somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফেলুদার তোপসে
নিষ্পত্তি কি সব সময়ে জয়-পরাজয়ে? ময়দানি ধুলোয় তার বাইরেই যে পড়ে থাকে খেলার আসল-নকল গল্পগুলো৷ ময়দানের ঘাস-ধুলো যাঁর প্রিয়তম বন্ধু, তাঁর কলমে অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ৷

হরিপদ-অমল আর আমি

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অমলটা কবি হতে পারেনি, "প্রতিভা" বাক্সে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল এবং রমা রায়, ভালোবেসে কারাবাসী হয়েছিল। আর

আমাদের হরিপদ... জীবনের গল্পটা দু'পাতাতেই শেষ করে দিলো...


হরিপদ কি ছিন্নমূলের যন্ত্রণা নিয়ে শহরে পা রেখেছিলেন? সেই জন্যই কী বিয়ের পিঁড়ি থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাকে? মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকাতেই কী কুঁকড়ে থাকত হরিপদ? সমাজসংসারে মাথা তুলতে না পারা এক আপাদমস্তক কেরানির সবচেয়ে বড় হয়রনি কি তবে সে এক ভাড়াটে...

...ঘরে এল না সেতো
মনে তার নিত্য আসা যাওয়া
তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপাল সিঁদুর


নাঃ! বিয়েটাও করতে পারেনি হরিপদ। কোথায় থাকতে দেবে নতুন বউকে? কিনু গোয়ালার স্যাঁতস্যাঁতে গলিটাতে যে ঠিকমত আলোও ঢোকে না। গলির কোনে কোনে জমে ওঠে মাছের কানকো, আমের আঁটি, মরা বিড়ালের ছানা, ছাইপাঁশ আরও কত কী যে। সেখানে নতুন বউ এনে কোন রোমান্স করবে হরিপদ? আপাদমস্তক এই হরিপদ কেরানির সঙ্গে আমার রোজ দেখা হয়। বাসে, ট্রামে, পথে, ঘাটে, ফাঁকা রাস্তায়, মেট্রোর চেয়ারে, নিশুত রাতে, মাঝে মাঝেই। হরিপদ এসে বসে আমার পাশে।


সারাদিনের ঘাম লেপ্টে থাকে কেরানি হরিপদর জামায়। ময়লা, চ্যাটচ্যাটে জামা কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে খুব করে গাল পাড়ে কর্পোরেট কোম্পানির বেনিয়া বাবুদের। বয়েসটাও গড়িয়েছে হরিপদর। রবি ঠাকুরের সেই তরুণ হরিপদ এখন আর নেই। কালের নিয়মে এখন মাথার চুল কাঁচা, পাকা। একমুখ বলিরেখা। হাঁটার গতি শ্লথ। চোখে উঠেছে মোটা ফ্রেমের পুরু চশমা। হরিপদ হাই তোলে। আমি বলি কী হল হে, আজ কেমন কাটল? হরিপদ তাকায় ব্যাঙ্গের চোখে। ওপর দিকে থুতু ছেটালে কার ওপর পড়ে? এমনভাবে বলছ যেন তুমি রাজা আর আমি প্রজা।

সবাই তো একই গোয়ালের গরু বাবা। তুমি যা, আমিও তাই। তুমি না হয় ঠাণ্ডা ঘরে বসে পেষাই হও। শরীরে ঘাম বেরোয় না, মন শরীরে সেঁধিয়ে যায়। আর আমি না হয় রোদে রোদে পাউডার শ্যাম্পু বেচি। সেই তো একই গল্প। দিনের শেষে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, এই আর এক হরির দোকানে ফরমায়েসি দুটো চা। বাকিটা তো তুমিও জানো। হরিপদর মুখে একগাল হাসি। হরিপদর মুখে একগাল হাসি। কর্পুরের মতো ভ্যানিস কেরানি ক্লান্তি। হরিপদ এই সময়টায় একটু বেঁচে ওঠে। নিজের মত, স্বাধীন। হরিপদর একেবারে ছোট্টবেলার এক বন্ধু ছিল। নাম অমলকান্তি।

