১. নাস্তিক: কোন গালি নয়
কাউকে নাস্তিক বললে সেটাকে 'গালি' হিসেবে নেবার প্রবণতাটা কমানো উচিৎ। নাস্তিকতা কোন গালি নয়, এটা একটা পক্ষ বা উপলব্ধি। ধর্মান্ধ গালিটা যেমন কুৎসিত ভাবমূর্তি দিতে পারে, নাস্তিক সেই উগ্রমূর্তি তৈরি করেনা বরং ক্ষেত্র বিশেষে সেটি ফ্যাশন। তাই নাস্তিক কোন গালি নয়, গায়ে মাখার দরকার নেই, শান্ত হোন।
২. ধর্মকে অন্যের কৃষ্টি-সংস্কৃতি হিসেবে দেখুন
ধর্মকে সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক করার মত গঠনমূলক প্রয়াসে নিয়োজিত হন। আপনি পহেলা বৈশাখে কেন মঙ্গলশোভা যাত্রা করেন সেটা বিজ্ঞান দিয়ে কেউ ব্যাখ্যা ও ব্যঙ্গ করার প্রয়োজন মনে করেনা, কারণ সেটা সংস্কৃতি। ধর্মকে সংস্কৃতি হিসেবেই দেখে শান্ত হোন। যার যার ধর্ম তার তার কাছে, ধর্ম যার যার দেশ সবার---এ জাতীয় উদার শ্লোগান গুলো মাথায় নিয়ে ঘুমাতে যান । আপনার কাছে পৌত্তলিকতা মূর্খতা মনে হতে পারে, কিন্তু কারো কাছে সেটা আত্মার খোরাক বা তুষ্টি। বিশ্বাসকে আঘাত করে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই-- যখন পৃথিবীতে ভাবার ও গবেষণা করার অনেক মহৎ ও গঠনমূলক বিভাগ আছে।
৩. বিজ্ঞানের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে ধর্মের উপর ঝাপিয়ে পড়ার দরকার নেই
গ্যালিলিওর যুগের মত ধর্ম এখন বিজ্ঞানের সাথে লড়তে যাচ্ছেনা। ধর্ম বিজ্ঞান ভিত্তিক হলে বড় বড় বিজ্ঞানী সবাই ধার্মিক হতেন । ধর্মকে বিশ্বাসের জায়গায় রেখেই তা বিজ্ঞানের সাথে সহ-অবস্থান করছে বিশ্বব্যাপী । এটাই বাস্তবতা। এই সহ-অবস্থান স্বীকার করতে শিখুন । স্বাভাবিকভাবে নিন । বিজ্ঞানের ধারালো অস্ত্র দিয়ে ধর্মকে কুপানোর দরকার নেই।
৪. উচ্চশিক্ষিত মুক্তমনাদের মুখে গালিটা ভাল শোনায়না
কেউ যদি বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মনীতি প্রমাণের চেষ্টা করে তাকে বিজ্ঞান দিয়েই জবাব দিন, গালি দিয়ে নয়। 'একটি রামছাগল' বলে গালি দিলে রেগে গেলেন, শান্ত হোন । পৃথিবীর সব মানুষ আপনার মত জ্ঞানী বুঝদার হলে আপনার পেটে ভাত জুটতোনা। বিশ্বাস ও বুদ্ধির বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতে শিখুন। রাম ছাগলেরা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম প্রমাণের ব্যবসা করলে সেটা আপনাদের কী কী আর্থিক, মানবিক ও সভ্যতার ক্ষতি করতে পারে সেটার তালিকা দিন এবং উপলব্ধি করুন। প্লিজ সাম্প্রদায়িকভাবে বলবেন না যে --ধর্ম বদলিয়ে কেউ মুসলিম হয়ে পড়াটাই সভ্যতার ক্ষতি এবং সেকারণেই আপনাদের বিদ্রোহ।
