somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হলুদ ফুল

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনিমেষ যথেষ্ট কাজের ছেলে ছিল। বিষয়ী লোক, টাকা-পয়সার হিসেব ভালো বুঝত। ভাসানের সময় যখন সবাই সিদ্ধি খেয়ে নাচতে ব্যস্ত তখন লাইটিং-এর ভ্যান-রিক্সা ঠিক-ঠাক রাস্তা পার করানো, ট্র্যাফিক সামলানো এসবে তার আগ্রহ ও নিষ্ঠা দুটোই ছিল দেখার মত। ক্লাবের পিকনিকে মাতাল বন্ধুদের সে দায়িত্ব সহকারে বমি করাত, সামনে প্লাস্টিকের বালতি ধরত। পাড়ার ফাংশানে আর্টিস্টদের জন্য টিফিনের প্যাকেট থেকে শুরু করে ২৬শে জানুয়ারীর পতাকা-ফুলের দরদাম, অনিমেষ ছাড়া গতি ছিল না। তাই ও গাড়ী চাপা পড়ার পর আমাদের ফাইভ-এ-সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট ওর নামে করতে আমাদের বেশি ভাবতে হয়নি। তাছাড়া আমি হিসেব করে দেখেছিলাম ৭ নম্বর স্ট্রীটের গোপালের বাবার গায়ে আগুন লাগানোর পর অনিমেষই ছিল ফার্স্ট কেস। তার পরেও এ তল্লাটে আর কেউ অমন অপঘাতে মরেনি। সেই ৮৮’ সালেও অনিমেষের কালার ফোটো তোলানো ছিল। অতসীর জন্য। সেটা আমিই ফ্রেমে বাঁধিয়েছিলাম। চার পেয়ে কাঠের টেবিলে ফুলের মালা পরে হাসিমুখে বসে থাকে অনিমেষ প্রতি ১৫ই আগস্ট, কপালে চন্দনের ফোঁটা। ৬ বছর হয়ে গেল। এই ভাবে দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ পার করে দিল। কে আবার ওর নামের সাথে ‘শহীদ’ জুড়ে দেওয়ায় রমরমা হয়ে যায়। ফ্রেম বাঁধানোর টাকাটা আমি অভ্যেসবশত মেরে দিয়েছিলাম। ওটা নিছকই রিফ্লেক্স। অনিমেষ ভালো বন্ধু ছিল আমার। আমি অতসীদের ভাড়াটে, আমাকে ছাড়া ওর চলত না। অতসীকে চিঠিও আমাকেই লিখতে হত। চিঠি হাত বদলও আমিই করে এসেছি বরাবর। তবে অনিমেষের মৃত্যুর খবর আমি অতসীকে দিতে পারিনি। আমি তখন দোকানে বসে। পল্টু সবার আগে অতসীর বাবাকেই খবরটা দেয়। এই একটাই সুযোগ ও পেয়েছিল অতসীদের বাড়ী ঢোকার। ওকে দোষ দিই না। আমারই কপাল খারাপ। অতসী নাকি বড়জোর সাড়ে চার সেকেন্ড হতভম্ব থেকেই কাঁদা শুরু করেছিল। পল্টুর মতে সিনেমার সাথে কিছুই মেলেনি। সিঁড়িতে ধপ করে বসেও পড়েনি অতসী। অজ্ঞান হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। আমি তার বছর দুই আগে পাড়ায় আসি। আমার দোকান। অতসীর প্রেম সেবার পূজোয়। ১৯৮৮ সাল।

