ইংরেজ দুঃশাসনের দু’শো বছর এখনো ইতিহাসের পাতায় দগ দগে ঘা হয়ে আমাদের যন্ত্রণা দেয়। উপনিবেশিক শোষণের জাল তারা ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বময়। তখন বলা হত, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজে কখনো সূর্য অস্ত যায় না’। যদিও তাদের উপনিবেশিকতার যুগ শেষ হয়েছে বহু আগেই তবুও তাদের আভিজাত্য এতটুকু কমে নাই। তারপরও তারা বিশ্বে ভদ্র জাতি হিসাবেই পরিচিত। শুধু কথায় কথায় ‘ধন্যবাদ’ আর ‘স্বাগতম’ বললেই মানুষ ভদ্র হয়ে যায় না। ভদ্র হওয়ার জন্য কিছু মানবিক গুণাবলীও থাকা চাই। ইংরেজদের মতো শোষকদেরও যে কিছু মানবিক গুণাবলী আছে, তা স্বচক্ষে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না।
লন্ডন জীবনের দ্বিতীয় দিনেই পৃথিবী বিখ্যাত পাতাল রেলে চড়ার লোভ সংবরণ করতে পাড়লাম না। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলছিল তখন। প্রচণ্ড শীত। এর মধ্যেই বেড়িয়ে পড়লাম। বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই একটা পাতাল রেল ষ্টেশন ছিল। হেঁটেই চলে এলাম। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে হবে। কারণ এই ষ্টেশনে এস্ক্যালেটার নাই। সিঁড়ি ভেঙে যখন নিচে নামছি তখন দেখলাম একজন ভদ্র মহিলা পুশ চেয়ার নিয়ে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সম্ভব নামতে পারছেন না। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আমি সামনে আগালাম। মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেছি, এমন সময় শুনতে পেলাম কে যেন বলছে, ‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি টিনেজার ছেলে ভদ্র মহিলাকে সাহায্য করছে সিঁড়ি ভাঙার জন্য। আমার কী দায় পড়েছে আরেকজনের বোঝা টেনে বেড়ানোর, এই ভেবে মনে মনে একটা ভাব নিলাম। ষ্টেশনের নামার মিনিট খানেকের মধ্যেই ট্রেন চলে আসলো। ষ্টেশনে ভীর কম থাকলেও ট্রেনের ভিতর যথেষ্ট ভীর ছিল। কোন সিট খালি ছিল না। অনেকের মতো আমিও দাঁড়িয়ে আছি। এক মিনিটের মধ্যেই পরবর্তী ষ্টেশনে চলে এলাম। একজন যাত্রী সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নামার জন্য। আমি আগে থেকেই বাজের চোখ নিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলাম কে নামে দেখার জন্য। তাই মুহূর্ত দেড়ি না করে লম্বা পা ফেলে সিটটাতে বসে পড়লাম। চোখে মুখে আমার রাজ্য জয়ের ঝিলিক। মনে মনে বলছি, তোরা এই সব ব্যাপারে আমাদের সাথে পারবি না কোন দিন। আমাদের দেশের লোকাল বাসে চলাচল করার অভ্যাস থাকলে তোরাও পারতি।
দেশে থাকতে রোজ এয়ারপোর্ট থেকে বাস ধরে অফিসে যেতে হত। সেখান থেকেই আমি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। একদিনের কথা মনে হল, আজও মনে মনে হাসি। সকাল সাড়ে আটটায় ছোটখাটো একটা যুদ্ধ জয় করে মালিবাগের বাসে উঠেছি। শরীরটাকে গলিয়ে একটু ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তাতেই বাকী কাজটা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম মোটামুটি বাসের পিছনের দিকে। আবুল হোটেলের কাছে নামতে যেয়েও আবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হল। বীরের মতো দুটো যুদ্ধ জয় করে অফিসে এসেই সরাসরি ওয়াশ রুমে চলে গেলাম ফ্রেস হওয়ার জন্য। চোখে মুখে পানি দেয়ার আগে চশমাটা খুলে নেয়া উচিৎ। কিন্তু চশমা খুলতে যেয়ে দেখি চশমা নাই। