প্রথম তাকে দেখেছিলাম সল্টলেক অফিসপাড়ায়। বাসের জন্য একমনে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে। একটা টিউশনি সেরে ফিরছিলাম। এল ২৩৮ এ আমিও যাই সেই পথে। পুরুষজনিত স্বভাবে আড়চোখে মাপছিলাম তাকে। সেও কিছুক্ষন পর বুঝতে পেরে অবহেলার চোখে তাকিয়েছিল।
ভাগ্য মাঝেমাঝে অদ্ভুতভাবে কাজে আসে। আবার সেই কপালই হয়ত এতকিছু ঘটাল। আজ দমদম স্টেশনের দিকে এগোতে এগোতে সব ঘটনা একবারে চোখের সামনে চলে এল। ফ্ল্যাশব্যাকের মত।
বাসে উঠে সে খেয়াল করেছিল পার্সে ভাড়ার খুচরো টাকা নেই। একটা হাজার টাকার নোট। কনডাক্টর ঝামেলা শুরু করেছে। প্রায় এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসে গেছে বাস। অনেকটা পথ। সেও নাছোড়বান্দা। প্যাসেঞ্জারের অসুবিধে থাকতেই পারে। কন্ডাক্টরের বক্তব্য হাজার টাকার ব্যবসাই যদি না হয় তো খুচরো হবে কোত্থেকে! এছাড়া বাজারে প্রচুর জাল নোট বেড়িয়েছে হাজারের। সেই বা কেন ঝুঁকি নেবে!
সুযোগ বুঝে আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম। সে আমার দিকে বিরক্তি, অবহেলার সাথে পরিত্রাতার ভুমিকা মিশিয়ে অদ্ভুত নজরে তাকিয়েছিল। আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম “ দিন আমার কাছে খুচরো আছে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আপনাদেরও বোঝা উচিত।”
“আর ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ দিদি। নিন টিকিট নিন।”
সেদিন আর কোনো কথা হয়নি।
এরপর প্রায় একমাস পরে সেই বাসস্ট্যান্ডেই আবার দেখা। এবার আমি একটু সাহস করে এগিয়েছিলাম।
“কি চিনতে পারলেন?”
“হ্যা। হাজার টাকা না আপনি?”
হো হো করে হেসে বললাম “হ্যা ঠিকই ধরেছেন। আজ খুচরো আছে তো?”
“হ্যা আছে। সেদিনের জন্য আবার থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি থাকেন কোথায়?”
“মধ্যমগ্রাম। বাদু রোডের দিকে। আর আপনি?”
“বিরাটি। এইতো ভুলে গেলেন। আগেরদিন আপনার সামনেই তো টিকিট কাটলাম।”
ঠিকই তো! আগেরদিন খেয়ালই করিনি। হাসিমুখে বললাম “আসলে সেদিন ঝামেলার মধ্যে আর...আপনার নামটা জানতে পারি?”
“আরে বাস এসে গেছে। দাড়ান আগে উঠে নি।”
প্রায় ফাকা বাস। একদম পেছনের সিটে এগিয়ে বসে সে আমায় পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল “বসুন।"
আমি একটু শিউড়ে উঠলাম। চিরকাল বয়েজ স্কুলে পড়ার জন্য আর কলেজে একেবারেই না যাওয়ার দরুন মেয়েদের সংস্পর্শে একেবারেই আসিনি বলা চলে। পাশাপাশি কোনো মেয়ের পাশে বসে আছি এটা আমার কাছে কল্পনার অতীত ছিল।
“আপনার নামটা বললেন না?”
একটা হেয়ালির মত দৃষ্টি দিয়ে সে বলেছিল “হাসি।”
“ডাকনাম? আর ভালো নাম?”
“ভালো খারাপের কি আছে! আরেকটা নাম আছে। সেটা কেউই ইউজ করেনা প্রায়। ডাকলে এটাতেই ডাকুন। আপনি কে?”
