somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীল শীতের চুমুরা (যেখানে যতটুকু ফেলে এসেছি নিজেকে)

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


উত্তরের জানলার হাওয়া কাউকে জানিয়ে দিয়েছে শীত আসছে। আমি বুঝেছি, স্টেশনে বসে, কিছু ট্রেন ধরতে আসা মানুষের মুখ দেখে। কীভাবে, জানি না। কিন্তু তাঁদের এক একটা মুখ দেখিয়ে দিয়ে গেলো শীত আসছে। মাঝে একটা কালীপূজো আছে যদিও। আরও একটা ভাইফোঁটা। লম্বা কতগুলো দীর্ঘ আলো। উৎসব, আলো, অনেক, বিরক্তিকর শব্দ-বাজি। তারপর বারান্দায় শীতের পোশাক জড়ো করে রোদ পোহানো। সকালবেলা উঠতে আরও খানিক দেরি করে উঠতে চাওয়া। একটা নিজস্ব ছাদ বেছে নিয়ে পাশের বাড়ির পুরনো মুখকে হটাত চিনে নিলে কি জীবন কি সুন্দর হয়ে যায় আরও একটু? আরেকটা নতুন চায়ের সস্তা দোকান খুঁজে নিলে কি ভালো-থাকা বেড়ে যায়? কি জানি? ‘’মায়া, মায়া। ওসব মিথ্যে। বাস্তবে ফেরো।’’- কেউ একটা বলেছিল। বদলে বলতে পারিনি আমরা যে গল্পতেই খুব ভালো থাকি। সারাজীবন ধরে কেবল গল্প খুঁজি গোগ্রাসে। তারপর নিজস্ব একটা পছন্দের গল্পে নিজেকে ‘ফিট ইন’ করেনি। তারপর শুরু হয় কথা বলা। ফ্যানেদের সারাবছরের কাজ কিছু কমে এসেছে, এখন তার একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময়। তবে সারাবছরের পরিচিত বন্ধুকে মিস করতে করতে যখন কান পাতি, তখন দেখি এই ফ্যানের শব্দ অনেক শব্দকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ। যেমন হঠাত্‍ খুব তীব্র প্রেমে পড়লে সহজেই ভুলে যাওয়া যায় কাছের অনেক মানুষকে।


চরম এক অরাজকতা মাথায় চাপলে মাঝে মাঝে খুব করে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে আকাশ-পাতাল। ছোটবেলার বন্ধু বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে আসলে বুঝি দূরত্ব বাড়ছে, খুব করে, নেমন্তন্ন করতে হয়। আগের বছর এসময় কেমন ঠাণ্ডা ছিল জানিনা, কেবল জানি আমার দু-চাকার বাহনটি পাঁচ বছর পূর্ণ করবে এই শীতেই। বড় হচ্ছে, অনেক পুরনো গোপন কথা তো ওই জানে। সমু বাইরে থাকে, ঘুরতে আসে মাঝে সাঝে বাড়িতে। চাকরি হয় সমুর, মন পড়ে থাকে মিউজিকে। সমু বলে একদিন মিউজিক করবে, করবে আমি জানি। একদিন করবেই। শুধু আলাদা করে কোনওদিন শুরু করা হবেনা, কারণ ওকে বুকে টেনে নিয়েছে মুদ্রা রাক্ষস। ও বড় জটিল বন্ধন, সে বড় জটিল পোষ্য। আমি জানি শঙ্খ খুব একা থাকে, কারণ শঙ্খের সমস্ত ভাল-থাকা কেড়ে নিয়েছে একা বাঁচার এক সাময়িক লোভ। আজ বয়সটা একটু বেড়ে গ্যালে শঙ্খ বোঝে ভাল-থাকা কেবল কতগুলো চেনা-মুখ ছাড়া কিচ্ছু নয়। তর্কের বাইরে, অনেক বেশি অন্ধ ভালো থাকা। শঙ্খ জানে আজ আর খাটের তলায় একটা খুব অন্ধকার কোণে একটা ঝুল ভরা ক্যাম্বিস বল নেই। থাকলেও নেই সেই বল ধরার মতন হাতের পরিমাপ। ভালো থাকা একটা ঝুল ভরা ক্যাম্বিস বল ছাড়া কিচ্ছু নয়।


