somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফেলুদার তোপসে
নিষ্পত্তি কি সব সময়ে জয়-পরাজয়ে? ময়দানি ধুলোয় তার বাইরেই যে পড়ে থাকে খেলার আসল-নকল গল্পগুলো৷ ময়দানের ঘাস-ধুলো যাঁর প্রিয়তম বন্ধু, তাঁর কলমে অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ৷

গ্রামের নামটি 'বিরহী'

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিরহী নামের কোনও গ্রাম হতে পারে আমাদের এই বাংলায়? থাকলে সেই গ্রামের লোকগুলো কেমন? আমার আপনার মতো চিরকালীন বিষয়ী, লোভী, হিংস্র, স্বার্থপর, রাগী হবে? না, একটু উদাস উদাস? চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন? সংসার, মানুষজন, জীবিকা সম্পর্কে খোঁজই রাখে না।



রোদ পড়েছে মাঠে, জ্যোৎস্নায় ভাসছে সবুজ বাগান, রিমঝিম বৃষ্টি পড়ে চলে জাতীয় সড়কে–শুধু এ সব নিয়েই তাঁদের যাবতীয় আগ্রহ? শুধু বিরহের গজল আর পুরোনো আধুনিক গান গায়? নি:শব্দে হারানো প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য চোখের জল ফেলে। বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলোর মতো পরাবাস্তব, স্বপ্নময় চরিত্র সব। মোটেই বিষয়ী নন। সংসারীও নন।



বারাসত থেকে জাতীয় সড়ক ধরে শান্তিপুরের দিকে এগোলে, হরিণঘাটা পেরোলেই ‘বিরহী’ গ্রাম। সরকারি বোর্ডে বড় করে লেখা রয়েছে ‘বিরোহি’।



দেখে একটু ধাক্কাই খায় চোখ–আহা, তা হলে কি এ গ্রামের নাম ‘বিরহী’ নয়? বিরহী নামের গ্রাম আর জীবনে খুঁজে পাওয়া হল না!নদী একটা রয়েছে গ্রামে ঢোকার মুখেই। নাম যমুনা। সে তো কচুরিপানায় এমন ঢাকা, যে নদী বলে মনেই হয় না। খাল মনে হয়। জাতীয় সড়কের উপরে কোনও ক্যালভার্ট।



তবু নদী তো নদীই! গ্রামের লোকেরা বললেন, ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে সে নাকি মিশেছে ইছামতীতে। কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়েছে আরও শীর্ণা হতে হতে প্রেমিক ইছামতীর দিকে। এ নদী বিরহী হয়েও খুঁজে নিতে পারে প্রেমিক।



বড় রাস্তার বাঁদিকে অজস্র গাছের মধ্যে উঁকি মারে দুটো সাদা রংয়ের ইঁটভাটা। ডানদিকে একটা দীর্ঘ ছায়া নিয়ে দাঁড়িয়েছে শিরীষ গাছ।তাদের ছায়াই অন্যরকম। বটের ছায়া থেকেও বেশি মায়াময় এক এক সময়। বাসস্টপ কয়েক পা দূরে। সেখানে গিয়ে আশ্বস্ত হওয়া গেল। সব দোকানের সাইনবোর্ডে নাম ‘বিরহী বাজার’। গ্রামের নাম বিরহীই। বিরোহি নয়।



বিরহীরও নামের পাশে বাজার বসে তা হলে! বিরহী শব্দের সঙ্গে আর যাই হোক, ঠিক বাজার মানায় না। তবে কী করা যাবে? সব মফসসল বা আধা শহরে এ সব হয়। নামের সঙ্গে জুড়েই যায় বাজার। মাইকে গান বাজছে। এ গ্রামের লোকেরা তো আমাদের মতোই। ভেতরে গিয়ে সবুজে সবুজ একটা গ্রাম পাওয়া যায়। বাঁশ, কলা, ধান, বট, অশ্বত্থ। শব্দহীন। হালদারপাড়া এটা। সবুজ ফুটবল মাঠে গরু চরে। গায়ে সাইনবোর্ড লাগানো। ‘বিরহী ভারতী সঙ্ঘ’। স্থাপিত ১৯৬১। বিরহী ভারতী সঙ্ঘ শুনতে কেমন লাগে! আর একটু এগোলে অন্য একটা ক্লাবের নাম ‘বিরহী’র মতোই অন্যরকম মন কেমন। ‘বটবৃক্ষ মিতালী সঙ্ঘ’। ওখানে সত্যিই একটা বটগাছ রয়েছে। দীর্ঘ ছায়া নিয়ে।



নদিয়া জেলার এ গ্রামের একটাই রাস্তার মোড়। জাতীয় সড়ক থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে মদনপুর রেলস্টেশনের দিকে, অন্য রাস্তা নোয়াখালির দিকে। পৃথিবীর এটাই মজা। গ্রামের নাম বিরহীও হয়, আবার তার পাশে মদনপুরও থাকে। মদনপুরের লোকদের নিশ্চয়ই বিরোহীর লোকদের ওপর রাগ হয়, ঈর্ষা হয়। তোদের গ্রামের এত ভালো নাম, আর আমাদের…।