“আবির। ভারতের ৩৩ কোটি বেকারের মধ্যে একজন।”
হাসি খিলখিল করে হেসে বলল “ তেত্রিশ কোটি তো দেবদেবী শুনেছিলাম। বেকার এই শুনলাম প্রথম।”
“দেবদেবীরাও তো বেকারই বলতে পারেন। খালি স্বর্গ থেকে ফুল ছোঁড়া আর মানুষের ভাগ্যের সাথে ফষ্টিনষ্টি করা ছাড়া তাদের আর কাজ কি?”
“ইসস কিসব কথা!ভগবান মানেননা নিশ্চই?”
“না মেনে উপায় আছে?”
“বুঝেছি। অনেক কথা হবে একদিন। আজ চলি। স্টপেজ এসে গেছে।”
চলে গেছিল হাসি। খুব মিস্টি দেখতে মেয়েটা। মিথ্যে বলে লাভ নেই। মনে মনে সেদিনই ভেবেছিলাম একে নিজের জীবনে না পেলে পুরো জীবনটাই বৃথা। হয়ত প্রথমবার বলেই এরকম ভাবতে পেরেছিলাম।
এরপর হাসির সাথে একদিন দেখা হয় লেকটাউন কফিশপে। আমি জানতাম আবার দেখা হবে। হবেই। হাসিকে দেখেই আমি এগিয়ে গেছিলাম ওর দিকে। ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে কোনো কথা না বলে গটগট করে হেটে কাঁচের দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।
হ্যা।কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ভীষণ কষ্ট। আর পাঁচটা ব্যর্থ প্রেমিকের মত বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েছিলাম অনেকক্ষন। একটু একটু কান্নাও পাচ্ছিল। ঘুমাতে পারিনি সেদিন ঠিকমত। সকালে উঠে ভাবলাম কি বোকার মত করছি। একটা অজানা অচেনা মেয়ে যার নাম আর কোথায় থাকে এটুকু ছাড়া কিছুই জানিনা তার আশায় বসে আছি! ওর একটা নিজের বিশাল বড় দুনিয়া আছে। বন্ধু আছে, প্রেমিক আছে। সেখানে আমার জায়গা কোথায়? আর না। আর ভাববনা ওর কথা। আর না।
ভুলেও গেছিলাম প্রায়। আর হয়ত মনেও পড়তনা। হঠাৎ করে একদিন সেই বাসস্ট্যান্ডে আবার দেখা হয়ে গেল। আমি দেখে কথা বলতে চাইনি। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। ওই এগিয়ে এল দৌড়ে।
“আরে আবিরবাবু না? চিনতে পারছেন?”
“হাসি। কেমন আছেন? খুচরো আছে তো?”
“ধুর আপনার খালি এককথা। আচ্ছা এখন কি ব্যস্ত?”
“কেন বলুন তো?”
“বাড়িতে কেউ নেই এখন। মাকে নিয়ে মামা ডাক্তারের কাছে গেছে। তারপরে আর্দ্ধেক সময় কারেন্ট থাকেনা। তার ওপরে যা গরম। তাই ভাবছিলাম নতুন সিটি সেন্টারটাতে ঘুরে আসি। আপনি যাবেন আমার সাথে?”
