মাথার উপর গনগনে সূর্যটা সেই উপুর হয়েছেতো হয়েছেই। বিরামহীন উত্তাপ ঢালছে। খোলা চোখে তাকানো যায়না চারপাশে এমন ঝাঝাল রোদ। একটি পরিত্যক্ত বাস ছাউনির নীচে দাড়িযে রাজু। ভাঙ্গাচোরা হলেও বেশ খানিকটা জায়গা ছায়া করে আছে। একটা কুকুর জিভ মেলে বসে আছে। রাজুর দিকে একবার ফিরে দেখল। আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই দেখে সেই যে ফিরেছে একমনে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে লকলকে জিভ বের করে।
রাজু চারপাশে তাকায়। একটু বাতাসও নেই। গাছগুলো থির দিয়ে আছে। গলাটা খটখটে শুকিয়ে গেছে। একটু পানি পেলে ভাল হতো। সকালে সেই যে শুকনো আলুভাজা আর কাঁচা লংকা দিয়ে চটকে কোন রকমে চারটে ভাত পেটে চালান করে বেরিয়েছে, এই অব্দি আর খাওয়ার কোন নাম নেই।
হাতে কপালের ঘাম মোছে। শুকনো ঠোট জিভ দিয়ে চেটে ভেজাতে চায়। নোনতা স্বাদে মূখটা বেঁকে যায়। চামড়ার ছাল ওঠা ঘড়ি দেখে। ৩টার উপরে বাজে। এ অফিস সে অফিস ঘুরছে সকাল থেকে। যেখানে যত বিজ্ঞাপন পায় কেটে নেয় রাজু। ঢু মারে সব জায়গায়। লাভ হয়না। মনে হয় লাভ হবেও না। তবুও নিরন্তর চেষ্টা চলে।
পেটটা মুচরে ওঠে। ভাঙ্গা টুলটার ধূল ঝেড়ে বসে পড়ে রাজু। এইতো ক'টা দিন। অথচ জীবনটা কেমন আমুল বদলে গেল। একটু ক্ষিদে পেলে কি হইচই। তোলপার কান্ডে ছূটে আসতেন মা। সবাইকে বকে নিজেই বাড়িয়ে দিতেন এটা সেটা। কোনদিন খাবার দেরী হয়েছে তো দশবার তাগাদ দিতেন। তারপর নিজেই এনে দিতেন টেবিলে। এখন - - -!!!
হঠাৎ কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে ওঠে। কেমন যেন খারাপ লাগতে থাকে। ছেলেবেলার মতো ভিজে আসতে চায় দুই চোখ। কি যেন এক নিরব অভিমানে, ক্ষোভে নিজের উপরই নিজে ক্ষেপে ওঠে রাজু। কষ্টগুলো নিরুপায় দ্রোহে জ্বলতে থাকে। ক্ষুধার কষ্ট ভুলে যায়। ভুলে যায় চারপাশ। এই ভুল। ভুলের কোলেইতো বাড়ে যতো নষ্টের মহীরুহ। বিস্তার করে সাম্রাজ্রবাদী ঢালপালা। মুছিয়ে দেয় বিবেক, বোধ, নীতি নৈতিকতা, ভালমন্দ, আপন পর - - -। রাজুর ভেতর রাজু চীৎকার করে ওঠে। বাইরে আসেনা সে শব্দ। কেবল মাঝে মাঝে ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে।
মাকে খূব কাছে পেতে ইচ্ছে করে রাজুর। মার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। উত্তাপ ঠিকরে আসা পিচ গলা রাজপথ। সাঁই সাই ছুটে চলা গাড়ী। দমকা গরম হাওয়া কিছুই ছুঁতে পারেনা তাকে। ছেলেবেলার মতো মার কোলে শুয়ে বলতে ইচ্ছে করে- মাগো, বিশ্বাস করো। আমি চাইনি। জানিনা কিভাবে যে কি হয়ে গেল? আমাকে তুমি অন্তত বিশ্বাস করো, মা। রাজু ফুঁপিয়ে ওঠে আপন মনে। রাজু ভুলে যায় মা সবার মায়ার বাঁধন কাটিয়ে চলে গেছে আজ ১৯ দিন। মাকেও হয়তো এতো আগে যেতে হতোনা! বোধহয় রাজুর জন্যই যেতে হলো। মনে সমস্ত ক্ষোভ দলা পাকিয়ে ওঠে। হঠাৎ একটা পাথর তুলে প্রচন্ড আক্রোশে ছুড়ে মারে। অল্পের জন্য কাঁচ বেঁচে যাওয়া গাড়ীর আরোহী যেতে যেতে ভীত বিস্মিত চোখে দেখে রাজুকে।
আত্ম অপরাধ রোধে আচ্ছন্ন রাজু দু:খ, কষ্ট হতাশায় তলিয়ে যায়। মাগো, বাবা আদমের রক্তই কি আমাদের প্রবঞ্চিত করে। বারবার গন্ধম গন্ধে ভুলে যাই সব। মা হাওয়ার উত্তর রক্তই কি নির্বোধ অভিমানে সব ভাসিয়ে নেয়। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সংযম সব ধুয়ে মুছে এ কোথায় দাড় করিয়ে দেয় মানবকে? হয়তো পৃথিবীর কেউ মানবেনা মা, কিন্তু তুমিতো জানো, আমি জানি, আল্লাহ জানে - - তুমি কত ন্যায় বিচারক ছিলে!
