somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আশ্রয়

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আশ্রয়
মূল গল্পঃ আর. কে. নারায়ণ
অনুবাদঃ আমি

হঠাৎই বৃষ্টি।
ঠাঁই বলতে সামনের ডাল ছড়ানো বটগাছতলা।
ছন্নছাড়া বৃষ্টিটা মাঝে মাঝেই নানা দিক থেকে অঝোর ধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছে সব, ঝোপের পাশের বেজিটাও বাদ যাচ্ছে না। মহিষজোড়া কেবল নির্বিকার, বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে কলাপাতা খেয়েই যাচ্ছে। গাছতলায় ঠাঁই নেয়া লোকটা সহসাই অন্য একজনের উপস্থিতি টের পেল। বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে এল ভেজা বাতাসে, চঞ্চল মন নিয়ে অন্যজনের মুখোমুখি হতেই লোকটি কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অন্যজন তো রীতিমত চিৎকার দিয়ে উঠল; লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ভেব না, আমি চলে যাব।

সময়ের ব্যবধানে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে এমন বাক্য বিনিময় বেশ অদ্ভূতই বটে! সে পূর্বের স্থানে ফিরে এল। পরমুহূর্তেই আবার ফিরে গিয়ে বলল, তুমি এখানে এলে কেমন করে?

তার ভয় ছিল স্ত্রী হয়ত তার জবাব দেবে না। কিন্তু মৃদুস্বরে সে বলল, বৃষ্টি।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। লোকটি আকণ্ঠ হাসি দিয়ে স্ত্রীকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করল।

স্ত্রী কিছুই না বলে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

হ্যাঁ বৃষ্টিটার জন্যই- বলেই তার কেমন যেন বোকা বোকা অনুভূতি হল।

উত্তরে তার স্ত্রী কিছুই বলল না।

অনাকাঙ্খিত বৃষ্টি- লোকটি আবারও বলল।

স্ত্রী এবারও কোন জবাব না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

আমার যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকত তবে ঘরেই থাকতাম অথবা ছাতা নিয়ে বের হতাম।

স্ত্রী যেন কিছু শুনতেই পেল না।

লোকটি ভাবল জিজ্ঞাসা করবে, তোমার কানে কি কোন সমস্যা হয়েছে?- কিন্তু ভয়ও পেল, পাছে স্ত্রী তার বিরক্ত হয়। রেগে গেলে আবার সে যেকোন কিছুই করতে পারে। সে রাতের চূড়ান্ত ঘটনাটির আগে পর্যন্ত অবশ্য স্ত্রীর অনুভূতির তীব্রতা সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না।

বিবাহিত জীবনের কয়েক বছরে অনেকবারই তারা এমন সংকটপূর্ণ সময় পার করেছে। দৈনন্দিন টুকিটাকি বিষয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। প্রতিটি ছোটখাট প্রশ্ন তাদের জীবন সমস্যার ঝড় তুলত। কোন রেডিও শুনবে, কোন ছবি দেখবে, কোন ফুলের গন্ধ তীব্র, কোন ফুল বেশি দিন তাজা থাকে- এমনি যে কোন প্রশ্নের জবাব নিয়ে তাদের মধ্যে লাগালাগির চূড়ান্ত হত। যে কোন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যেত। এর জের কয়েকদিন ধরে চলত। অনুশোচনায় ভুগে ভুগে সম্পর্ক পুনরায় নতুন দিকে মোড় নিত, মধুরতর হত সে সকল দিন। এমনই এক মধুরক্ষণে এক সময় তারা দেবতা সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করে, যেন পৃথিবীর কোন শক্তিই তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে না পারে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা পার হতে না হতেই যখন তারা প্রতিজ্ঞামালার প্রথম প্রতিজ্ঞা ‘আমরা আর কখনই ঝগড়া করব না’- ভঙ্গ করে তখন অন্য প্রতিজ্ঞাগুলোর বালির বাঁধ এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ে।

আজ এই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে লোকটা এই ভেবে বেশ প্রফুল্লবোধ করে যে স্ত্রী তার বেশ জব্দ হয়েছে। অনেকদিন আগে রাতের বেলা তুমুল ঝগড়ার পর সেই যে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল; তারপর আর সে কোন খবরই রাখেনি। বরাবরের মত তারা রান্না নিয়ে তর্ক করছিল, এক পর্যায়ে স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিলে লোকটিও দরজা খুলে বলল, ‘যাও’। স্ত্রী বের হয়ে সত্যিই চলে গেল। লোকটি অবশ্য দীর্ঘক্ষণ দরজা খোলা রেখেছিল স্ত্রী ফিরে আসবে এই আশায়; কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।

তোমায় আবার দেখতে পাব ভাবিনি।

ভেবেছিলে ডুবে মরব?

হ্যাঁ, আমি তেমনই ভয় পেয়েছিলাম।

তুমি কি আমাকে কুয়া বা পুকুরে খুঁজেছিলে? বা নদীতে?

না তা করিনি।

করলে অবাক হতাম।

অবশেষে তুমি ডুবে মরনি। কিন্তু এজন্য তুমি আমাকে দায়ী করছ কেন?

একথা থেকেই প্রমাণিত হয় যে তোমার মন বলে কিছু নেই।

তুমি খুবই অযৌক্তিক ভাবে আমাকে দোষী করছ। তোমার স্বভাবটাই এমন!

