১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের যেসব নেতা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন জামায়াত সমর্থক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের তালিকা করছে। জামায়াত আসলে সেই সময়ে আওয়ামী লীগে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজছে। অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়েও আরেকটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
বর্তমান সরকার সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধের তালিকা তৈরি করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রেক্ষিতেই জামায়াত এ উদ্যোগ নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী দেখাতে চায় আওয়ামী লীগেও যুদ্ধাপরাধী আছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ‘বিশেষ ট্রাইবুনালে’ এই তালিকা এবং সঙ্গে কিছু অভিযোগ জমা দেয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এ ধরনের তালিকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেহেতু তদানীন্তন জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকাকে অবলম্বন করে আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যুদ্ধাপরাধী ইসু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে, সঙ্গত কারণেই আমরা সেই সময়কার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার কী ভূমিকা ছিল- তা খোঁজ নেয়ার কিছুটা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।’
কামারুজ্জামান বলেন, ‘যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে- তাতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রচুরসংখ্যক নেতা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে বর্তমান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যও আছেন। তাঁদের পিতা-পরিবারের সদস্যরাও জামায়াতের মতোই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন।’
‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’র আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান জামায়াতের আওয়ামী লীগে যুদ্ধাপরাধী খোঁজার বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ‘তালিকা করুক না ক্ষতি কী? তাদের করা তালিকাভুক্তরা সত্যিকার অপরাধী হলে সরকারের উচিত এর বিচার করা।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, দলের মর্যাদা অক্ষুণœ ও নিষ্কলুষ করার জন্য নিজেদের উদ্যোগেই জরুরি ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি করা উচিত।’
জামায়াত সমর্থিত প্রতিষ্ঠান সূত্র বলেছে, নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের ‘এমএনএ’ (জাতীয় পরিষদ) মো. ওবায়দুল্লাহ মজুমদার ও চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত ‘এমপিএ’ (প্রাদেশিক পরিষদ) অধ্যাপক শামসুল হক দু’জনই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর তৈরি এমএ মালেকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
তালিকাভুক্ত অপর আওয়ামী লীগ নেতারা হচ্ছেন- চট্টগ্রামের প্রাদেশিক আসন ২৪ থেকে নির্বাচিত ‘এমপিএ’ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পটুয়াখালী থেকে নির্বাচিত ‘এমপিএ’ মুজিবুর রহমান তালুকদার, যশোর থেকে নির্বাচিত ‘এমপিএ’ মো. মঈনুদ্দীন মিয়াজী, খুলনার ‘এমপিএ’ হাবিবুর রহমান খান, বগুড়া থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মো. হাবিবুর রহমান, ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে নির্বাচিত ‘এমএনএ’ জহির উদ্দিন, লে. কর্নেল একেএম মাহবুবুল ইসলাম (পাবনা), সৈয়দ হোসেইন মনসুর (পাবনা), মো. আবদুল গাফফার (খুলনা), মো. সাঈদ (খুলনা), মোশাররফ হোসেন শাহজাহান, একে ফায়জুল হক (বরিশাল), এবিএম নুরুল ইসলাম (ফরিদপুর), আমজাদ হোসেন খান (ফরিদপুর), মো. নুরুল ইসলাম (ঢাকা), আখতারুজ্জামান (ময়মনসিংহ), সৈয়দ বদরুজ্জামান ওরফে এসবি জামান (ময়মনসিংহ), ডা. আবুল হাসেম (সিলেট)।
উল্লিখিত ২০ নেতার প্রত্যেকে জাতীয় পরিষদ অথবা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। দৈনিক পাকিস্তান ও আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এসব নেতার স্বাধীনতাবিরোধী বিবৃতি প্রকাশ হয়। তালিকাভুক্ত এসব আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষই নেননি, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করেন বলেও তাতে উল্লেখ আছে। যে কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়েই সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু গণপরিষদ সদস্যের সদস্য পদ বাতিল করা হয়। অনেকের নাগরিকত্বও বাতিল করা হয়েছিল। উল্লেখিতদের অনেকেই ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
’৭১ সালের ৩ জুলাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার জন্য জনগণ আমাকে ভোট দেয় নাই।’ ৬ জুলাই মুজিবুর রহমান তালুকদার পৃথক বিবৃতিতে ‘পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্য আওয়ামী লীগের মতলব সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না’ বলে মন্তব্য করেন। হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘পাকিস্তান এক ও অবিচ্ছেদ্য। পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারে এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের যেসব নেতা জেলা ও শহর শাখার শান্তি কমিটিতে ছিলেন তাদেরও তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মাওলানা নুরুল ইসলাম। একাত্তর সালে তিনি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি রাজাকার কমান্ডার ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। তখন ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমজাদ হোসেন, টাঙ্গাইলের সাবেক আওয়ামী লীগ এমপিএ খোদাবক্স মুক্তার, ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মহকুমা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মো. ফিরোজুর রহমান, ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবদুস শুকুর মিয়া, ফরিদপুর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল মিয়া মোক্তার, অ্যাডভোকেট কাজী খলিলুর রহমান, অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন মিয়া, চট্টগ্রাম সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আবুল বাশার, নেত্রকোণার আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল ইসলাম খান, নেত্রকোণা শহর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি চাঁদবক্স পাটওয়ারী মোক্তার, নেত্রকোণার বায়লাতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি ডা. গিয়াসউদ্দিন আহমদ, নেত্রকোণা শহর আওয়ামী লীগ সদস্য সোহরাব হোসেন, নেত্রকোণা মহকুমা আওয়ামী লীগ সদস্য এমদাদুল হক, চাঁদপুর আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. মুজিবুর রহমান চৌধুরী, চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন পাটওয়ারী মোক্তার, চাঁদপুর রেডক্রস সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট ফজলুল হক, চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের কার্যকরি সদস্য খুরশিদ আলম চৌধুরী, মহকুমা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ বজলুর রহমান শেখ, চাঁদপুর আওয়ামী লীগ সদস্য ও তরপারচান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান মৃধা, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য ও ইব্রাহিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজ শেখ পাটওয়ারী, চাঁদপুর আওয়ামী লীগ সদস্য ও ঠিকাদার মোফাজ্জল হোসেন, ফরিদগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক ডা. নুরুল ইসলাম, রাজশাহীর সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান, যশোর আওয়ামী লীগ নেতা মীর তৈয়ব, মোহাম্মদ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী।
নেত্রকোনা শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তিনি মুসলমানদের চিরশত্র“ ভারতের সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীদের উৎখাতকল্পে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।