নষ্টালজিয়ায় ডুবে যায় রাজু। ভুলে যায় ক্ষুধা, ক্লান্তি, তাপ, সময়। সেদিন বৃষ্টি ভেজা ছিল। পুরো তিনদিন গুমোট করা মেঘলা দিনের শেষে ঝরঝর ঝরেছিল বর্ষা। কেউ দেখেনি সেদিন আকাশের চেয়ে গভীর র্বষায় ভিজেছিল দুটি মন চারটে চোখ। রাজু আর তার মা। হযরত উমর কাঁদেন নি। ছেলেকে শাস্তি দিয়ে, রাজুর মা পারেন নি। মা'তো। প্রেমিকার সাথে মিথ্যা ব্যাভিচারের অপবাদের শাস্তি বাস্তবায়নে রাজুর মাকে দিয়েই বাস্তবায়ন করানো হয়েছিল হীন হিংস্র জিঘাংসা চরিতার্থে। আর প্রিয়তমার অদ্ভুত নিরবতায়, তার বিস্ময়কর নিরবতায় রাজু কষ্ট পেয়েছিল তারচেও বেশী। সেই শত বেতের আঘাতে বাহ্যিক ওজন হয়তো ছিলনা। কিন্তু কে বুঝবে প্রতিটি আঘাতে দু'জনেই গুড়িয়ে গিয়েছিল মাটিতে। কি অন্তর্জ্বালা! কি নির্মম যাতনার কষাঘাত! কি অসহনীয় কষ্টের শাস্তির সে সময়টুকু।
মা'র দুপায় জড়িয়ে অঝোর কেঁদেঝিল রাজু। মাতো অজ্ঞানই হয়ে গেছিলেন। শুধু বলেছিলেন আর কখনো গন্ধম নেশায় ডুবিসনে বাবা! যা! যেদিকে দু'চোখ যায় চলে যা! মাও কি বিশ্বাস করেছিল তবে? রাজু হতবাক!
তারপর! ছেলে শোকে না এমন ঘটনার আঘাতেই অল্প ক'দিনের মাথায়ই রাজুর মা রাজুর পিতার ডাকে চলে গেলেন। রাজু তখনো পথে পথে ভাসছে। ভাসতে ভাসতেই হঠাৎ শোনে সে খবর। তারপর ছুটে যায়! কিন্ত ততক্ষনে দেরী হয়ে গেছে। কবর হয়ে গেছে মার। তারপরও কবরের বুক থেকেই এক মুঠো মাটি নিয়ে বিরবির করে- ফিহা খালকনা কুম, ওয়া ফিহা নুয়িদুকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম, তারাতান উখরা.... ছিটিয়ে দেয় মাটির বুকে। অঝোরে কাঁদে আর কাঁদে। ফোটা ফোটা চোখের জলে ভিজে আসে কবরের মাটি।
তীব্র হর্ণে ধরফর করে জেগে ওঠে রাজু । সেই টুলেই প্রচন্ড গরমে তন্দ্রচ্ছন্নতায় ক্লান্তিতে শুয়ে পড়েছিল রাজু। হঠাৎ খেয়াল হল তার চোখ দুটো জলে ভেজা। স্বপ্নর মতো ঘটা ঘটনাগুলো স্বপ্নে দেখে আবারো কেঁদেছে রাজু। উঠে বসে। চোখ মোছে শার্টের হাতা উল্টিয়ে।
এতক্ষনে ক্ষিধেটা আবার মোচর দিয়ে ওঠে। পকেট হাতড়ায় রাজু। গুড়ো পয়সা মিলিয়ে মোটে তেইশ টাকা। আরো চারদিন পর এক সম্পাদক লেখক সম্মনীর চারশ টাকা আনতে যেতে বলেছেন। এই চারদিন এ দিয়েই চলতে হবে। টাকা পয়সা আবার চালান করে দেয় পকেট। খানিকটা দূরে একটা সরকারী টেপ থেকে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। চারপাশে জমে থাকা পানিতে কয়েকটা পাখি ঠোট ভেজাচ্ছে। কেউ নেই চারপাশে। কেবল শুন্যতায় ঝাঁঝাল রোদ এক একাই খেলছে বাঁধানো চাতালে।
এগিয়ে যায় রাজু। পাখি গুলো ডানা ঝাপটে সরে যায়। রাজু ধীরে ধীরে টেপ ছাড়ে । প্রথম হাত ছোয়াতেই ছিটকে আসে হাত। রোদে যেন ফুটছে পানি। অনেকক্ষন ছেড়ে বসে থাকে। পারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঝড়ছে পানি। পাখি গুলো আবার লাফিয়ে লাফিয়ে একটু একটু করে কাছে আসে। কলে হাত দিয়ে রাজু পেট পুরে পানি খায়। তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে বা হাতের হাতা উলটে মুখ মুছে আবার পথে নামে।
প্রতি পদক্ষেপে রাজুর মোহ শুকনো পাতার মতো গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। কোন মোহ নেই। কোন পিছুটান নেই। এখন রাজু এক। বন্ধনহীন । বেঁচে থাকার চেষ্টায় ছুটে চলে । হাতের ফাইল দিয়ে রোদকে আড়াল করে রাজু হাটতে থাকে গন্তব্যহীন গন্তব্যে।
( গল্পটা ইন্টার প্রথম বর্ষের দিকে লেখা। কাল পুরানো ফাইল ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ নজরে এলো।
আপনাদের মূল্যবান মতামতের জন্য আপনাদের করকমলে )
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:০৭