ও, এরই মধ্যে আমার স্বভাব নিয়েও কথা বলতে শুরু করেছ? আসলে আমারই দুর্ভাগ্য যে বৃষ্টির কারণে আমাকে এখানে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

অন্যদিকে আমি বলব বৃষ্টিটা খুবই শুভ। এটা আমাদেরকে একত্রিত করেছে। আমি কি জানতে পারি এতগুলো দিন তুমি কি করেছ?

আমার কি জবাব দেয়া উচিত?

স্ত্রীর কণ্ঠে অনুযোগ ঝরে পড়ায় লোকটি সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কি করা যায় ভাবতে লাগল। বলল, আমার প্রতি কি তোমার কোন মায়া নেই? আমাদের ভাগ্য কি একসাথে জড়িত না? তুমি কি একবারের জন্যও জানতে চাইবে না এতগুলো দিন আমি কেমন করে কাটিয়েছি। কোন জবাবই সে পেল না অন্যদিক থেকে। স্ত্রী তার অপলক দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টি বাড়তে থাকল। হঠাৎই এক পশলা বৃষ্টি তার মুখ ভিজিয়ে দিল। লোকটি সুযোগ হাতছাড়া না করে রুমাল বের করে এগিয়ে আসতেই সে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল

আমায় নিয়ে ভেব না।

তুমি ভিজে যাচ্ছ।

উপরের ডালপাতা চুঁইয়ে আরো পানি তার শরীরে পড়ল। লক্ষ্য করে লোকটি বলল-

তুমি খুব বেশী ভিজে যাচ্ছ। এদিকে সরে এস। আর তুমি চাইলে আমি তোমার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই। আমায় নিয়ে না ভাবলেও চলবে

আমি কি বাইরে গিয়ে ছাতা বা ট্যাক্সি নিয়ে আসব?

কোন পাত্তা না দিয়ে স্ত্রী শুধু একবার তাকালো। লোকটি আরও কিছু বলতে চাইলে বাঁধা দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় স্ত্রী বলল,

আমি কি তোমার খেলনা?

খেলনার কথা বলছ কেন? আমি কি তাই বলেছি?

খেলনাই তো মানুষ যখন খুশি ছুঁড়ে ফেলে আবার যখন খুশি তুলে নেয়।

আমি কখনই তোমাকে চলে যেতে বলিনি।

এ ব্যাপারে আমি আর কিছুই বলতে চাই না।

আমি কাতরভাবে বলছি আমি এ ঘটনার জন্য খুবই দুঃখিত।

হতে পারে। কিন্তু যাও, একথা গিয়ে অন্য কাউকে বল।

একথা বলার মত আমার আর কেউ নেই।

সেটা তোমার সমস্যা। এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

তোমার কি হৃদয় বলে কিছুই নেই? আমি বলছি আমি অনুতপ্ত, ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে বিশ্বাস করো। সত্যিই আমি অনেক বদলে গেছে।

আমিও। আমিও আগের আমি নেই। এখন আর আমি কারও কাছেই কিছু আশা করি না। আর তাই হতাশ হবারও প্রশ্ন ওঠে না।

বল না এতদিন তুমি কি করেছ?

না।

কেউ কেউ বলে তুমি হরিজনের কাজ করো; দেখেছ আমি তোমার কত খোঁজ রাখি? তুমি কি পুরো সময় জুড়ে হরিজন পল্লীতেই ছিলে?

লোকটি ইনিয়ে বিনিয়ে তার স্ত্রীর ঠিকানা জানতে চাইল।

স্ত্রী বিরক্তমুখে পুরুষটির দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির দিকে মুখ ফেরাল।

তুমি এমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? বৃষ্টিকে তো আমি নামতে বলিনি। যাহোক, ভালোই হয়েছে। আমাদের দু’জনের তো দেখা হলো।

মোটেই না। কিছুই আমাকে আর আটকাতে পারবে না। বলেই লোকটির স্ত্রী বৃষ্টির মধ্যে নেমে দৌড়ে চলে গেল ।

লোকটি পেছন থেকে চিৎকার করতে লাগল, থাম, থাম। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আর কোন কথাই বলব না। ফিরে এসো, এভাবে ভিজো না।

কিন্তু সে দাড়ালো না, বৃষ্টির পর্দার আড়ালে ঝাপসা হয়ে গেল সব।

লেখক পরিচিতিঃ
আর কে নারায়ণের জন্ম ১৯১০ সালের ১০ অক্টোবর ভারতের মাদ্রাজে। তিনি ১৯৫৬ সালে রকফিলার ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে আমেরিকা পাড়ি দেন। তার বেশির ভাগ রচনাই ইংরেজিতে। তার উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে- উপন্যাস: দ্য ডার্ক রুম, দ্য ইংলিশ টিচার, টকেটিভ ম্যান, দ্য ওয়ার্ল্ড অব নাগরাজ ইত্যাদি। ছোটগল্প: মালগুড়ি ডেইজ, আন্ডার দ্য বায়রন ট্রি এন্ড আদার স্টোরিজ ইত্যাদি। তিনি ২০০১ সালে ১৩ মে মৃত্যুবরণ করেন।


৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×