৫. যৌনতা ও রুচিবোধ দেশ-কাল-জাতি ভেদে ভিন্ন
সমকামিতা হয়তো আপনার কাছে খুবই নায্য, মানবিক বিষয়। নেপালের রাজা সহোদর বোনকে বিয়ে করেন । আপনি শুনে বিব্রত হতে পারেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার কিছু নেই ।আজ থেকে ১৪০০ বছর পর মানুষ হয়তো বলবে নিজের খালাত/মামাত/চাচাত বোনকে বিয়ে করা মানে নিজের বোনকেই বিয়ে করা, তাই ভীষণ ঘৃণিত ব্যাপার। এ যুগে ঘরে বউ রেখে মানুষের নিয়মিত পতিতালয়ে যাওয়াটা যেমন স্বাভাবিক ঘটনা, ৪ টা বিয়েও স্বাভাবিক ঘটনা। আপনি আধুনিক যুগে বাস করেন বলে, অন্যের ইচ্ছা, পছন্দকে 'মধ্যযুগীয়' বলে ঝাপিয়ে পড়তে পারেন না । ব্রিটেনে ৯ বছর বয়সী মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে আপনি পশ্চিমা সভ্যতার মুন্ডুপাত করেন না। কুমারী মাতা মেরি ১০ বছর বয়সে যীশুকে গর্ভধারণ করার কারণে সে যুগে কেউ তাকে কলঙ্কিত করেনি অল্প বয়সের জন্য।
৬. বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মের বিরুদ্ধাচারণকে বাধ্যতামূলক করবেন না । মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের বিপরীতে দাড় করাবেন না
সাম্রাজ্যবাদীদের মূল শক্তিই হলো বিজ্ঞান, ডিনামাইড, বোমা-বারুদের প্রযুক্তি দিয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের মেরে পিটিয়েই সভ্যতা কায়েম করা হয়েছে। বিজ্ঞানের শক্তিতেই তারা দেশ দখল করেছে, বোমা মেরেছে, শোষণ-নির্যাতন যা করার করেছে।ধর্মের নামে নয়। আপনি সম্মুখযুদ্ধে পেরে উঠছেন না দেখে ড্রোন দিয়ে মানুষ মারছেন, আরেকদিনে ড্রোন প্রযুক্তি দেখে বিস্ময়ে আবেগে অভিভূত হয়ে যাচ্ছেন। এটম বোমা দিয়ে মানুষ মারা হয় বলে কী এই বোমা উৎপাদন বন্ধ আছে? রাষ্ট্রীয়ভাবে বোমা বানানোর প্রয়োজনীয়তা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কী বাতিল হয়ে গেছে? বিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করছেন সেটাই মুখ্য। ধর্মকে সেভাবেই দেখুন । ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে বাহিরের শক্তি যদি দখল করতে চায়, শিব সেনারা কী ধর্মের নামে দেশ বাচাতে ঐক্যবদ্ধ হবেনা? যুদ্ধ করবেনা? নাকি দেশ প্রেম ইমানের অঙ্গ বলে ধর্মের দোহাই দিয়ে যুদ্ধ করাটা অনৈতিক এবং সেটার দায় ধর্মের উপরেই পড়ে? ঘরে বসে শান্তি প্রিয় হিন্দুরা যদি নমঃ নমঃ করে তারপরেও কী রাধা-কৃষ্ণকে আপনারা মুক্তি দিবেন না?