অমলকান্তি খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখত। যা নাকি জাম আর জামরুলের পাতায় একটুখানি হাসির মতোন লেগে থাকে। রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না, শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত, যা দেখে ভারি কষ্ট হত আমার। আমরা মোটামুটি এখন সবাই প্রায় প্রতিষ্ঠিত। এক অমলকান্তি ছাড়া। সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। চা খায়, এটা ওটা গল্প করে তারপর বলে উঠি তাহলে। আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

অমলকান্তির কবি হয়ে ওঠা হয়নি। হওয়া সম্ভবও ছিল না। অমল বারো ক্লাস পেরানোর আগেই বাবা সংসারের দায়িত্ব দিয়ে মুক্তি নিলেন। ছোট ছোট দুই বোন, সুগারেভোগা মা, তার সঙ্গে মানসিক বিকারগ্রস্থ এক দাদা। সব মিলিয়ে এক অস্বাভাবিক সংসারের জোয়ার এসে পড়ল অমলের ওপর। অমল মাস মাইনের চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হিসেব নিকেশের খাতা লেখার কাজে যোগ দিল এক মাড়োয়াড়ি কোম্পানিতে।

চাকরি পাওয়ার পাঁচদিনের মাথায় চাকরি গেল। হিসেবের খাতায় অমল লিখেছিল, কখন বয়স গড়ায় কে জানে। বিকেল চুঁইয়ে সন্ধে নামে জীবনের নিয়মে। পত্রপাঠ অমলের বিদায় ঘোষণা করেছিলেন মাড়োয়াড়ি কোম্পানির ম্যানেজার। বলেছিলেন তোমার যে অনেক প্রতিভা। তুমি এখানে কী করে এলে! যাও নবরত্নের এক হয়ে কবিতা লেখ, হে কবি চুড়ামনি। বলে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়েই অফিসের দোরগোড়াও পৌঁছে দিয়েছিলেন বাঙালি ম্যানেজারবাবু। অফিস থেকে বেরিয়ে শহরের রাস্তায় এলোমেলো সেদিন সারা সন্ধেটা বড় একলা হেঁটেছিল অমল। দুই বোনের শীর্ণ খুদার্ত মুখ, পথ্য না পাওয়া মায়ের অভাবি চোখ, বারবার ফিরে ফিরে আসছিল অমলের টলটলে পুকুরের মতো দুই কাজল চোখে।

তারপর এগলি, ওগলি পেরিয়ে শেষমেশ অন্ধকার ছাপাখানা। ওর শ্রমিক হাতের দিয়ে ছেপে বেরোয় অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, দিনবদলের স্বপ্ন, সেসব গন্ধ ওই ছাপাখানার মধ্যে থেকেই যতটা পারে অমল শুষে নেয়। অমলের মা মারা গেছেন। নিজের দু বোনের বিয়ে দিয়েছে অমল। সেসময় অনেক ধারদেনাও করেছিল। ওর প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুরা কিছু কিছু টাকা সাহায্যও করেছিল।

সে টাকা অবশ্য ধার রাখেনি অমল। ছাপাখানায় কাজ করেই পাই পয়সা শোধ দিয়েছে। বন্ধুরা বলেছিল, নাই বা দিলি ও কটা টাকা। অমল বলেছিল, বন্ধুঋণ পিতৃঋণের চেয়েও বড়। এ ঋণ রাখতে পারব না ভাই। আমরা হেসে বলেছিলাম। তোর কাব্য এখনও গেল না। না, অমলের কবিতা অন্ধকার ছাপাখানা কাড়তে পারেনি। হাজারো দারিদ্র কাড়তে পারেনি। অমল আজও কবিতা লেখে। এই অস্থির সময়ের কবিতা।

ছাপাখানার অন্ধকার জগতের কবিতা। বাস্তবকে নগ্ন করে কাব্যিক ছলনায়। বয়স গড়িয়েছে অমলেরও। হরিপদর মতো ওরও আর বিয়ে করে ওঠা হয়নি। সমাজ সংসারের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতেই সময় কাবার। হরিপদ এখনও কিনু গোয়ালের গলিতেই থাকে। লোহার গরাদে দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। নোনা ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ। ওর সঙ্গে থাকে আর একটা জীব থাকে একভাড়াতেই। সেটা টিকিটিকি। সাত টাকা বারো আনার ভাড়া বেড়ে এখন হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। হরিপদ আজও বিয়ে করেনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×