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম সকালে বের হওয়ার সময় চশমা পড়েই বের হয়েছি। তারপরও বাসায় ফোন দিলাম কনফার্ম হওয়ার জন্য। বাসায় চশমা নাই। বুক পকেটে হাতিয়ে দেখি তাতেও নাই। তারমানে বাসে ভীরের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি করতে যেয়ে কোন এক ফাঁকে চোখ থেকে চশমাটা পড়ে গিয়েছে। অথচ টেরই পাইনি। তো যা বলছিলাম। সিটের কাছেই একজন দাঁড়িয়ে ছিল। ইচ্ছা করলেই সুড়ুত করে বসে পড়তে পারতো। কিন্তু সে বসে নাই। সে বসে নাই, তাতে আমার কী। ট্রেন ছাড়ার আবার মিনিট দুয়েকের মধ্যে অন্য আরেকটি ষ্টেশনে চলে এলাম। এবার আমার সামনের সিটের যাত্রী নেমে পড়লো। তখনো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, তবু কারো কোন তাড়াহুড়ো নাই সিটটিতে বসার জন্য। মিনিট খানেক হয়ে গেলো সিটটি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সিটটার পাশেই দাঁড়ানো একজন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যজনকে বলছে, ‘আপনি সিটটাতে বসতে পারেন’। তখন অন্যজন ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে বসে পড়লো।
ইংল্যান্ডে বাস এবং ট্রেনে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আলাদা সিট সংরক্ষিত আছে। তবে সিট খালি থাকলে অন্যরাও বসতে পারে। একদিন বাসে উঠলাম। একটা সংরক্ষিত সিট খালি পেয়ে বসেও পড়লাম। কয়েক স্টপেজ পর একজন বয়স্ক যাত্রী উঠলো। কিন্তু আমি একটু অন্য মনস্ক হয়ে মোবাইলে কথা বলছিলাম বলে তাকে দেখি নাই। সিটে বসেই আছি। যাত্রী উঠা শেষ কিন্তু বাস ছাড়ছে না। আমি তখনও মোবাইলে কথা বলছি। তাই কারো কথাও আমার কানে ঠিক মতো আসছিল না। হঠাৎ আমার পাশের সিটের জন বললো, ‘ড্রাইভার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে’। ড্রাইভারের দিকে তাকানোর আগে বয়স্ক লোকটার দিকে চোখ পড়লো। সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে বসতে অনুরোধ করলাম আর ‘দুঃখিত’ বললাম। ‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ আপনাকে’ বলে লোকটা বসে পড়লো। সাথে সাথে বাসও ছাড়লো। ড্রাইভার তখনো কী যেন বির বির করে বলছে। আমি বোকা বনে গেলাম।
এই সব ঘটনাগুলোকে প্রথম প্রথম অস্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় দেখলাম এগুলোই স্বাভাবিক। বরং উল্টোটাই অস্বাভাবিক। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে বেশীরভাগ সময়ই দেখি ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু এই দেশে সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে প্রথমে এম্বুল্যান্স এবং তারপর পুলিশ ডাকবে। রাস্তায় কাউকে অসুস্থ দেখলে যতটা পারি আমরা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আর এই দেশে রাস্তায় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে যে দেখবে সে-ই এম্বুল্যান্স ডাকবে এবং এম্বুল্যান্স না আসা পর্যন্ত রোগীর সাথেই থাকবে। আমি বলবো না যে এই সব আমাদের দেশে হয় না। অবশ্যই হয়। তবে সংখ্যায় এতোই কম যে, সেটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। তাইতো পরের দিন পত্রিকায় উঠে আসে ওইসব ঘটনা।
স্কুল জীবনেই ইংরেজ ছেলেমেয়েরা এই ধরণের শিক্ষা পেয়ে থাকে। পাশাপাশি পরিবারের অন্য সবার কাছ থেকেও এই শিক্ষা পাচ্ছে। তাই এই সব মানবিক গুণাবলী তাদের রক্তে ঢুকে পড়েছে। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু বলছি না। তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। আমাদের দেশেও যদি স্কুল জীবনে এই ধরণের মানবিক গুণাবলীর ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া হত এবং পারিবারিকভাবেও যদি এর চর্চা হতো, তবে আমরা ইংরেজদের চাইতে আরও বেশী ভদ্র জাতিতে পরিণত হতে পারবো। কারণ এগুলোর সাথে যোগ হবে বাঙালীর স্বভাবজাত বিনয়ী আচরণ, ধর্মপরায়ণতা, অতিথিপরায়ণতাসহ আরও বেশ কিছু গুণ, যা ইংরেজদের মধ্যে নেই বললেই চলে। জার্মান কবি Johann Wolfgang von Goethe এর একটা উক্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘A man’s manners are a mirror in which he shows his portrait.’
(ধারাবাহিক হলেও প্রতিটা পর্ব স্বতন্ত্র)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৯