একটা গাছেরও নাম জানিনা। চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু পাতার গড়ন কেমন অচেনা। আর কত লম্বা! মাঝখানে একটা সরু নদী মত। কিন্তু জল বয় না। স্থির। নদী না খাল বলেই মনে হয়। বেশ কিছুটা হাঁটি। আমার সামনে সামনে অনিমেষ। ওর মুখ দেখা যায় না কিন্তু আমি জানি। এই জায়গায় আমি এর আগেও এসেছি। অনিমেষ এই ভাবেই আগে আগে হাঁটে। এক সময় জঙ্গল শেষ হয়ে গেলে আমরা বালিয়াড়িতে পৌঁছই। বালি বেয়ে বেয়ে উঠে আসি দুজনে। হাঁপ ধরেনি কখনো। উপরে উঠে দৃশ্যটা চেনা তবু বার বার দেখতে ভালো লাগে। চেনা চেনা গাছ। বটের মত...অশ্বত্থের মত। তারপর খাঁড়ির জল চিকচিক করে ওঠে। আবছা সমুদ্র দেখা যায়। আমার এর আগে কোনোদিন যাওয়া হয় না। এখানে অনিমেষ বসে। আমি ওর পাশে বসি। পিছনে আমাদের ফেলে আসা পায়ের ছাপগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে। অনিমেষ হাতে ওরই ফ্রেম বাঁধানো ছবিটা নিয়ে বসে থাকে। আমার ভয় হয় এখুনি পয়সার কথাটা তুলবে। কিন্তু ও শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বলে ‘আমাকে আর একটা চিঠি লিখে দে না...’। ঠিক এইখানে প্রতিবার আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। একটু এদিক ওদিক হয়। কোনো দিন খাঁড়ির জল থেকে পল্টু হাতে শিল্ড নিয়ে বেরিয়ে আসে। কোনো দিন অতসীর বাবা বাজারের থলি হাতে উঠে আসে। কোনো দিন অনিমেষ একটা সাদা মোষের পিঠে চেপে খাঁড়ির দিকে চলে যায়, ‘এতে চাপা পড়ার ভয় নেই’ বলতে বলতে। অতসী আসে না।

অতসী আসে না। এই পৌষের দুপুরেও ছাদে আঁচ লাগে পায়ে। হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে শ্যাওলা বের করি। সামনে-পাশে-পিছনের ছাদে সারি সারি জামা-কাপড় টাঙানো। কারো কার্ণিশে পায়রা, ল্যাম্পপোস্টের তারে ছেঁড়া ঘুড়ি ঝুলতে থাকে। এখন আড়াইটে হবে। সামনের বাড়ির মিলনের মা ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে নিয়ে গেল। অতসী আসে না। পায়ের তলাগুলো আঁচে চুলকোতে থাকে। ট্যাঙ্কির উপর লাল একটা ভাঙা মগ। এখানে কি করছে? কোনো কোনো দিন দুপুরে অতসী ছাদে আসে বইকি। বই-খাতা নিয়ে শতরঞ্চি পেতে বসে। রেডিও চালায় এক একদিন। ‘গুলশন কুমার পেশ করতে হ্যাঁয়’... 'কেমন আছ অতসী?’

সে শুধু মাথাটা কাত করে স্মিত হাসি দেয়। আমাকে জিজ্ঞেস করেনা আমি কেমন আছি।
‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ভালো, সুমনদা বাবা বলছিল বাইরের বাল্বটা চেঞ্জ করে দিতে...ফিউজ হয়ে গেছে।‘
‘আচ্ছা’
আজ অতসী কোথায়? ঘরে?
ছাদ থেকে ঝুঁকে দেখতে পাই বেড়ার ধারে রাধাচূড়া গাছটার সাথে বাঁধা নাইলনের দড়ি বেয়ে লাইন দিয়ে পিঁপড়ে ঢুকছে আমার ঘরে। দড়ি বাঁধা বলে জানলাটা খোলা রাখতে হয়। এত উপর থেকে দেখা যায় না কিন্তু আমি জানি একজন আগে আগে যায় তারপর ইশারা করে বাকিদের ডাকে। আমার চিন্তা নেই। ওরা আমার ঘরে থাকেনা। আমার রান্না-বান্না, পুজো-আচ্চার বালাই নেই। ওরা আমার ঘর দিয়ে শর্টকাট মারে (অনিমেষ বলত শর্টকার্ট, বলত সিকারেট খাবি?) পিছনে মল্লিকদের রান্নাঘরে। পিঁপড়েগুলোও আমাকে ব্যাবহার করে গেল। কোনো কোনোদিন অতসীর নাইটি-সালোয়ার কি সায়া মেলা থাকে। তখন সামনের পিঁপড়েটা একটু দিশেহারা হয়ে যায়। খেই হারিয়ে ফেলে পেরোতে পেরোতে। পিছন থেকে বাকিরা আওয়াজ দেয় ‘আর কতদূর? এ কোথায় এলাম রে বাবা!’ সামনের জন হয়ত অতসীর অনেক কিছুই পার করেছে। সে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও সামলে নেয় শেষমেশ। তুমি এখন কি করছ অতসী? আমার ভাবতে ভালো লাগে সে এখন বুকে বালিশ নিয়ে খাটে শুয়ে লিখছে কিছু। কিম্বা বাড়ীর কাজ করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছে, পোষা বেড়ালটা পায়ে পায়ে ঘুরছে। কিম্বা আয়নার সামনে চুল বাঁধছে। কিন্তু অনিমেষ-অতসী রাজযোটক ছিল। সে নির্ঘাত বাবার পকেট থেকে টাকা সরাচ্ছে কিম্বা খাতায় এ মাসের দোকানের হিসেব টুকে রাখছে। ওইসব ভাবতে কার ভালো লাগে? অতসী আসে না। আজ আর আসবেনা। কোনোদিন অতসীর জামা-কাপড় মেলা থাকলে শুকনো কাপড়ের গন্ধ নিই। ডিটার্জেন্টের গন্ধ। অতসীর নয়। নিচে আমার দড়িতে সে আজকাল জামা-কাপড় মেলে না বড় একটা। সে খুব সুখের দিন ছিল। সরস্বতী পূজোর চাঁদা বাবদ অতসীর বাবা ৫ টাকা দেওয়ায় আর সাথে ফ্রি তে ‘সুমনের বন্ধু না হলে এটাও পেতে না’ শুনিয়ে দেওয়ায় চারটে দোপাটি আর গাঁদা ফুলের চারার সাথে সাথে অনিমেষ আমার দড়ি থেকে অতসীর ব্রা টি তুলে নিয়ে যায়। সাদা নিরীহ মধ্যবিত্ত ব্রা। অনিমেষ বলেছিল সে ওই থেকেই অতসীর প্রেমে পড়ে। লাভের লাভ আমার আর কোনোদিন অতসীর ব্রা দেখা হয়নি।


