somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কানের দুল ( গল্প )

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তিনতলার বিল্ডিং হবে এখানে। কাজ চলছে। পুরুষ শ্রমিক মহিলা শ্রমিক মিলেমিশে কাজ করছে। বেশির ভাগই পুরুষ শ্রমিক। মহিলা শ্রমিক দুইজন। তাদের একজন ময়না খাতুন। শাড়ীর উপর একটা পুরানো শার্ট পড়া। যেটা অনেকটুকু লম্বা। শার্টে অনেক ময়লা। রঙ বুঝা যায় না। ইট টানছে। বড় রাস্তায় সারি করে ইট রাখা। এদিকে রাস্তা ছোট। গাড়ি ঢুকতে পারে না। তাই বড় রাস্তা থেকে মাথায় করে ইট এনে তা রাখতে হচ্ছে।

প্রতিবার মাথায় করে আটটা করে ইট আনছে। যদিও ইট ধরতে গিয়ে হাত ছেঁচে গেছে। ডান হাতের দুইটা আঙ্গুলের কিছু চামড়া খসে পড়েছে। রক্ত বের হচ্ছে। প্রচন্ড জ্বলা। কিন্তু সেদিকে দেখার সময় নেই। কন্ট্রাক্টর লোকটা গেটে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাজে ফাঁকি দিতে দেখলে টাকা দেওয়ার সময় কম দেয়। মাঝে মাঝে বকেয়া রেখে দেয়। সে ভয়ে হাতের আঙ্গুলের দিকে তাকায় না ময়না খাতুন। টানতে থাকে ইট। মাথা ব্যথা করে। মাঝে মাঝে পুরা পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে মনে হয়। সেদিকেও নজর দেয় না।

মহিলা শ্রমিক বিধায় কিছু টাকা কম পায় পুরুষ শ্রমিকের তুলনায়। তারপরও তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বলার কিছু নাই। অনেকে মহিলা শ্রমিক নেই ই না কাজে। তা ভাল এখানে নিয়েছে। কাজের অভাবে যখন বসে থাকতে হয় তখন অনেক কষ্টের।

স্বামী চলে গেছে তিন বছর হচ্ছে। অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে তার সাথে সংসার করছে। ভ্যান গাড়ি ছিল। আয় রোজগার খারাপ ছিল না। দুই মেয়ে নিয়ে এক রকম চলেই যেত। কিন্তু স্বামী একা গেছে। মেয়েদের ভার রেখে গেছে সম্পূর্ণটাই ময়না খাতুনের উপর। মা হয়ে মেয়েদের কষ্ট সহ্য করা কষ্টকর। তারপরও সহ্য করতে হয়। মেয়েদের জন্য লেবারি কাজ নেওয়া। অনেকে পরামর্শ দিয়েছিল নতুন একটা স্বামী নেওয়ার। কিন্তু তাহলে এই দুই মেয়ে যাবে কোথায়?

মাথায় কাপড়ের গোছা একটা। তার উপর একটা কাঠের টুকরা। এক একটা ইট নিয়ে মাথার উপর ভাঁজ করে রাখে। তারপর সেগুলো নিয়ে চলে। ময়না খাতুনের চিন্তা অন্যদিকে। এক সপ্তাহ পরেই ঈদ। ঈদে সবাই নতুন জামা কাপড় নিচ্ছে। কিন্তু মেয়েগুলোর জন্য নেওয়া হয় নাই এখনো। নেবে কেমনে। হাতে টাকা নেই। কোথা থেকে যে কিনবে মাথায় ঢুকে না। ইটের চেয়ে অনেক অনেক ভারী বেশি মনে হয় চিন্তাগুলোকে। আশেপাশে সবাই নেবে। মেয়েগুলো নিতে না পারলে অনেক মন খারাপ করবে। যেভাবে হোক ওদের জামা নিয়ে দিতে হবে।

মজুরী যা পায় তাতে চাল ডাল আর আলু কিনতে শেষ হয়ে যায়। চালের দামও অনেক বেশি এখন। আগে কম ছিল। আস্তে আস্তে সবকিছু গরীবের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। একসময় হয়ত জীবনটাও নাগালের বাহিরে চলে যাবে গরীবের জন্য। শুধু বড়লোকদের জন্য এই পৃথিবী হয়ে যাবে।

বাসায় এসে দেখে কুপি ধরিয়ে বড় মেয়েটা স্কুলের পড়া পড়ছে। স্কুল বন্ধ। তারপরও পড়ে। ওর স্বপ্ন অনেক বড়। বড় হলে ডাক্তার হবে। ময়না খাতুন জানে ডাক্তার হতে হলে অনেক টাকা লাগে। অনেক দূর পড়তে হয়। কিন্তু গরীবের ঘরে যে সন্তান সে বেশি সময় পাই না। শরীর একটু বেড়ে গেলেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। তবে মেয়েকে নিরাশ করে না। বলেন, ঠিক আছে। ডাক্তার হতে হলে ভালভাবে পড়তে হয়। তুই ভালভাবে পড়।

মা আসছে দেখে খুশী হয়ে যায় লুনা।
ময়না দেখেন ছোট মেয়ে ঝর্ণা পালংয়ে ঘুম যাচ্ছে। কিরে, রাতে ভাত না খাইয়া ঝর্ণা যে শুইয়া পড়লো?