সত্যি বলছি আগেরদিনের ঘটনা ভুলে মূহুর্তের মধ্যে আমি আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেলাম। এক গাল হাসি নিয়ে হাসিকে বললাম “নিশ্চই। চলুন।”
হাসির বাবা নেই। ১০বছর আগে ভোটের সময় মারা যান। দুষ্কৃতীরা ধরা পড়েনি। হাসি আর তার মা বিরাটিতে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। খরচ মোটামুটি দুই মামারাই চালায়। এছাড়া হাসির বাবারও কিছু পেনসন আসে। ভাগ্যক্রমে হাসির দুই মামাই খুব ভালো। বড় মামা নিঃসন্তান। বড়মামীও তাকে নিজের মেয়ের মতনই দ্যাখে। হাসিদেরকে তারা তাদের সাথেই থাকতে বলেছিল। কিন্তু হাসির মা রাজী হননি। বিয়ে করে চলে আসার পর বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়া পাপ। তাই কাছাকাছি বাড়িভাড়া করে থাকেন। হাসি বি এ থার্ড ইয়ার পড়ছে বিটি কলেজে। সেক্টর ফাইভে ভুগোল কোচিং এ পড়তে আসে।
আমি একমনে হাসির কথা শুনে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম প্রেমিকরা কিভাবে তাদের প্রেমিকার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকে। আগে ব্যাপারটা বড়ই ন্যাকা ন্যাকা লাগত। আজ লাগছেনা।
হাসির মোবাইল নম্বর পেলাম। আমারটাও দিলাম। বিরাটিতে নামার আগে হাসি বলল “আপনি খুব ভালো শ্রোতা। নিজের কথা কিন্তু কিচ্ছু বললেননা।”
আমি সাহস করে বললাম “তাহলে তো আরেকদিন দ্যাখা করতে হয়।”
হাসি বলল “ হ্যা তা তো হবেই। কিন্তু এইভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা খুব ভাল লাগে। এছাড়া ফোন তো থাকলই।”
সেদিন রাতে ভাবছিলাম এখন তো হাসির সমন্ধে অনেককিছুই জানা হয়ে গেল। এবার কি নিজেকে ওর পাশে ভাবতে পারি? আবার শুরু করলাম! কিন্তু ভাববই না বা কেন? আমি কি খুব খারাপ দেখতে?
পরেরদিন সকালে উঠে মোবাইল খুলে দেখলাম হাসির এসএমএস। “সুপ্রভাত। দিনটা ভালো কাটুক।”
বুকের মধ্যে কিছু একটা লাফাতে লাগল। ফিল্ম আর উনিশ কুড়ি মার্কা গল্পের সমস্ত বোকা বোকা জিনিসগুলো নিজের সাথে ঘটতে দেখে অবাক হলাম খুব। তার থেকেও বেশী অবাক হলাম এটা জেনে যে ওরা ঠিকই লেখে,দ্যাখায়!!!
এসএমএস এ হাসির সঙ্গে রোজই ছোটখাট কথা চলতে লাগল। কিন্তু নিজে থেকে হাসি কোনওদিনই দেখা করতে চায়নি। আমিও লজ্জায় কিছু বলিনি। কলেজের কথা, মায়ের কথা মামাদের কথা, ভাগ্নের কথা শুনাত আমায়। আমিও নিজের বাড়ির কথা, টিউশনির ছাত্রদের কথা, চাকরী খোঁঝার কথা ওকে শোনাতাম। ও আমায় আশ্বাস দিত। দিন কেটে যাচ্ছিল।
হঠাৎ একদিন আমার মাথায় এল হাসিকে কোনোদিন তো জিগেস করিনি ওর কোনো প্রেমিক আছে কিনা?
কথাটা মাথায় আসতেই বুকের মধ্যে একটা পাথর জমে গেল। হাসি কত কথা বলেছে। এই ব্যাপারে তো কোনোদিন কিছু বলেনি। থাকলে নিশ্চই বলত। আবার খুব নিজস্ব ব্যাপার বলে এড়িয়েও যেতে পারে। আমি অঘাধ জলে ভাসতে থাকলাম।
পরেরদিন বুকে হাত রেখে জিগেস করে ফেললাম এসএমএস এ। “তোমার প্রেমিক নেই?”
প্রায় পনের মিনিট পরে জবাব এল “হ্যা আছে তো। তোমায় বলিনি ওর কথা?”
সেদিন ছিল সোমবার। হাসিকে তার প্রেমিকের কথা জিগেস করার তিনদিন পর। আমি ঠিক করেছিলাম সেক্টর ফাইভের পড়ানোটা ছেড়ে দেব। কারণ আমি জানতাম যতই ওকে ভোলার চেষ্টা করি ওর সাথে দেখা হলে কিছুতেই আর পারবনা। শেষ তিনদিন ও অনেক এসএমএস করেছিল। আমি উত্তর দিইনি। ও ও একদিন পর চুপ হয়ে গেছিল। বোধয় বুঝতে পেরেছিল আমার মনের কথাটা। আমি চাইনি ওর সাথে আর কোনোরকম যোগাযোগ থাকুক। তাই শেষ সুতোটাও কেটে দেব ঠিক করলাম।
কিন্তু ওই ভাগ্য। হয়ত অন্যকিছু চেয়েছিল।
ফেরার সময় দেখি বাসস্ট্যান্ডে হাসি। আমি মুখ ঘুরিয়ে এগিয়ে যাব ভাবছিলাম। হাসি ছুটে এল।
“আবির আবির...”