ওদের সেন্টার ফরওয়ার্ডটা বেঁটে হলেও বেশ কাজের। এই হাফটা গোটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। একবার বারে মারল। মিলন সঙ্ঘের গোলকীপারটা বাঁচালো একটা। ওহ মিলন সঙ্ঘ। আমাদের পাড়ায় এসে তিন তিন বার শীল্ড নিয়ে গেছে শালারা। এইবার হারাতেই হবে। গোলের পিছন থেকে লাগাতার খিস্তি মেরে যাচ্ছি আমি, বুবলা আর নন্দ। আয়োজক টিম বরাবরের মত এবারো গোড়াতেই কুপোকাত। তা হোক। এবার শালা বেঁটেদের ফুল সাপোর্ট। মিলন সঙ্ঘ জিতলে আজ রাতের পার্টি ক্যান্সেল। ১-১ চলছে ৫৫ মিনিট হয়ে গেল। হাড্ডাহাড্ডি চলছে। অতসীর বাবা মঞ্চে। মাঝের চেয়ারে। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অনাদীদা আর সেক্টরের বাবুল বোসকে দু বগলে নিয়ে। অনিমেষ না মরলে আর আমি চিঠি না লিখলে আপনাকে কেউ পুছত কাকু? তবু ফি বছর ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। ভালোই আছে বাপ-মেয়ে। সরস্বতী-দূর্গা-কালীর চাঁদা নেই। শালপাতা ভর্তি খিচুড়ি, মিষ্টির প্যাকেট বরাদ্দ। মেয়ের দিকে কেউ নজর দেয় না। চোখ তুলে তাকায়না 'তোদের বৌদি হয় বে! আজ অনিমেষদা থাকলে'। বেঁটে গোল করল। কর্ণার থেকে জটলার মধ্যে পুক করে দিল ভরে। রেফারি বাঁশি বাজাতেই পাশের চায়ের দোকানের ডাম্বেলের মা ডেকচি মাজতে বসে গেল।