মদনপুরের দিকে একটু হাঁটলেই অবশ্য একটা বড় রহস্য ফাঁস হয়। এ গ্রামের নাম কেন হল বিরোহী? কেনই বা হঠাৎ এল মদনপুর নাম।হয়তো সবই লোকগাথা। স্রেফ গল্প। তবু তো বিরহের স্পর্শে অন্য রকম হয়ে উঠছে ভালোবাসার সুগন্ধ। সেই রাধা কৃষ্ণের চিরন্তনী প্রেম।

রাস্তার বাঁ দিকে ছায়ামাখা এক মন্দির। মদনমোহনের। স্থাপিত ১৭৬০ সাল। মানে পলাশী যুদ্ধের তিন বছর পরে তৈরিহয়েছিল এ মন্দির। মূর্তি দেখে তাক লেগে যায়, এ কী দেখলাম! কালো রূপ ঠিককে বেরোয় মদনমোহনের। কোথাও যা দেখিনি, এখানে তাই নজরে এল। ছোট মন্দিরে রাধা কৃষ্ণের মূর্তির পাশেই বিরাট খাট, বিছানা, মশারি। রাতে মদনমোহনের শোয়ার নিপাট ব্যবস্থা।



মদনমোহনের মন্দির থেকে মদনপুর নাম হতে পারে। কিন্তু বিরহী? সে নাম কী করে হল?



গল্পটা বললেন শুভ্রাংশু রায়। আদতে উত্ত প্রদেশর লোক, পদবি তিওয়ারি। পাঁচ পুরুষ হল এখানে। নদিয়ার রাজা তখন বিখ্যাত কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি এঁদের পূর্বপুরুষদের পদবি করে দেন রায়। ওই সূত্রের এ অন্চলের জমিদার হয়ে ওঠেন রায় পরিবার। সেই জমি অবশ্য অত নেই। রায়বাবুদের এক বিশাল হাট রয়েছে। আর মোড়ের মাথায় বাড়িতে ওষুধের দোকান কুন্দন ফার্মেসি। কথা হল ওখানেই। কৃষ্ণচন্দ্রের কথা, বিরহী গ্রামের নামের কথা।



ওই কৃষ্ণচন্দ্রই এক রাতে স্বপ্ন দেখে মদনমোহনের মন্দির বানিয়েছিলেন এ গ্রামের যমুনাতীরে। গোপাল নামে এক বালক ছিল। সে নাকি কাঁঠাল গাছের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। তার কথা ভেবেই কাঁঠাল কাঠ থেকে তৈরি হয় মদনমোহনের মূর্তি। কিছুদিন বাদে কৃষ্ণচন্দ্র আবার স্বপ্ন দেখেন। মদনমোহন বলছেন, তিনি রাধার বিরহে কাতর। একা মন্দিরে থাকতে পারছেন না। যমুনা নদী একেবারে মন্দিরের গায়েই। সেখানে ভেসে আসছিল নিমগাছ। সে কাঠ থেকেই তৈরি হয় রাধা মূর্তি।



বিরহের দিন শেষ। তবু থেকে গিয়েছে বিরোহী নামটি। দুশোর বেশি বছর হয়ে গেল। জানি না, এত সুন্দর গল্পের সঙ্গে জড়িত মন্দিরের তেমন প্রচার হল না কেন। বাঙালি তো জানেই না এ অনি:শেষ বিরহ মন্দিরের গল্প। বিরহের গ্রামের রূপকথা।

যমুনা পাশে থাকলেই কি রাধার জন্য বিরহে কাতর হয়ে ওঠেন শ্যাম? কচুরিপানা ভর্তি নদীটিতে যতটুকু দৃশ্যমান জল মন্দিরের গায়েই। কার্তিকের রোদভরা সকালে গিয়ে দেখি, প্রাচীণ সব বটের দীর্ঘ ঝুরি নেমে এসেছে প্রায় জল ছুঁতে। ঘাটের সিঁড়ির পাশে শুধু জল দৃশ্যমান। সেখানে আজও পড়ে প্রচুর মূর্তির কাঠামো। মানে গ্রামের সব মূর্তির বিসর্জন ওখানেই হয়। ভাইফোঁটার সময় মন্দিরের সামনে গাছের ছায়ায় মেলা বসে। সেখানে হিন্দু বোনেরা ফোঁটা দেন মুসলিম ভাইদের। মুসলিম বোনেরা ফোঁটা দিয়ে যান হিন্দু ভাইদের। বিরহ যন্ত্রণা মুছে তৈরি হয়ে যায় অন্য রকম ভালোবাসা। চুঁইয়ে পড়ে সুখ।



বিরহের দিন শেষ। তবু বিরহী গ্রাম আজও থেকে গিয়েছে। বাংলার এক যমুনা তীরে।

গ্রামের নামটি 'বিরহী'
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪০
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×