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম “আরে তুমি! দেখ আবার ঠিক দেখা হল। তুমি খুশি তো?”
“তোমার কি হয়েছে আবির? তুমি এসএমএস এর উত্তর দাওনা কেন?”
একটু দোনামনা করে বললাম “আসলে ব্যালান্স শেষ হয়ে গেছিল। তাই করিনি। আজই ভরতাম।”
“একটা ফোন তো করে বলতে পারতে।”
একটু ভ্রু কুঁচকে বললাম “সেতো তুমিও করতে পারতে।”
“ঠিক আছে। আমারই ভুল। তবে আজ ছাড়ছিনা।”
অবাক হয়ে বললাম “ছাড়বেনা? মানে?”
“মানে আজ তুমি আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে।”
বেশ অপ্রস্তুত হলাম। খানিকটা বিরক্তও। কি চায় এই মেয়েটা? কেন এইভাবে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে আমাকে? না কি আমার অবস্থা বুঝে বিদ্রুপ করছে?
“না হাসি। আজ সম্ভব নয়।”
হাসি চোখ পাকিয়ে বলল “ একদম চুপ। কোনো কথা বলবেনা। আমি জানি তোমার কোনো কাজ নেই এখন। যাবে মানে যাবে।”
একরকম টানতে টানতে আমাকে বাসে তুলল হাসি। বিরাটিতে নামতে হল আমাকে। একটা শ্যাওলা মাখা পুকুরের পাশ দিয়ে একতলা একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়াল।
“মা ও মা...”
এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। গায়ের চামড়া কুঁচকাতে শুরু করেছে। উচ্চতা ও মুখের গড়ন অবিকল হাসির মত। আমি নমষ্কার করলাম। হাসিমুখে তিনি বললেন “তুমিই আবির? মধ্যমগ্রামে থাক?”
“হ্যা কাকিমা।”
“হাসি তোমার কথা অনেক বলেছে। নতুন বন্ধু। আমার মেয়েটা পুরো পাগল। তোমায় জ্বালায় নিশ্চই খুব।”
মনে মনে বললাম “ সেই জ্বালা আমি ছাড়া আর কে বুঝবে। বড় অসহনীয়।”
“ওফ মা তুমি থামবে। একটু চা কর না। আমি আবিরকে একটু ঘুরিয়ে আনি চারিদিক।”
শিশুর মত আমার হাত ধরে হাসি ওদের বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। রান্নাঘর উঠোন, বাড়ির পিছনের একচিলতে বাগান ঘুরিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেছিল আমাকে। ততক্ষণে আমি গত তিনদিনের সমস্ত প্রতিজ্ঞা ভুলে গেছি। বশীভূত করে ফেলেছে আমাকে হাসি। মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর কথা শুনে যাচ্ছি। একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে।
“তোমায় কয়েকটা জিনিস দ্যাখাচ্ছি। আগে বল কাউকে বলবেনা। প্রমিস কর।
আমি একটু হেসে কন্ঠনলীতে হাত ঠেকিয়ে বললাম “প্রমিস।”
“না, আমাকে ছুয়ে বল।”
সেই অঙ্গীকার। বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে হাসি। আমিতো চাই ছুতে। কিন্তু পারছিনা। হাত বাড়িয়েছি। শুধু স্পর্শ করতে পারছিনা। চারিদিকে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। হিপনোটিজম কি একেই বলে? আমার চোখের পলক পড়ছেনা। শুধু একটা কথাই কানের সামনে বেজে চলেছে। আমাকে ছুয়ে বল। আমাকে ছুয়ে বল। প্রবল চেষ্টার পর ছুলাম ওকে।
একগাল হেসে বলল “ঠিক আছে। দাড়াও দ্যাখাচ্ছি।”
খাটের পাশের ডাই করা বইগুলোর ফাঁক থেকে একটা সুটকেস বের করল হাসি। স্টিলের সুটকেস। আগেকারদিনের স্কুল পড়ুয়ারা যা ব্যবহার করত। ধীরে ধীরে সেটা খুলল হাসি। আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম।
একরাশ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গোলাপফুল। কয়েকটা ছবি। হাতে আঁকা। অনেকগুলো কাগজ। লেখায় ভরতি। ভীষণ যত্নের সাথে হাত বুলিয়ে আমার সামনে এগিয়ে ধরল হাসি।
অবাক হয়ে বললাম “এগুলো কি?”
