যে ভাষার জন্যে সালাম বরকতেরা রক্ত দিলো/ বাহান্ন সালের লড়াই আমার আমি জন্ম নিলো।/.../ যে ভাষার জন্যে এমন হন্যে, এমন আকুল হলাম।
আহ্, কি যে সুর বেঁধেছন সুমন। চোখ ভিজে যায়। তিনিই লিখেছেন,
প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবো ব'লে/ হে আমার আগুন তুমি আবার ওঠো জ্বলে।.... বেঁচে থেকে মরার দেশে তোমার রাজ্য রাখা/ পুড়িয়ে খাক ক'রে দাও মিথ্যে বেঁচে থাকা।/ আমি তো বসেই আছি আগুন জ্বলবে বলে।
সুমনই আমাদের দেখিয়েছেন কী করে সাধারণ মানুষ আর মানুষের ব্যবহৃত অতি তুচ্ছ আটপৌরে জিনিস নিয়ে বাঙ্ময় গান বোনা যায়। টবের ফুল, সিগারেট, রুটি, বিস্কুট আরো কত কী তাঁর গানে! এই যে আমাদের চিরচেনা পরিবেশও যে গানের মধ্যে কি চমৎকার করে জায়গা করে নিয়েছে, আগে কি কখনো ভেবেছি আমরা? শুদ্ধ তাই নয়, সুমন আমাদের আশাবাদী করে তোলেন। তিনি বলেন, হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোড়ে। তিনিই বলেন, যাও গান আনবিক বোমাটাকে ধরো।...যাও গান গিয়ে বিজ্ঞানিকে বলো, ধ্বংসের তত্ত্বটা ভুলে যাই চলো।
বাংলাদেশের শক্তিমান কবি শহীদ কাদরীর কবিতা থেকেও গান কেটে বের করেন সুমন। তিনি লেখেন, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, ভয় নেই এমন দিন এনে দেবো, দেখো সেনাবাহিনীর বন্দুক নয় শুধু গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ, করবে তোমার সামনে, শুধু তোমাকেই, তোমাকেই স্যালুট করবে সারা দিনরাত, প্রিয়তমা তোমাকে অভিবাদ।
প্রেমের গানেও সমান পারদর্শী তিনি। আমার মতে তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ প্রেমের গান "প্রথমত আমি তোমাকে চাই" নয়, শ্রেষ্ঠ গানটি হলো:
তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও/ বহু ব্যবহার করা কোন উপমায়/ গীতিকার চর্চিত শব্দের ফেনা/ তোমার তুলনা কোনোদিন জানবে না।
সুমন চট্টোপাধ্যায় এক অধ্যায়ের নাম। বাংলা গানের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের মাইল ফলকের নাম। তাঁকে কবি বললে এক রত্তিও বাড়িয়ে বলা হবে না। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। আপনার প্রতি আমার নমিত মস্তক। কিন্তু জানেন, সুমন আপনার শেষ দিককার সাবিনা স্ক্যান্ডাল আমাকে ব্যথিত করে। কিন্তু তারপরও ঐ গানগুলো তো আপনারই। সেই পুরনো সুমনকে দেখেই তো নচিকেতা আর অঞ্জন গান শুরু করেন। কলকাতা, ঢাকায় শুরু হয় জীবনমুখী গানের জোয়াড়। আমার মনে হয় না জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পর নিজস্ব রীতির এমন গানের বলয় কেউ তৈরী করতে পেরেছেন। সুমন পেরেছেন। স্বকীয়তা তিনি তৈরী করেছেন। তাঁর গানের কথা আর সুর দিয়ে।
আপনি আরো বাঁচুন। পুরনো সুমনের গান শুনে আমরা যে পুলকিত হতাম, ভিজে উঠতো চোখ, গায়ের রোম উঠতো দাঁড়িয়ে, সেই সুমনকে হয় তো ফিরে পাওয়া যাবে না। তারপরও বলবো সুমন আপনি থেমে গেছেন কেন? থামবেন না। আপনার গানের কথাই বলছি আপনাকে,
থেমে যেতে যেতে একবার কোনো মতে/ জোর করে যদি একবার হেঁটে যেতে/ বেঁচে নিতে যদি একবার বড় ভালো হতো।
(এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম আমার বন্ধু তাহসিনুর রহমান নিকোকে।)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৫:২৮