'২ টো খাম্বা নিবি আর ৪ টে বিয়ার। ৭ জন আছি...আর সতুর দোকান থেকে চিংড়ীর চপ নিয়ে নিস হিসেব মত। পোঁদটা বেরিয়ে থাকে চপের বাইরে এরকম সাইজের চিংড়ি দিতে বলবি।'
'সতু মাসিমাকে বলিস ঝাল-ফাল যেন ঠিকঠাক থাকে...'
আজ ব্যাপক মস্তি হল। চপ যা এসেছিল ২ পেগেই শেষ। তারপর কষা মাংস। জনাই মাঝখানে গিয়ে আরো ২ টো বোতল নিয়ে এলো। টুর্নামেন্টে স্পনসর যা জোটে, বছরে এই একটা দিন একদম ঝিঙ্কু বাওয়াল হয়। 'আরে গুরু সাজনের গানটা লাগাওনা... 'মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায় যো প্যায়ার ইয়ে তুমসে করতা হ্যায়'... পল্টু মাধুরি-নাচ জুড়ে দিল। 'আহ দিল খুশ করে দিল শালা ওই গ্যাঁড়াটা...বাঘবাচ্চা পুরো'। রাত দুটোর সময় বাড়ী ফিরতে ফিরতে মাথায় এলো অতসীর বাবা বোধহয় এবার ছেলে দেখবে...অনিমেষকে আমাদের কারোরই আর মনে নেই।



পেগের পর পেগ মাল টেনে যাচ্ছি আমি আর অনিমেষ। কোনো স্বাদ নেই। জল খাচ্ছি যেন। এই দিকটায় প্রথম এলাম। সমুদ্রের ধারে শালারা এমন বার লাগিয়েছে! গোল রঙ্গীন ছাতার তলায় দুজনে বসে। পাশের টেবিলে ৪ টে পিঁপড়ে। অতসীর সায়া নিয়ে গল্প করছে। তারে টাঙানো সায়ায় ভাঁজ পড়ে গেলে ডিঙোতে নাকি দম বেরিয়ে যায়। একমাত্র অনিমেষ থাকলেই আমি স্বপ্নেও বুঝতে পারি যে স্বপ্ন দেখছি। তবু যা হওয়ার হতে দিই। জোর করে কিছু পাল্টাতে যাইনা। একবার বালিয়াড়ীতে অতসীকে আনতে গিয়ে মিলনের মা চলে এসেছিল কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে। আমি চুপচাপ মাল খেতে থাকি।
'তুই আর একটা চিঠি লেখ...লাস্ট'
আমি সমুদ্র দেখি।
'ওর শেষ চিঠিটা আমার আর পড়া হলনা'
অনিমেষ পেগ শেষ করে ঠক করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখে।
'গ্যাঁড়াটা কি ঢোকালো...সব দেখলাম। আমার চিঠিটা দিয়েছিলি ওকে?'
আমি পিঁপড়েগুলোকে দেখি।
'দ্যাখ সুমন। তুই ছাব্বিশ টাকা ঝেড়ে দিলি ক্লাবের...আমি কিছু বলেছি? আমি রাগ করিনি মাইরি। তুই একটা লিখে দে। ওই হলুদ ফুল...নইলে ক্যাঁত করে লাথ মারব শালা' বলে অনিমেষ আমার হাঁটুতে লাথি মারতেই ঘুম ভেঙে যায়। দেখি ডান পায়ের হাঁটুর নিচটা টনটন করছে।

হলুদ ফুল হলুদ ফুল। আমার বাড়ী... আমার বাগান...আমার রাধাচূড়ার হলুদ ফুল। জুনের রাতগুলো। বাইরে ফোল্ডিং খাট পেতে শুয়ে গায়ে একটা একটা করে হলুদ ফুল এসে লাগে। একটা একটা করে হলুদ ফুল ফুটে ওঠে বিকেল হলেই এস.এন.বোস বাস স্ট্যান্ডে। আমি আর অনিমেষ বসে থাকি। বেলতলা গার্লস ছুটি হতেই সাইকেলে চেপে একটা একটা করে হলুদ ফুল ফুটতে থাকে। নীল-সাদা ইউনিফর্ম, লাল ছোট্ট লেডিজ্‌ সাইকেলে হলুদ ফুল।
'তুই একটা চিঠি লিখে দে মাইরি...আমি আর বাঁচব না'
'প্রেম করবি তুই আর চিঠি লিখব আমি? তাও অতসী? জানতে পারলে ওর বাপ বাড়ীছাড়া করবে আমায়'
'কিচ্ছু জানতে পারবেনা। তুই তো জানিস ওইসব লেখালেখি আমার দ্বারা হবেনা। একটা ওল্ড মঙ্কের বোতল নামাচ্ছি। তুই লেখ'।

তাই জুনের রাত কলম বন্দী করতেই হয়। আমার গোটা বারান্দা রাধাচূড়ায় ভরে গেছে। আমি গেট বন্ধ করতে আসি আর উপর থেকে আওয়াজ আসে 'সুমনদা'।
হলুদ নাইটিতে অতসী। আহা কি সুন্দর হাওয়া দিত তখন। মল্লিকদের রেডিওতে 'নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া...মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে' আমি নিচ থেকে দেখি ঝুলবারান্দায় খোলা চুলে অতসী। হলুদ নাইটির সবুজ ছিটেগুলোও যেন দেখতে পাই। ''গেট লাগিও না...বাবা এখনো ফেরেন নি।' বাবা আদৌ ফিরেছিল কিনা মনে নেই। আমার চিঠিতে অতসীর নিত্য আনাগোনা। হলুদ ফুল।


মাসের পয়লা এলে অতসীর বাবার সাথে কথা হয়।
‘আর সব ভালো তো?’
‘এবার একটা বিয়ে করো সুমন...বয়স তো পেরিয়ে যাছে।‘
‘ঘরে এখনো ছোট বোন আছে। সবই তো জানেন কাকু। আগে ওর একটা ব্যবস্থা...’
সেই গতে বাঁধা ডায়ালগবাজি। আমি চেষ্টা করি অতসী একা থাকার সময় ভাড়া দিতে যাওয়ার। অতসীর হাতে টাকা দিয়ে বলি ‘গুনে নাও’।
সে যতক্ষণ টাকা গোনে আমি দেখি। মেয়েদের শুনেছি তৃতীয় নয়ন থাকে। তবে টাকা গোনার সময় সেটা বোজা থাকে বোধহয়। অতসী পাতলা ফিনফিনে নাইটি পরে থাকলে বালিয়াড়ি পেরিয়ে খাঁড়ি থেকে সমুদ্র অবধি ঘুরে আসা যায় ওর গোনা শেষ হওয়ার আগেই। আমার সাথে ওর কিই বা কথা থাকতে পারে কেজো ছাড়া। চিঠি দিতাম যখন তখনো অতসী বিশেষ কথা বলত না। তবে দু দিন অন্তর নিজের বানানো তরকারি দিয়ে যেতো। সাথে চিঠি। সে চিঠি পড়ে আমি চিঠি লিখতে বসতাম, বাসন ধুয়ে সাথে চিঠিও দিতাম। অনিমেষ যেদিন মারা যায় সেদিন একটা চিঠি দেওয়ার ছিল। অনিমেষকে। সেটা আর দেওয়া হয়নি বলাই বাহুল্য।

‘টুকটাক কিছু দরকার পড়লে আমার দোকান থেকে নিয়ে আসতে পারো তো’ আমি সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে বলি। সে ঘাড় কাত করে মাত্র,
‘ঠিক আছে...এই নোটটা চলবে তো?’
আমার দোকানে আসেনা অতসী। কোনো দরকারে বাবাকেই পাঠায় কিম্বা ওর বাবা আনিয়ে নেয়। অথচ পাশে জনাই-এর কাছ থেকে কত মরসুমি বাঁধাকপি, কচি সজনে ডাঁটা আর লাউ সে নিয়ে গেল বছরের পর বছর। দুটো ওয়ার্ল্ড কাপ পেরিয়ে গেল। অনিমেষের মাকে পূজোর দিন পাড়ার প্যান্ডেলে জড়িয়ে ধরে কি কাঁদাটাই না কাঁদলো। পাড়ার সব ছেলে-পিলেদের সামনে। সেদিন অতসী আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। ‘এইভাবে সারাটা জীবন বসে থাকিস না মা। তুই ছেলেমানুষ’ আর সাথে ‘তুমি সব সময় আমাদের বৌদি থাকবে, দরকার পড়লে একবার শুধু ডেকো’ দু-হাতে দুটো গ্র্যান্ড স্ল্যাম নিয়ে অতসী ঘরে ফিরলো...পিছনে শাল পাতার ঠোঙায় খিচুড়ি নিয়ে পল্টু।