-মা, ঝর্ণা এখন জ্বালায় বেশি। দুপুরে আইসক্রমীমঅলা দেখে ও বায়না ধরে আইসক্রীম খাবে বলে। কান্না শুরু করে দেয়। পরে গল্প বলায় শান্ত হয়ছে।

ময়না চুলা জ্বালান। লুনা চাল ধুয়ে আনে। তা চুলায় চড়ানো হয়। রাতে ঝর্ণাকে তোলা হয়। তিনজন মিলে ভাত খেয়ে নেয় আলু ভর্তা দিয়ে।

রাতে দুই মেয়ে পাশে ঘুম যায়। ময়না মধ্যখানে। দুই মেয়ে দুই পাশে। ওরা ঘুমালেও ময়না খাতুনের চোখে ঘুম নেই। মেয়ে দুইটিকে ঈদের কাপড় নিয়ে দিতে হবে। টাকা পাবে কোথা থেকে। ঘুমানোর আগে ছোট মেয়ে বলছে ওর জন্য লাল জামা লাগবে।

কারো কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতেও লজ্জা লাগে। কি করা যায় ভেবে পায় না ময়না খাতুন।

কানের দুল আছে। গরীবের মেয়েকে এখন আর স্বর্ণ দেওয়া হয় না। স্বর্ণ নাগালের বাহিরে চলে গেছে। ইমিটেশন দিয়ে বিয়ে হয়েছে। তবে মায়ের কানের দুল ছিল। বিয়ের দিন হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এই জোড়া যত্নে রাখিস।

হঠাৎ কানের দুল একটা কোথায় যেন পড়ে যায়। বাকী একটা এম্নে পড়ে আছে। আরেকটা বানানো অসম্ভব। অনেক টাকার ব্যাপার।

কষ্ট পেতে পেতে কষ্ট সয়ে গেছে ময়না খাতুনের। কষ্টে এখন আর খারাপ লাগে না বেশি। তবে যেদিন একটা কানের দুল হারিয়ে যায় সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন। এখন বাকী একটা মায়ের যে স্মৃতি আছে সেটাও বিক্রী করে দিতে হবে। খারাপ লাগে। কিন্তু মেয়েগুলোর মুখে তো হাসি ফুটবে।

পরের দিন বিক্রী করেন কানের দুলটা। স্বর্ণকার কি হিসেব করে কে জানে। সাড়ে তিনশ টাকা দেয়। আরেকটু বেশি দাম দিতে বললে বিরক্ত হয় স্বর্ণকার। এই দামে দিলে দাও, না দিলে চলে যাও।

মেনে নেয় ময়না। রাতে লুনা আর ঝর্ণাকে কিনে দেয় নতুন জামা। দুজনই অনেক খুশী।

ঈদের আগের দিন ঘর সব কিছু একেবারে নতুন ভাবে পরিষ্কার করছে লুনা আর ঝর্ণা। ঘরে তেমন কিছু নেই। যেগুলো আছে সেগুলোই পরিষ্কার করছে। দুই বোনের মনে ঈদের উত্তেজনা। বেড়ার পুরানো কাগজগুলো ফেলে দিয়ে নতুন কাগজ লাগানোয় ব্যস্ত দুই বোন।

পালংয়ের নিচে যা জমছিল সব বের করে আবার সাজিয়ে রাখে। অল্প কিছু কাঁচের জিনিষ আছে। সেগুলো ভাল ভাবে ধুয়ে সাজিয়ে রাখছে।

হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে লুনা। পালংয়ে কোণায় পড়ে আছে মায়ের কানের দুল একটা। তখন এত খোঁজা হয়েছে অথচ পাওয়া গেল না। এখন কোথা থেকে এলো। মা এই দুলের জন্য অনেক মন খারাপ করেছিল। এখন মা অনেক খুশী হবে।

মায়ের হাতে দেয় দুলটি। ময়না খাতুন আশ্চর্য হন।
-মা তোমার কান খালি দেখতে খারাপ লাগে। দুলগুলো পড়লে তোমারে অনেক ভাল দেখায়। দুল পাওয়া গেছে ভাল সময়ে। কাল ঈদে তুমি দুল গুলো আবার পড়বা। ঐ দুলটার সাথে এটা এখন রাইখ্যা দাও।

ময়না খাতুন কথা বলে না। মেয়ে তো জানে না যে বাকী দুলটি বিক্রী করে দেওয়া হয়েছে।

দুলটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে ময়না। হালকা ময়লা জমেছে দুলে।

লুনা বুঝতে পারে না মা খুশী না হয়ে এভাবে চুপ হয়ে গেছেন কেন।
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×