লজ্জার সাথে মাথা নীচু করে হাসি বলল “তোমায় আগেরদিন বললাম না প্রসুনের কথা? মানে আমার প্রেমিক মানে ওই আর কি। ওর দেওয়া। আমার জীবনের খুব খুব কাছের জিনিস এগুলো। কাউকে দেখাইনি শুধু মা ছাড়া। তোমায় দেখালাম আজ। প্লিজ কাউকে বোলোনা কিন্তু। ছুয়ে বলেছ কিন্তু আমাকে।”
আমার পায়ের নিচের মেঝেটা কাঁপছিল। গা গুলোচ্ছিল কিরকম। কাকিমা চা দিয়ে গেছে। প্রসুনের দেওয়া গিফটগুলোকে নিয়ে হাসিকে খেপাচ্ছে। হাসি ঝগড়া করে চলেছে। কাকিমা পাশের ঘরে গেল। আমি কাপটা হাতে নিয়ে বসে আছি। কথা বলার ক্ষমতা নেই। হাসি একটা কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল...
“নোনতা গালের দুই ইঞ্চি ছুয়ে
একপাতা জল, আরেকটু বর্ষাকাল
একটা কালো ছাতা, কিছু রঙ্গীন প্লাস্টিক
ঘর ভুল করা দুটো ভেজা পায়রা
এসব দেখলে এখন অতটা মন খারাপ করেনা;
দক্ষিনে হাওয়া বইছে।
জানি এই মেঘ তোমাকেও ভেজাবে।
যেমন আমার বুকপকেটের স্রোত
যেমন তোমার ভিজে ওরনার হাসি...
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছিল। হাসির সাথে আর দেখা হয়নি। কিছু টুকটাক এসএমএস এ কথা। আমি অনেকটাই নিজেকে পিছিয়ে নিয়েছিলাম। হাসি অনেকবার বলেছিল ওদের বাড়ি আসতে। নানা কাজের অজুহাতে এড়িয়ে গেছি। আমি মেনে নিয়েছিলাম হাসির জন্য প্রসুন মানানসয়ী। ব্যাঙ্গালোরে থাকে। মেকানিকাল ইঞ্জিনীয়ার। হাসির ওর প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা আমায় অবাক করেছিল। সাথে সাথে নিজের কপালকেও দুষেছি। হায়রে এরকম কেউ আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। জানিনা বাসবে কিনা। হাসির বুকের মাঝে আগলে রাখা প্রসুনের অনেক চিঠি, হলুদ হয়ে আসা কাগজে লেখা কয়েকটা কবিতা। একটা ছোট্ট পাসপোর্ট সাইজের ছবি। কান্না পেয়েছিল আমার সেদিন। কিন্তু মুগ্ধ হয়েছিলাম প্রকৃত ভালোবাসাকে নিজের চোখের সামনে দেখে।
৩০শে মার্চ বুধবার হাসির সঙ্গে দেখা হল নাগেরবাজারে। আমায় দেখতে পেয়েই একগাল হেসে লাফিয়ে পড়ল সামনে।
“কোথায় যাচ্ছ?”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম “নতুন একটা টিউশনি পেয়েছি। এই ফিরছি পড়িয়ে।”
“আগেরটা ছাড়লে কেন? ওটাতো কিছুদিন আগেই নিয়েছিলে।”
বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে বললাম “ আসলে ছেলেটা গবেট ছিল। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার। এইটা তাও বেটার।” শুকনো হাসি হাসার চেষ্টা বললাম “আমার থেকে বেশি বোকাও যে আছে পৃথিবীতে এই দেখলাম।”
হাসি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল “ একটু আমার বাড়ি যাবে এখন। দরকার আছে।”
“না হাসি। অন্য একদিন যাব। আজ একটু কাজ আছে।”
“আমি জানি কোনো কাজ নেই। চল আমার সাথে।”
একটু কড়াভাবে বললাম “না হাসি। মিথ্যে কেন বলব! কাজ আছে বলেই বলছি। আজ সম্ভব নয়।”
আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হাসি পিছন থেকে আমার শার্টের হাতা খিমচে ধরে বলল “ না যাবে তুমি আমার সাথে।”
এবার বেশ রেগে গেলাম। দৃঢ়ভাবে বললাম “আহ হাসি সিন ক্রিয়েট কোরোনা রাস্তার মধ্যে। যাবনা বলেছিতো একবার।”
হাসি আমার চোখে চোখ রেখে বলল “ তুমি আমায় ভালোবাস তো? বলনি কেন কোনোদিন?”
আমি পাথর হয়ে গেলাম। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। চারিদিকে হাজার মানুষের চলাফেরা, হইহুল্লোড়, যানবাহনের শব্দ, ফেরিওয়ালাদের ডাক সবকিছু উপেক্ষা করে উত্তর খুঁজতে লাগলাম প্রশ্নটার। কি বলব ওকে? হ্যা আমি ভালবাসি। কিন্তু কোনোদিনই প্রসুনের জায়গা নিতে পারবনা। হ্যা হয়ত সত্যিই আজ নিতে চাইনা। বলিনি কেন? এই প্রশ্নটা নিজের মনেও করেছি নিজেকে অনেকবার। কি বলতাম ওকে? সিনেম্যাটিক কায়দায় বলতাম সবকিছু ভুলে আমার কাছে ছুটে আসতে? হ্যা হাসি আমি তোমার জন্যে সবকিছু করতে পারি? প্রথমদিন তোমায় দেখার পর থেকে অজস্র বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি? বই এর পাতায় তোমার নামের কোনো চরিত্রকে পেলে শুঁষে নিতে চেয়েছি সমস্ত শব্দের গভীরতাকে? মেনে নিতে তুমি? না সেই প্রথমবার দেখার অবহেলিত দৃষ্টির সাথে পোয়াটাক ঘৃনা মিশিয়ে সম্পূর্ণভাবে বর্জিত করতে নিজের থেকে। সেটা সহ্য করতে পারতামনা বলেই বলিনি।
আমার হাতে হাত রেখে হাসি বলল “বাস এসে গেছে। চল।”
আবার হার মেনেছি আমি। হেরে গেছি ওর কাছে। হয়ত জেতার কোনো যোগ্যতাই হয়নি আমার কিছুতেই। প্রসুনের কাছে, হাসির কাছে, ওদের ভালবাসার কাছে; প্রতি পদক্ষেপে হেরে গেছি আমি।
সেই পুকুরপাড় ধরে একরাশ অনুভূতি নিয়ে আবার হাসির বাড়ি গেছিলাম। হাসির মা, চৌকাঠ, বারান্দা পার করে হাসির ঘরে গেলাম।
“তুমি উত্তরটা এখনও দিলেনা।”
অসহায়ের মত বললাম “কি বলব হাসি? সত্যি আমার এই বিষয়ে কিছু বলার নেই। যদি কোনো উপায় থাকত বলতাম।”
হাসি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল “জানোতো প্রসুনও প্রথমবার কিছু বলতে পারেনি। অনেক জিগেস করার পর দুদিন পরে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছিল। শুনবে?”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাসি সেই সুটকেস থেকেহলুদ হয়ে আসা কাগজগুলো হাঁতড়াতে শুরু করল। কিছুক্ষন পর একটা কাগজ থেকে পড়তে শুরু করল...