আমি জানি সে খুব ধীরে কথা বলে। তবে আমার কাছে একা যখন থাকে তখন তার কথা খুব দ্রুত হয়, জোরেও হয়। আমি জানি আমরা কেউ কাউকে ভালবাসি না, কেবল একসাথে একটা পথ চলতে চাই, একটা জার্নি, একটা ট্রিপ। জানি এই একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে ঘিরেই আমাদের বেঁচে থাকা বিন্দুগুলো প্রকাশিত হবে। আমার লেখা, আর ওর ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে মাঝে মাঝে শুয়ে থাকি আমি, মাঝে মাঝে রঙ মেখে নষ্ট করে ফেলি ওর যেকোনো একটা ছবি। তারপর কোনদিন খুব কাছে বসে থেকে ভোরের আলো ফুটে ওঠা দেখি, ভাবি আমাদের পুরনো কাছের মানুষেরা কীভাবে ঘুম থেকে উঠত। তাঁদের ঘুমিয়ে থাকা আমরা কীভাবে দেখতাম খুব কাছ থেকে। তারপর একদিন এভাবেই বেরিয়ে আসি। আসতে হয়। আমরা জানি বেরিয়ে আসতে হয়। আমি জানি চারিদিকে যুদ্ধের আবহে, হিংসার আবহে ডিলান নোবেল পান, যেন সমুদ্রের গায়ে একটা ছোটো ফ্ল্যাগ ভাসানোর চেষ্টা, এখনও অভিষিক্তাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন পেতে ঘুরে বেড়াই বার কয়েক। ভালোবাসা সে কোনো বৃহৎ চমৎকার জানোয়ার নয়, রকমারি উৎসব নয়, কেবল প্রতিদিন সে সমস্ত আরও সুন্দর করে বলতে চাওয়া যা জানি বহুবার, বহুরকম করে। আমি তার তলপেটে শুয়ে সিগারেট মুখে ভেবে ফেলি এ সবকিছু। আমার প্রতিটা দাড়ি বয়স চিনিয়ে দেয়, বলে আর ক্যানো? এবার তো বেরোও নিজের গর্ত থেকে, নিজেকে সামনে রাখো, নেতৃত্ব দাও, পথ চেনাও, লিখে ফেলো সেসমস্ত কিছু যা লেখা হয়নি এতদিন। বেঁধে ফেলো সেসমস্ত সুর যা শুনিয়ে তুমি শান্ত রাখতে পারো দশ মিনিট যুদ্ধ, অথবা ভেস্তে দিতে পারো কয়েকটা পারমাণবিক বোমা। অথবা শুধু পথ ধরে চলে চাও অনেক দূর, অনেক দূর, অনেক দূর, এই পৃথিবীর জন্য শান্তি আনতে। আমি জানি সে অবিচলিত, কয়েকটা চুমু খেয়ে সে চালু করেছিল তার পুরনো বাইক। তৃতীয়বারে। তারপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল মাঝরাতে। আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম, ভাবছিলাম কখন ভোর হবে। আমরা কখনই কি একে অপরকে ভালবাসিনি?


শঙ্খের মতো আমিও হয়ত অনেক একা হয়ে গেছি। একা হয়ে গেছে অমিত, আকাশ, পারমিতারা। কেউ বিয়ে করে সুখে আছে হয়ত, বা মরে গেছে। কেউ চাকরি করে বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ে হঠাত্‍ , একটিও কথা না বলে, বলতে পারে না কারো সাথে। এরকম কারো বন্ধুরা কোনদিন হয়ত একটা মানুষ খুন করে ফেলেছিল। তারপর অনেক অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে আর আলো খুঁজে পায়নি। কারো বন্ধুরা হয়ত রাস্ট্রের অত্যাচারের ভয়ে জঙ্গি হয়ে মানুষ মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিজেদের উড়িয়ে দেওয়ার আগে তাঁদের কি নিজের প্রাণের মানুষের কথা মনে পড়েনি? অথবা যে মানুষটি আমাদের প্রাণের রক্ষা করে নিজের বিনিময়ে, তাঁদের মধ্যে এত সাহস, দেশের প্রতি এত ভালোবাসা কীভাবে আসে? আমি বিস্মিত হই, ভাবি কত ক্ষুদ্র আমি, কত ক্ষুদ্র আমার এই বেঁচে থাকা, কত নিরাপদ। তারপর ভাবি কই? আমারও তো একটা পথ আছে। সেটুকুর জন্য বেঁচে থাকা, সেটুকুই আসল উদযাপন, আসল উৎসব। না আলো নয়, বাজি নয়, সেইসব মানুষের মুখে একটুকরো আলো ফোটানো যাদের জীবনে সত্যি আলোর খুব অভাব।যারা ভালবাসতে, ভালো থাকতে ভুলে গেছে। এক জটিল গোপন অভিশাপ তাঁদের ঘিরে ধরেছে। সে উৎসব তো চিরন্তন। নিঃশব্দ। আদতে আমাদের সকলের জীবনেই সেই ক্ষুদ্র আলো জ্বলে। জন্মগত আলো। ব্যক্তিগত সাফল্য আসলে সেই আলোকে আরও তীব্র করে, আমরা উজ্জ্বল হই, চোখ ধাধিয়ে যায় আশেপাশের মানুষের। কিন্তু সাফল্য সেই উদযাপন করে যে নিজের হাতের মোমবাতি থেকে জ্বালিয়ে দেয় আরও হাজারটা মোমবাতি।তারপর নিজে চলে যায় খুব অন্ধকার কোন গলিতে, সাফল্য, খ্যাতি, পরিচিতিকে তোয়াক্কা না করে। তাঁদের ওই চেষ্টায় আলো হয়ে ওঠে সমগ্র জগত। এই ছোটো ‘হোপ’ নিয়েই আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি, প্রতিটা শব্দ লিখি, তারপর অপেক্ষা, নিরন্তর।হিমের পরশ গায়ে লাগে। সেসমস্ত মানুষের কথা ভাবি যারা খুব ঘেন্না করেছিল, তারাই তো শিখিয়ে গেছে অনেক কিছু নিজের ছোটো কুয়ো থেকে জগতের পথিক হতে দিয়েছে, অজান্তে। বেড়াজাল ভেঙ্গে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার এই উৎসবে আমি হাওয়ায় ভাসিয়ে দি নিজেকে, কখনও জড়িয়ে থাকি তাকে,বাইকের পেছনে।সে ক্লান্তিহীন চলে। তারপর কখন ভোর হয়ে যায়…অন্য গানের ভোর। আমার ঘুম ঘুম চোখে দেখি এখনও অনেকটা পথ বাকি… অনেকটা চলা বাকি। তার সঙ্গে, তার জন্য। ভালোবাসা একটা ভোরের পুরনো চাদর ছাড়া কিছু নয়।

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৪৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×