বরে বললেন, কুইক। তোর এই পাথরের আড়ালে চলে আয়।নয়ন তুমি পজিশন নাও।
ওরা একটা পাথরের আড়ালে চলে আসে।গুটিশুটি মেরে বসে। অজন্তার বুক কাঁপছিল। নয়ন চাকমা ঠিক ওর পাশে হাতে ক্যামকোডার নিয়ে ঝুঁকে বসেছে। হাসনাত ভাই ফিসফিস করে বললেন, ওই যে লোকটাকে দেখছিস ...গলায় মাফলার জড়ানো ...হাতে বন্দুক ...ওর নামই জয়নাল। ওই পোচার দলটার নাটের গুরু। জয়নালের ঠিক বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাঙ্কিটুপি পরা লোকটার নাম ইয়াসিন। তার পাশে আজম আর সুরেশ। আজম এর বাড়ি খুনিয়াপালং, জায়গাটা বঙ্গোপসাগরের পাড়ে। ওখানেই রেজু খাল। সুরেশ- এর লোকেরাই ওই রেজু খালে স্পীডবোট তৈরি করে রাখে।
ওহ্ ।
জয়নাল বন্দুক তুলে পাশার দিকে তাক করে।
গুডুম!
মাঝরাতের নির্জনতা খানখান হয়ে ভেঙে যায়।হঠাৎই ঘুম ভেঙে আশেপাশের গাছের পাখিরা ডেকে ওঠে।
পাশা আগের মতোই অবিচল যেন কিছুই হয়নি।
কী হল? গুলি লাগেনি? দীপন ফিসফিস করে বলে। ওর কন্ঠস্বর কাঁপছিল।
হাসনাত ভাই বললেন, লেগেছে। তেবে-
তবে?
বলছি। একটু পর।
তানিম আড়চোখে দেখল নয়ন চাকমা ক্যামকোডারটা দিয়ে ভিডিও করছে।
গুডুম! গুডুম! গুডুম!
আবারও মাঝরাতের নির্জনতা খানখান হয়ে ভেঙে যায়।পাশা আগের মতোই অবিচল। যেন গায়ে টোকাটি লাগেনি। অজন্তা অবাক। ও অবাক হয়ে দেখে সেই নাটের গুরু জয়নাল পড়ে গেল মাটিতে।ঠিক তখনই ও তীক্ষ্ম হুইশিল শুনতে পেল।গা ঝাড়া দিয়ে জলাশয় থেকে উঠে ইয়াসিন, আজম আর সুরেশ-এর দিকে তেড়ে যায় পাশা। পাশাকে দেখে তিন চোরাশিকারীর সে কী দৌড়!
অজন্তা বলে, কী হল?ওরা পালিয়ে গেল যে!
ওদের পালাবার দরকার আছে। হাসনাত ভাই হাসতে হাসতে বললেন।
দরকার আছে, মানে?
দরকার আছে মানে - ওরা না পালালে দলের অন্যদের কে বলবে হাতি মারতে এসে এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা।দাঁড়া সব খুলে বলছি,আগে মহব্বত উল্লাহ মহব্বত উল্লাহ সাহেবকে একটা ফোন করি।। বলে মোবাইল বের করলেন হাসনাত ভাই। তারপর কার সঙ্গে যেন কথা বললেন। তারপর ফোন অফ করে বললেন, বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মানে ডিএফও কে ফোন করলাম। তিনি রামু উপজেলার ইউএনও আর ওসি কে নিয়ে এখুনি রওনা হচ্ছেন। হাসনাত ভাইয়ের কথা শেষ হল না। মাটি ফুঁড়ে যেন দামু বেরিয়ে এল।
হাসনাত ভাই বললেন, দামু। দেখ তো পাশার গায়ে চোট লেগেছে কিনা।
দামু একটু পর ফিরে এসে বলল, না বাবু। পাশা ঠিকই আছে।
তানিম বলল, ওই জয়নাল লোকটা কি মরে গেল নাকি ?
হাসনাত ভাই বললেন, না জয়নাল মারা যায়নি। অজ্ঞান হয়েছে।
অজ্ঞান হয়েছে মানে?
আহা ওকে জীবিত ধরতে হবে না। তাই দামু লোকটাকে তীর ছুড়ে অজ্ঞান করেছে।
মানে?
তীরের ফলায় চেতনানাশক তরল মাখানো আছে।
চেতনা নাশক তরল মানে?
