১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান ছাত্রনেতা হিসেবে স্বীকৃত প্রবাদপুরুষ আবদুল মতিন ৮ অক্টোবর ২০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময়েই ২৪ মার্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কনভোকেশনের ভাষণে পাকিস্তানের বড় লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে, কথাটা উচ্চারণের পর পর মতিনের কণ্ঠ থেকেই প্রথম উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদ ‘নো নো’ ধ্বনিত হয়েছিল। আবার ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে ১১-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অমান্য করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী ছাত্রদেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই আবদুল মতিন। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তটিই পাস হয়েছিল তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে, এটুকুও ইতিহাস। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়টায় ভাষা আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত রাখার জন্য তাঁর সাধনার স্বীকৃতি হিসেবেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই তিনি ‘ভাষা–মতিন’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন, যে নামে তিনি আজীবন বাংলাদেশের আপামর জনগণের পরম শ্রদ্ধাভাজন নেতার আসনে অভিষিক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই যেহেতু বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার, তাই ভাষা–মতিন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার।
ভাষা–মতিন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সত্ত্বেও মতিন এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একজন অগ্রনায়ক ছিলেন, সে জন্য তাঁর রাজনৈতিক সাথিদের কাছে তিনি ছিলেন কমরেড আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলনের পরের বছর মতিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকের ‘লালটুপি’ কৃষক আন্দোলনেরও প্রাণপুরুষ ছিলেন মতিন। চারু মজুমদারের নকশালবাড়ী আন্দোলনের চরমপন্থী কৌশল দ্বারা প্রভাবিত মতিন-আলাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী গ্রুপের তৎপরতা স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকশ্রেণী অর্থাৎ সরকারের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে ১৯৭২ সালেই মতিন গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন প্রায় চার বছর, ১৯৭৬ সালে তিনি মুক্তি পান। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ভাঙা-গড়ার আত্মঘাতী ধারাবাহিকতায় গুরুত্ব হারালেও সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি তিনি।
আবদুল মতিনকে অধিকাংশ মানুষ ভাষা মতিন বলে চেনেন এবং জানেন। ভাষা মতিন হিসেবে তার পরিচয় একদিক থেকে সঙ্গত; তবে এটি তার সম্পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরে না। তিনি একসময় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এটা ঠিক। কিন্তু সেটা ঘটেছিল ১৯৫২ সালে। এরপর তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেটি ছিল অনেক বড় জায়গা। সেখানে তিনি আর ভাষা আন্দোলন করেননি, রাজনৈতিক আন্দোলন করেছেন। তাঁর আন্দোলন ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ভাষা মতিন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করে স্বাধীনতা দেয়া ছিল তাঁর আশা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় তখন দুটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। একটি ছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, যা গঠন করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। আরেকটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এটি গঠন করেছিল শিক্ষার্থীরা, আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন তিনি।
তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই জনসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। তবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মত ছিল, সামনে নির্বাচন। এখন গোলযোগ হলে সরকার একটি অজুহাত পাবে নির্বাচন না করার বা তারিখ পিছিয়ে দেয়ার। কাজেই ১৪৪ ধারা ভাঙা সঠিক হবে না। তত্কালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক তাদের সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিকে জানাতে এসেছিলেন এবং ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙতে নিষেধ করেছিলেন। জনসভায় উপস্থিত শিক্ষার্থীরা সেটি মানেনি। এরপর পাঁচজন পাঁচজন করে বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হলো।
ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা বের হতে শুরু করলে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়। এতে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। পরে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল কলেজ মোড়ে এখন যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে সমবেত হয়েছিল। সেখানে গুলি হলো, শিক্ষার্থীরা নিহত ও আহত হলো। দেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল।
এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় আবদুল মতিন ভাষাসৈনিক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি এর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তের কারণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আবদুল মতিন রাজনীতিতে যোগ দেন এবং দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা সবাই রাজনীতি করেননি। কেউ হয়েছেন আইনজীবী, কেউ ডাক্তার, কেউ আবার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আবদুল মতিন যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু সব পথই তাঁর জন্য খোলা ছিল। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ পাস করেছিলেন। তিনি নামকরা অ্যাডভোকেট হতে পারেন, যেতে পারেন পেশায়ও সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিলে বড় সরকারি কর্মকর্তাও হতে পারতেন।
তত্কালীন আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিলে ক্ষমতায় যেতে ও পরবর্তীতে আরো সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী প্রভৃতি হওয়া তাঁর জন্য কঠিন ছিল না। কিন্তু তিনি যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তা অন্য কেউ নেননি। আবদুল মতিন সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টিতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হলো এবং কর্মীদের ধর-পাকড় শুরু করল সরকার। এত কিছুর পরও আবদুল মতিন কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী ধারাটিকে গ্রহণ করেন। আমরা তাঁর বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিচয়টা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এর কারণ হচ্ছে, এ রাজনীতি আমাদের দেশে সেভাবে বিকশিত হয়নি। কমিউনিস্ট আন্দোলন সফল হলে তাঁর পরিচয় হতো— মতিন একজন বিপ্লবী রাজনীতিবিদ। ভাষাসৈনিক পরিচয় তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। ভাষাসৈনিক পরিচয় তাঁর জীবনের সূচনাকালের। কিন্তু তিনি জীবনের একটি বড় সময় ব্যয় করেছেন রাজনীতি করে।
বিপ্লবী রাজনীতিতে যোগদানের পর আবদুল মতিন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে তিনি নানা বেশ নিতেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষিত আবদুল মতিন সবকিছু ত্যাগ করে চলে যান কৃষকের কাছে। আমাদের দেশে বাম আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা হলো, এর নেতারা কৃষকের কাছে যান না এবং তারা কৃষকের সমস্যাও ঠিকমতো বোঝেন না। তত্ত্বগতভাবে বলা হয়, শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লব করবে। অথচ বাংলাদেশে কৃষক শ্রেণী প্রধান এবং তাদের সংখ্যা শ্রমিকের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কৃষককে গুরুত্ব না দেয়ায় এখানে বাম আন্দোলন শক্তিশালী হয়নি। মওলানা ভাসানীই প্রথম এবং সারা জীবন কৃষকের কথা বলেছেন। তিনি কৃষক সমিতি করেছেন। আবদুল মতিনও কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তত্ত্বগত বিরোধে (কৃষক না শ্রমিক শ্রেণী বিপ্লব করবে) কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেল। কেউ মস্কোপন্থী, কেউ পিকিংপন্থী হয়ে গেল।
আবদুল মতিন ছিলেন পিকিংপন্থী। পরে পিকিংপন্থীরাও একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে গেল। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে তখন বড় বিষয় হিসেবে দেখা হতো। পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের ওপর নিপীড়ন করছে। বিষয়টি জনগণের সামনে প্রত্যক্ষ ছিল। কিন্তু পিকিংপন্থীরা এটাকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে না দেখে তারা ভাবতে শুরু করেন, পাকিস্তানজুড়ে বিপ্লব করবেন। এটা যে সম্ভব ছিল না, তা মওলানা ভাসানী বুঝতেন। কিন্তু বামপন্থীদের অনেকেই তা বুঝতে পারেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন বামপন্থীদের নেতৃত্বে হতে পারত। মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে একেবারে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে এভাবে শোষণ করলে তারা আলাদা হয়ে যাবে। তখন আবদুল মতিন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ন্যাপেই ছিলেন। ১৯৭০ সালের গণঅভ্যুত্থানও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে হলো। পরে বামপন্থীরা সেটি ধরে রাখতে পারেনি। বামপন্থীরা নানাভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের হাতে চলে যায়। এ কারণে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন আবদুল মতিনদের বড় কোনো ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। স্বাধীন হওয়ার পরও মতিন ভাইয়েরা সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং কারাগারে যান। তাদের দাবি ছিল, বাংলাদেশ এখনো স্বাধীন হয়নি। জেল থেকে বেরিয়ে তারা আর সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতি করতে পারেননি। কারণ সেখানে চিড় ধরেছে। এরপর তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