চিঠির আইডিয়াটা আমিই দিয়েছিলাম অনিমেষকে। লিখে দিতে রাজিও হয়ে গেছিলাম এক কথায়। এমনিতে কোনো দরকার ছিলনা। অতসীর তখন এগারো ক্লাস। হপ্তায় ৭ দিনই টিউশন। আলাদা করে চিঠি না দিলেও চলত অনিমেষের। কিন্তু আমার ভালো লাগত। হলুদ ফুল মোড়া প্রথম চিঠিটা পাওয়ার ২ দিন পর বড়ি-বেগুন দিয়ে পালং শাকের সাথে অতসীর প্রথম চিঠি। ‘গুলশন কুমার পেশ করতে হ্যাঁয়’। তখনো ‘সাজন’ কি ‘দিওয়ানা’ রিলিজ করেনি। চিঠিতে যারা ছিল তাদের আমার মনেও নেই। অতসীর হাতের লেখা নকল করতে আমার দু দিন লেগেছিল। বানান ভুলগুলো ঠিক-ঠাক রপ্ত করার আগেই অনিমেষ বডি ফেলে। আমিও বেঁচে যাই। অনিমেষ যখন মারা যায় তখন স্কোর ৪-৩। অনিমেষ এক চিঠিতে এগিয়ে। অতসীকে চিঠি লিখতে বড় ভালো লাগত। কারন নিজের কথাই তো লিখতাম। কিন্তু অতসীর চিঠি? কি করে ভাবি তোমার মত? তুমি যা ভাবো তা লিখলে সুন্দর একটা জনাই-এর দোকানের ফর্দ হয়। অনিমেষ না মরলেও আমি ছেড়ে দিতাম। ওই চারটে পিঁপড়ের থেকেও খারাপ অবস্থা হয়ে গেছিল আমার।

‘অতসী যে চিঠিগুলো লিখেছিল?’
‘কি জানি কোথায়। এক জায়গায় রাখা ছিল। খুঁজে পাচ্ছিনা।‘
‘আমার পড়া হল না...কি লিখেছিল অতসী?’
‘মনে নেই। তবে গুলশন কুমার তখন আসে নি। ঋষি কাপুর কি মিঠুন। আমার ঠিক মনে নেই।‘
‘আর ওই চিঠিটা?’
‘ওটা আর শেষ করিনি। দরকার পড়লনা তো আর’
‘ওটা তাও লিখে দে সুমন’
‘তার চেয়ে বরং এটা শোন। ওর বাবা কাল সকালে বলে গেল...’,বলে আমি প্রজেক্টর চালাতে বলি। অতসী মুখে আঙুল দিয়ে ‘শশ্‌শ্‌স্‌’ করে চুপ করতে বলে পিঁপড়েগুলোকে। প্রজেক্টর অন করে।


‘এই গাছটা এবার কেটে দিতে হবে সুমন’
‘কেন কাকু? বেশ তো সুন্দর ফুল হয়’
‘হা হা ফুল হয়। তা হয়। কিন্তু প্যান্ডেল বাঁধার সময় এতটা জায়গা ছাড়া যাবে না’
‘ও’

অতসী রিল পালটায়।

‘সুমনদা বারান্দাটা ঝাঁট দাও না কেন?’
‘এই সকালে উঠে দেখি বারান্দাটা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে অতসী’
‘শুধু শুধু নোংরা হয়। আমি মাসিকে বলে দেব। ওকে ২০ টাকা করে দিয়ে দেবে। ঘরের কিছুই তো দেখোনা। এতদিন ধরে আছ।‘
‘আচ্ছা কাল ঝাঁট দিয়ে দেব।‘
’২০ টাকা করে দিয়ে দিও...বাকি বাড়ীটা তো আমরাই করাই...’

তুই আর আসিস না অনিমেষ। কাল অনেক রাত অবধি বাইরে শুয়ে ছিলাম। টুপ টুপ করে ফুলগুলো এসে পড়ছিল এক এক করে। এই শেষবার। আমার আর ভালো লাগছে না। তুই আর আসিস না অনিমেষ। আমি মাঝে উঠে ঘর থেকে সেই আধখানা চিঠি নিয়ে এলাম। অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে শুয়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করলাম। আমার গায়েই এসে পড়ল এক এক করে। আমার আর ভালো লাগেনা তোর সাথে ঘুরতে, মাল খেতে। আমি অন্য কোথাও যেতে চাই এবার। চারটে পিঁপড়ে ধরাধরি করে শীল্ডটা নিয়ে টেবিল থেকে উঠে পড়ে। আমিও জানলাটা বন্ধ করে দিই।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৩০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×