বুঝলি না। দামু এই অরণ্যের সন্তান। দামুরা হাজার বছর ধরে এ অরণ্যে বসবাস করে আসছে। ওরা জানে কী করে চেতনা নাশক তরল তৈরি করতে হয়। এখন থেকে অরণ্যচারী এই মানুষেরাই পোচারদের হাত থেকে বুনোপ্রাণিদের বাঁচাবে দেখবি। আমরা কেবল ওদের আধুনিক টেকনোলজি দিয়ে সাহায্য করব।
কয়েকজন লোক বুনো শিকড়বাকর দিয়ে জয়নালকে বাঁধছে।
ওরা কারা? তানিম জিজ্ঞেস করে।
হাসনাত ভাই বললেন, ওরা দামুর গোত্রের লোকজন। ওরা আমার আনারস ক্ষেতে আর রাজহাঁসের খামাড়ে কাজ করে। এরাই এখন পোচারদের হাত থেকে বুনো হাতিদের বাঁচানোর জন্য একজোট হয়েছে।
ওহ্।
দীপন বলল, জয়নালকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই পোচার দের সব বেরিয়ে আসবে ।
হাসনাত ভাই বললেন, হুম। নয়ন তো ভিডিও করেছে।
কিন্তু, এখনও মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। অজন্তা বলল। ওর কন্ঠস্বরে অনুযোগের সুর।
হাসনাত ভাই বললেন, বুঝলি, পোচাররা যেভাবে নির্বিচারে নিধনযজ্ঞ শুরু করেছে তাতে জঙ্গলে রণ-হাতি না- নামিয়ে উপায় ছিল না।
রণ হাতি মানে? চশমার ওপাশে অজন্তার চোখ দুটি দেখার মত হল।
বলছি।আমি আগেই বুঝেছি, পোচারদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টেকা যাবে না। রামুর এসব বনেজঙ্গলে প্রায় কয়েক ’শ চোরা শিকারী ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাজেই আমাকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হল। আমি ওদের ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও ব্যাপারটায় ঝুঁকি ছিল।
এবার মনে হয় কিছু বুঝতে পারছি। দীপন বলল। মিটমিট করে হাসছিল ও।
হ্যাঁ। আইডিয়াটা পেলাম ইতিহাসের বই থেকে। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের মুগলরা যুদ্ধবিগ্রহের সময় রণ-হাতি ব্যবহার করত। তারা হাতিদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য হাতির শরীরে এক ধরণের পাতলা লোহার পাত মুড়িয়ে দিত। আমিও তাইই করেছি। যাতে হাতির গায়ে গুলি না লাগে। আমার বন্ধুু মেজর মাহবুব ইমরান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আছে। ওই আর্মি ওয়ার্কশপ থেকে পাশার স্টিলের আর্মারটা বানাতে সাহায্য করেছে। বন বিভাগের ডিএফও সাহেবকে এই পরিকল্পনার কথা আমি আগেই জানিয়ে রেখেছি।
আশ্চর্য! তাই তুমি ডেভিড থমসন- এর ‘হিস্টি অভ মোগল ইন্ডিয়া’পড়ছিলে? অজন্তা বলে।
হুমম। হাসনাত ভাই মিটমিট করে হাসছিলেন।
ভাগ্যিস পাশার চোখে গুলি লাগেনি। তানিম বলল।
শয়তানদের তাক অত ভালো না। বলে অজন্তা হি হি করে হেসে উঠল।
হাসনাত ভাই বললেন, একটা কথা ভেবে দেখ তোরা। এই দামুরা হাজার বছর ধরে এই অরণ্যপ্রকৃতিতে বেঁচেবর্তে আছে। বুনো হাতিরা কতবার যে ওদের গ্রাম ধ্বংস করেছে, আনারস ক্ষেত তছনছ করেছে।কিন্তু, কখনও ওরা বুনো হাতিদের ধ্বংস করেনি। বরং পাশাপাশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। ভেবে দেখ, বুনো হাতিরা পোচারদের কোনও ক্ষতি করেনি। অথচ লোভী পোচারমারা টাকার লোভে বুনো হাতি হত্যা করছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। এই দামুরা ইচ্ছে করলেই অঅনায়াসে হাতি হত্যা করে দাঁত বিক্রি করে দিতে পারে। ওরা অরণ্যের সন্তান বলেই লোভী নয়। আর লোভী নয় বলেই হাতিদের মেরে ফেলে না।
গাছপালার ফাঁকে হেড লাইটের আলো চোখে পড়ল।
হাসনাত ভাই বললেন, ওরা এসে পড়েছে। ডিএফও মহব্বত উল্লাহ কড়া মেজাজের লোক। এবার জয়নাল গ্রুপ মজা টের পাবে।
অজন্তা বুনো শিকড়বাকর দিয়ে বাঁধা জয়নাল-এর দিকে তাকায়। পোচার দলের নাটের গুরুর করুণ ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাসি পেল ওর।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১৮
২০টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×