আবদুল মতিনের জীবন ছিল কর্মময়। সেদিকে তাকালে দেখা যাবে উচ্চশিক্ষিত মেধাবী আবদুল মতিন কৃষকের সঙ্গে থেকেছেন, শিখেছেন অনেক কিছু। সমাজ পরিবর্তনে বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার তাঁর ছিল এবং যার জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন, সেটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অতিক্রম করে যায়। তিনি সমাজ পরিবর্তনের আদর্শে বিশ্বাস করতেন এবং সেখান থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। শারীরিকভাবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেননি বলে মানুষ তাকে ভাষা মতিন হিসেবে ডাকত এবং সে পরিচয়ে তিনি পরিচিত হন। তিনি যে একজন বিপ্লবী রাজনীতিক, সে পরিচয় হারিয়ে গেছে।
আবদুল মতিনের চরিত্রে আমরা কৃষকের গুণাবলি দেখতে পাই। কৃষকের মতোই মতিন ভাই সৎ, পরিশ্রমী ও দায়িত্ববান ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণের মধ্যে কৃষকের সরলতা ছিল। তিনি মওলানা ভাসানী স্মৃতি পরিষদে যুক্ত হয়েছিলেন। ভাসানীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। তাঁর রাজনীতির শুরু মওলানা ভাসানীকে দিয়ে। রাজনীতিতে আবদুল মতিন একটি দৃষ্টান্ত। ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের চেষ্টা তিনি করেননি। অনেক বাম রাজনীতিক ছাত্রজীবনে বিপ্লবী রাজনীতি করলেও পরে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন। আবদুল মতিন তা করেননি। তিনি বিপ্লবী রাজনীতির ধারায়ই ছিলেন। তাঁর ধারাটা প্রবল হয়ে ওঠেনি বা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি, সেজন্য আবদুল মতিন সফল রাজনীতিক হতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাংলাদেশের বাম আন্দোলনকে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
পরবর্তী সময়ে চীনের অবস্থানও তাদের ধাক্কা দিয়েছে। এসবের মধ্যেও আবদুল মতিন বিপ্লবী অঙ্গীকার থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তাঁর অঙ্গীকার ছিল কৃষককে মুক্ত করার। তাদের মুক্ত না করলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না— এ উপলব্ধি থেকে কখনো তিনি সরে আসেননি। বলা যায়, আবদুল মতিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধিকে হারালাম। মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবদুল মতিন আমাদের এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন, যদি আমরা তাঁর আদর্শ ধরে রাখি।
জেল জীবন ও মৃত্যু- শোষণ মুক্তির সংগ্রামের তিনি শাসকদের রোষানলে পড়েছেন জীবনে অনেকবার- প্রথমবার গ্রেফতার ও জেল ১৯৪৯, দ্বিতীয়বার গ্রেফতার ও জেল ১৯৫২–১৯৫৩, তৃতীয়বার গ্রেফতার ও জেল ১৯৬২-১৯৬৫, চতুর্থবার গ্রেফতার ও জেল ১৯৭২-১৯৭৭,পঞ্চমবার গ্রেফতার ও জেল ১৯৮৬ সালে।
গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের পর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৪ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁর দেহখানিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। ভাষা আন্দোলনের মাসে এই ত্যাগী আদর্শবান বিপ্লবী ভাষা সৈনিককে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
তাই আজ ইতিহাসের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অতীত সংগ্রাম,ঐতিহ্য, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জানতে হয়। একটা সমাজ চলছে মানে তার একটা নিয়ম আছে। রাজনীতি হল সমাজ পরিচালনার নিয়ম বা সমাজের পরিচালিকা শক্তি। সমাজ যেভাবে চলছে এটা মেনে নেয়া যেমন রাজনীতি, তেমনি জীবনের বিকাশের প্রয়োজনে এটা পাল্টানোও রাজনীতি। ফলে রাজনীতির বাইরে কেউ থাকতে পারেনা। হয় তাকে প্রচলিত নিয়ম মেনে চলতে হয় নতুবা তাকে পাল্টানোর চেষ্টা করতে হয়। যেমনি করে সত্য ও মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেউ নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা ভাবতে পারেনা, তেমনি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকারও কোন সুযোগ নেই। প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় যা চলছে তা মেনে নেয়া অথবা প্রতিরোধ করার। আর নীরব- নিস্ক্রিয় থাকার মানে যা চলছে তাকেই সমর্থন করা। রাজনীতি আমাদের সব কিছুকে নিয়ন্ত্রন করে তাই আমাদেরও দায়িত্ব নিজেদের রাজনীতিকে নির্ধারিত করা। বাঙালি চেয়েছিল বাক স্বাধীনতা, চেয়েছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, চেয়েছিল সামাজিক মেলবন্ধন, চেয়েছিল মাটির বাঁধনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত জীবন। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও জাতি কি পেয়েছে মুক্তজীবন– অর্থনৈতিক মুক্তি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে নুতন প্রজন্মের মুখোমুখি হতে হবে-আমাকে-আপনাকে-সমাজকে-জাতিকে, রাষ্ট্রীয় শাসক গোষ্ঠীকে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুপ্রেরণা যোগায়। অমর হোক ২১ শে ফেব্রুয়ারী, সফল হোক মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম।
[ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মইনুল ইসলামের লেখার আলোকে ]
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৩:২৮