৭. বিজ্ঞানের নামে নাস্তিকতাকে একটি সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন না
মানবধর্ম তাহলে নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য মসী দিয়ে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে? যদি যুক্তি দেন যে শুধু ইসলাম নয়, মানবধর্মের নামে সব ধর্মকেই বাঁশানো হয়, তাহলে জেনে রাখবেন সেটাও সাম্প্রদায়িকতা । বিশ্বাস বিষয়ে যেকোন ধর্ম সম্প্রদায়কে টার্গেট করাই সাম্প্রদায়িকতা। মানুষের যৌনতা স্বাভাবিক-সুন্দর-শিল্পময় ব্যাপার আর হুজুরদের যৌনতা কুৎসিত-- এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সরলীকরণের ভিত্তি নাই। হুজুরদের যৌন কেলেঙ্কারি দেখলে ধর্মকে দু'ঘা দেয়া যাবে বলে লাফিয়ে খুশিতে বাগবাগুম হবার কিছু নাই । হুজুররাও আপনার মতই রক্ত-মাংসের মানুষ, তারাও অন্যায় করতে পারে, তারাও ধর্মের হিসেবে নরকে যেতে পারে ।
৮. ঘরে ঠাকুরের ছবি রেখে বা ঈদের নামায পড়ে এসে ধর্মকারি করবেন না
সামুর বিখ্যাত ব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথা কুরবানি দিতেন সামাজিকতা ও চক্ষুলজ্জার ভয়ে বা পরিবারের দাবিতে । একটা ধর্মীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে যদি আপনার নূন্যতম ওঠা বসা, মেলা-মেশা থাকে--সেটার বিরুদ্ধে অনলাইনে যুক্তির কথা বা গালির ভাষা দিয়ে হামলে পড়ার কোন উপকারিতে নেই । যদি ধর্মকারি আপনার পছন্দ হয়, প্লিজ কাউকে ঈদ মোবারক বা ম্যারি ক্রিসমাস বলার মত স্ববিরোধীতাতে যাবেন না। তফাতে থাকুন । আপনার বুড়ো বাবা-মা যে ধর্ম-কর্ম-হজ্জ্ব-পুজো করেন তাকে "মৌলবাদ ও কুসংস্কার" বলে ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কবিতা লিখে "জাহানারা ইমাম পুরষ্কার" নেবার ভিত্তি নেই। নিজের ঘর আগে ঠিক করুন ।
৯. নাস্তিকতার নামে বাড়াবাড়ির সমালোচনা করা মানে নাস্তিকের কল্লা চাওয়া নয়।
পৃথিবীটাকে বাইনারি করে দেখবেন না। কারো গালাগালি বা বাড়াবাড়ি অপছন্দ করা মানেই তাকে খুন করা সমর্থন করা নয়। আপনি হয় খুনীর সমর্থক না হয় খুন হওয়া মানুষটির সমর্থক--এ জাতীয় বিভাজন শুভ না। হত্যাকান্ডের নিন্দাকে গ্রহণযোগ্য করতে "আমি শার্লি হেবদো আমি ওমুক, আমি তমুক" বলাটাকে বাধ্যতামূলক করবেন না। দেশের বেশির ভাগ মানুষই মধ্যপন্থী, কোন কিছু নিয়েই তারা বাড়াবাড়ি পছন্দ করেনা সেটা মুক্তিযুদ্ধ হোক, ধর্ম হোক, বিজ্ঞানমনষ্কতার নামে নাস্তিকতা হোক । আপনি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, ২ টা পেটেন্ট আর দশটা বই আছে বলেই আপনার মন মানসিকতা ও শিষ্টাচার উন্নত হবে এটা আশা করবেননা। ডিগ্রি দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্ব যাচাই করবেন না।
১০. ধর্মের চিহ্ন বা উপস্থিতি দেখে ঘৃণা ছড়াবেন না
পশ্চিমা বিশ্বে মসজিদের পাশেই চার্চ, চার্চের পাশেই সিনাগগ। আপনি যদি পশ্চিমের বিজ্ঞান ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদের গুণমুগ্ধ হন, এই সহ-অবস্থানকে স্বীকার করুন। ঢাকায় বোরখার কাপড় গুণে সন্ত্রাসীদের এস্টিমেশন করবেন না। পাড়ায় সিদুর দেখে হিন্দু উপস্থিতি নিয়ে বিচলিত হবেন না। বই লিখুন, গবেষণা করুন, ইতিহাস পড়ুন, মুক্তমনে বিশ্লেষণ করুন । আপনার লেখা বিশ্বাসের ভাইরাস জাতীয় বই পড়ে কেউ দৌড়ে মারতে আসেনি, বা সেটি নিষিদ্ধ হয়নি। এ কে খন্দকারের বইয়ের মত আপনার লেখা বই কেউ পুড়াতে যায়নি। ভাববেন না সব ধর্মীক মুর্খ, শুধু আপনাররাই জ্ঞানী। সত্যিকারের জ্ঞানীরা তাদের জ্ঞান নিয়ে কখনও হুমায়ুন আজাদের মত উদ্ধত ও অহংকারী হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৮