তার বিয়ের দিন আমি তার বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। সাথে আমার বেশ কজন বন্ধুবান্ধব ছিলো। তার সাথে আমার সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই ওদের সামনেই বলতে গেলে।স্বাভাবিকভাবেই তারা আমাকে সঙ্গ দিলো। হাটতে হাটতে গল্প করছিলাম আড্ডা দিচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার ভেতরটা বারবার ঘেমে যাচ্ছিলো। রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে যত তার বাসার কাছাকাছি আসছি, ততই মনে হচ্ছে আমার চোখ গরম হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটু পরেই গলে বেরিয়ে যাবে। আর কখনোই তাকে দেখা হবেনা..
তার বাসার সামনে একটি মসজিদ ছিল। একদম বাসার সাথেই। তার ঘর থেকে দু পা ফেললেই মসজিদটা। তার বাসায় যখন গিয়ে পৌছুলাম, দেখলাম মসজিদের সামনের খালি জায়গাটায় কিছু দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। বেশ কিছু মানুষ সেখানে বসে মোনাজাত করছে। এক দুজন নতুন যারা আসছে তারাও যোগ দিচ্ছে সে মোনাজাতে। আমরাও যোগ দিলাম। আমার বন্ধুবান্ধবসহ আমি বসে গেলাম।
মোনাজাত ধরার জন্য হাত তুলেছি ঠিকই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কোন মোনাজাত করা হয়নি আমার। হাত দুটো শুধু মুখের সামনে ধরে রেখেছি আর ভাবছি, কি দোয়া করব? সে ভাল থাকুক? কোথায় ভাল থাকবে? আরেকজনের বিছানায়? সেখানে তো সে যেতে চায় নি। তাহলে এসব দোয়া করে লাভটা কি হচ্ছে? কি হবে?
বিয়ের আগে তার সাথে আমার মাত্র একদিনের জন্যে দেখা হয়েছিলো। তাও তার ইচ্ছেতেই। আমার খুব বিদঘুটে চেহারার কারনে কখনোই চাইনি তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু সে দেখা করেই ছেড়েছিলো। নাছোড়বান্দা হয়ে জেকে ধরেছিলো সে। ভেবেছিলাম এরপরে হয়তো আমার প্রতি তার আগ্রহ হারিয়ে যাবে। হয়েছিলো উল্টোটা।
বিয়ের দিনও আমি তাকে ভালমত দেখতে পারিনি।রাস্তা থেকে গাড়ির গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিলো অল্প কিছুক্ষনের জন্যে।সে এমনিতেও সুন্দর। বিয়ের সাজগোজে আরো অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো তাকে। তবে এই সৌন্দর্যটা আমাকে সেদিন মুগ্ধ করতে পারেনি। তার পাশে নতুন যে লোকটা বসে আছে, তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে।
সেদিন যখন বাসায় ফিরেছি ওইদিন প্রায় চার ঘন্টার মত ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে দিয়ে ঝড়ের মত কেঁদেছি। আমার ফোনের পাসওয়ার্ড ছিল তার নামে। কি যে কষ্ট হয়েছিলো সেটা চেঞ্জ করতে! তার দেয়া ম্যাসেজগুলো ডিলিট করতে গিয়ে মনে হয়েছে শরীর থেকে একটি একটি করে রগ কেটে ফেলছি।
সে আরেকজনের বিছানায় আছে এখন, এটি ভাবলেই মনে হচ্ছিলো কেউ আমার হৃদপিন্ডটা ধরে চিবিয়ে খাচ্ছে। কি যে কষ্ট হয়েছিলো সেদিন! কতটা যে কষ্ট হচ্ছিলো!! সেটা বোঝানোর মত কোন ভাষা পৃথিবীতে আসেনি কখনো।
প্রথম প্রেম ছিলো। সেজন্যেই হয়তো অমন হয়েছে। এই প্রেমটার পর থেকে আমি কোন মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারিনি। সম্পর্কে জড়াতে পারিনি বললে ভুল হবে, কোন মেয়েকেই আমি সেভাবে ফিল করতে পারিনি। ফলস্বরুপ সম্পর্কগুলো টেকেনি।
কারো উপড় আসলে খুব বেশীমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া ঠিক না। আপনি যখন অন্য কারো চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখবেন, তার হাত দিয়ে ভেজা কবুতর ছুয়ে দেখতে চাইবেন, আপনি পারবেন। এই সময়টুকু আপনার অসম্ভব ভালো কাটবে। মনে হবে সৃষ্টিকর্তা বুঝি জান্নাতের একটি ভাঙ্গা টুকরো আপনাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এতটা ভাল কাটবে যে , রাতের বেলায় সে আপনার সাথে কথা বলতে বলতে যখন ফোন না কেটে দিয়েই ঘুমিয়ে যাবে, সেটি টের পেয়েও আপনি ফোন কেটে দেবেন না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিশ্বাস যে নিচ্ছে সেটি শুনেও আপনি আরো ঘন্টাখানেক পার করে ফেলবেন।
নিজের ইচ্ছেতেই হোক,কিংবা প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার কারনেই হোক, কোন কারনে যখন মানুষটা হারিয়ে যাবে ,তখন সে নিজে হারানোর পাশাপাশি আপনার ভেতর থেকে আপনাকে নিয়ে যাবে। সেদিন আপনি ঝড়ের মত করে কাঁদবেন। পুরো দুনিয়াশুদ্ধ তখন ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হবে।তার ফোন নম্বরটা আর ছবিগুলো ডিলিট করতে গিয়ে মনে হবে কাটাচামচ দিয়ে নিজের হাত খুচিয়ে রক্তাক্ত করছেন। সে অন্য কারো বিছানায় আছে ভাবলেই মনে হবে এক সেকেন্ডের মধ্যে কেন মারা যাচ্ছিনা!! হৃদপিন্ডে কামড় বসার কষ্ট খুব ভয়াবহ!
পৃথিবীতে যারা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে ভালবেসেছে, এদের বেশীরভাগই বিজয়ী হতে পারেনি। তারা হেরে গিয়েছে। ঝড়ের মত করে কাঁদতে কাঁদতেই তাদের জীবন থেকে অনেকগুলো শীত বসন্ত বিয়োগ হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে পরিবার বন্ধুবান্ধবদের মধ্য থেকেও তাদের জীবন থেকে বিয়োগ হয়েছে । এক পর্যায়ে কোথাও আর থাকেনা কেউ...
চার্লি চ্যাপলিন ঠিকই বলেছিলেন, আপনি যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদবেন, সে কখনো তা দেখে হাসবে না। আপনার সাথে সাথে সেও কাঁদবে।
আমরা আসলে একাই আসি পৃথিবীতে। একাই থাকি। মাঝখানে যাদের সাথে আমাদের দেখা হয়, তারাও একা। কেউ বোঝে আর কেউ বুঝতে পারেনা।
যারা বুঝতে পারেনা, এরা মাথার চুল ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্যেই প্রতিবার আয়নার সামনে দাড়িয়েছে। কান্না করার সময় কখনো দাঁড়ায়নি...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫২