১৯৪৭ এ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ না ভাগ হলে আমরা গর্বিত ভারতীয় থাকতাম । অখন্ড ভারতের বুক কেটে বাঙালিদের জন্য বাংলাদেশ নামক দেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন অবাস্তব, অসম্ভব, ও অগ্রহণযোগ্য থাকতো।
ইতিহাসের মারপ্যাচে যেহেতু বাংলাদেশের জন্ম হয়েই গেছে, সেই দেশটাকে কেমন দেখতে চান বা দাবি করেন সেটা নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে ভিন্ন মত থাকলেও 'ধর্ম নিরপেক্ষতা'র প্রশ্নে আপোষ নেই । ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ সবার । সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মভাব প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠায় লাগাম টেনে ধরাটা খুবই জরুরি । ৮০% সংখ্যা গুরু যদি তাদের স্বার্থ, অধিকার, দাবি ত্যাগ না করে তাহলে বাকি ২০% সংখ্যা লঘুর মন জয় করা যায়না । ফলে ধর্ম নিরপেক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়।
বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থ ধর্মরিপেক্ষ করতে হলে ভিন্ন ধর্ম মতের মানুষের অধিকার ও অসুবিধা গুলো বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন এবং এ লক্ষ্যে তথাকথিত ৯০ ভাগ মুসলিমদের ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে । এ লক্ষ্যে ১০ দফা দাবি গুলো দেয়া হলো।
প্রথম দফা: রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবেনা । যেমন ভারত রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নাই ( যদিও ভারতে বি জে পি ক্ষমতা, ধর্মীয় কারণে গরু বাণিজ্য নিষিদ্ধ ) । ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়নি, শুধু পাকিস্তানই ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে। ইসলাম ধর্ম গুরুদের শান্তি আধুনিকতা, ও সুফিবাদ শেখাতে হবে, ওহাবী মতবাদ নিষিদ্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয় দফা: রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মকে আলাদা বা বিশেষ বা বাড়তি পৃষ্ঠপোষকতা দিবেনা । ঢাকা শহর যদি মসজিদের শহর হয়ে ওঠে সেটা ভিন্ন ধর্মের জন্য প্রীতিকর নয় । জাতীয় ঈদগাহ বা জাতীয় মসজিদ বলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জাতীয় করণ চলবেনা । মাদ্রাসা বা মৌলবাদী অপততপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
তৃতীয় দফা কোন রাজনৈতিক দলের পোস্টার ব্যানারের উপরে 'আল্লাহ সর্ব শক্তিমান' বা বিসমিল্লাহ জাতীয় ধর্মবাণীর ব্যবহার চলবেনা । রাজনীতিতে কোন ধর্মের ব্যবহার, চিহ্ন থাকবেনা। তবে বিশেষ ধর্ম গোষ্ঠীকে একটা রাজনৈতিক দলের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
চতুর্থ দফা: শুক্রবার নয়, সারা পৃথিবীর সাথে মিল রেখে সাপ্তাহিক ছুটি হবে রবিবার । প্রকাশ্যে মাইকে ওয়াজ বা ধর্ম প্রচার করে জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করা যাবেনা । ওয়াজের নামে সাম্প্রদায়িক ধর্ম প্রচার করা যাবেনা। রমজান মাসে রেস্তোরা ঢেকে রাখা যাবেনা । রমজান মাসে প্রকাশ্যে খাওয়া দাওয়ার মত মৌলিক অধিকারে কেউ বাধা দিতে পারবেনা।
পঞ্চম দফা: প্রকাশ্যে গরু জবাই এর মত অসুস্থ সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করতে হবে । কুরবানির নামে প্রকাশ্যে প্রাণী হত্যার প্রদর্শনী করা যাবেনা । রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে গোপন কসাই খানা গঠনের । রেস্তোরাতে গরুর মাংসের বিক্রয় ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে ভিন্ন ধর্মালম্বীগণ আহত না হন । সেক্যুলার ভারত সরকার ধর্মের নামে গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করে মানুষের ধর্মানুভূতির ব্যাপারে যত্নশীল হয়েছেন । বাংলাদেশ সরকারকেও সে ব্যাপারে সহায়ক হতে হবে ।
ষষ্ঠ দফা: মদ এবং বারের ব্যবসাকে বৈধতা দিতে হবে । একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কখনও ধর্মের অজুহাতে মদ পানের মত বৈশ্বিক, স্বাভাবিক নাগরিক অধিকারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও হস্তক্ষেপ করতে পারেনা । মদ পান ও বিক্রয়কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে পারেনা ।
সপ্তম দফা: ধর্মের মত মধ্যযুগীয় ও পৌরাণিক বিষয়াদি নিয়ে সমালোচনা, সাহিত্য ও শিল্পের প্রসার করতে দিতে হবে । যখনই ধর্ম বিজ্ঞান ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে দাড়াবে তখনই ধর্ম ও কুসংস্কারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রসারের বিরুদ্ধে কোনভাবেই যাতে মৌলবাদীরা মাথা ডাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
অষ্টম দফা: সরকারি-বেসরকারি চাকুরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ও নাগরিক সুবিধাতে ২০% বাধ্যতামূলক সংখ্যালঘু কোটা করতে হবে ।
ভারতের প্রেসিডেন্ট মুসলিম হতে পারে, বাংলাদেশে ভিন্নধর্মালম্বীদের চাকুরি অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত করা হবে? পুলিশ, আইন, বিচার প্রশাসন, মন্ত্রাণালয়, সচিবালয় সব জায়গায় যোগ্যতার বাইরে সংখ্যালঘু কোটা থাকতে হবে।
নবম দফা: ভিন্নধর্মালম্বীদের ধর্মান্তরিত করা যাবেনা । বিয়ে, প্রেম, চাকুরি বিবিধ প্রলোভনে, নির্যাতনের হুমকি বা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মান্তরিত করা যাবেনা । রাষ্ট্রকে এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।
দশম দফা সংখ্যালঘুদের ২৪ ঘন্টা পুলিশি সুরক্ষা দিতে হবে। খুন-ধর্ষণ-জমি দখল-লুঠপাট প্রভৃতি ঘটনায় সংখ্যালঘুদের বিশেষ আইনি সুবিধা ও নাগরিক অগ্রধিকার দিতে হবে, যাতে করে ধর্মকে পুজি করে সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ভারত বা বিদেশে পালিয়ে গিয়ে যাতে দেশের কলঙ্ক না হয় সেদিকে রাষ্ট্রের দৃষ্টি রাখতে হবে।
সর্বোপরি এই দশ দফা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনারই পরিপূরক ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১২