এইতো ছিল ভাল
হাজারটা প্রেম লুকিয়ে থাকার ঘরে
লাজুক মুখে পেরিয়ে যাওয়া পথে
ভীষণভাবে মনখারাপের আলো
বিলাসবহুল ছাপোষা অন্তরে
নাহয় আবার কুড়িয়ে নেব মাটি
জলের সাথে মিশব তেপান্তরে
বৃষ্টি বলুক এইতো আছি ভাল
তোমার সাথে হারিয়ে যাব পরে...
ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মেঝের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাসি বলে যাচ্ছিল “ আজ থেকে দেড় বছর আগে ব্যাঙ্গালোরের টাটা স্টীলের একটা সাইটে কাজ চলাকালীন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে। একটা ভারী মেসিন পড়ে প্রোজেক্ট ইঞ্জিনীয়ারের মাথা চূর্নবিচুর্ন হয়ে যায়। আনন্দবাজার পত্রিকাতেও ফলাও করে বেড়িয়েছিল ঘটনাটা। কারন ওই ইঞ্জিনীয়ার একজন বাঙ্গালী ছিলেন। সরকার থেকে ওই ইঞ্জিনীয়ারের বাড়িতে ১লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ব্যাস।
আমার দিকে তাকিয়ে জলশুন্য চোখে তাকিয়ে হাসি বলল “ প্রসুন মারা যাওয়ায় আমি কাঁদিনি আবির। কারন আমি জানি ও আমায় ছেড়ে যেতে চায়নি। শুধু দেহটা নেই বলেই কি আমি ভালবাসা ছেড়ে দেব ওকে? মাকে জানাইনি কারন আমার বাবা নেই, এরপর এই ঘটনা শুনে মা আর স্থির থাকতে পারতনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দেওয়ায় চেষ্টা করত। সেটা যে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতামনা।
আমি চোখ খুলে রাখতে পারছিনা। কাঁদছি নাকি আমি? এমন কারো জন্য যাকে কোনোদিন দেখিনি, শুনিনি, শুধু তার ভালোবাসাকে চিনি, আর কয়েকটা কবিতা...
হাসি বলল “তোমার সাথে বন্ধু হওয়ার পর থেকে আমি প্রসুনকে খুঁজেছি তোমার মধ্যে। না পাইনি খুঁজে। হয়ত পাবওনা কোনোদিন। কিন্তু ভালোবাসাটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। ভালবাসা আমার কাছে ভীষণ দামী আবির। তাই বারবার তোমায় ডেকেছি, কথা বলতে চেয়েছি, বন্ধুত্ব রাখতে চেয়েছি। প্রসুনকে আমি ভুলতে পারবনা কোনোদিন। কিন্তু তোমাকেও হারাতে চাইনা কিছতেই। সবকিছু হারানোর পর এই বন্ধুত্ব, তোমার ভালোবাসা এইটুকুই আমার শেষ সম্বল। আমাকে এইভাবে মেনে নিতে পারবে আবির? বিয়ে করবে আমাকে?
আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলামনা। অষ্ফুটে বললাম “হ্যা হাসি করব।”
কেটে গেছে মাঝে দুটো বছর। আজ সকালে হাসির মা হৃদরোগে মারা গেলেন। আমাদের বিয়ে হয়েছে। গত ছমাস ধরে হাসি সন্তানসম্ভবা। হাসি কিন্তু প্রসুনকে ভোলেনি। হাসির কথা আমিও ভুলিনি। হয়ত ভুলবওনা। আজ দমদমের নাগেরবাজারে এসে সেই দিনটার কথা ফিরে এল আমার মনে। তার সাথে হলুদ কাগজে আটকে থাকা একটা কবিতা...
তিনদিক কালো করে আসা কোনো একটা বিকেলে
পারদের স্নান, মুহুর্তগুলো ধুলোয় মিশে যায়,
খসে যাওয়া পালকের মত ক্ষতস্থানময়
তুমি গুনে যাও সারাদিন,
নাহয় আজ কাকভেজা রোদ্দুরে পথিকের সাথে
আমি পুড়তে পারিনি
তবু,
আমি দূরে যেতে পারিনি...
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৪২