রয়েল লন্ডন হসপিটালে আমার স্ত্রী যখন তীব্র প্রসব বেদনায় চিৎকার করছিলো আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম । সাথে আরো দুইজন মিডওয়াইফ বা ধাত্রী ছিল । ওরাও হাসি ঠাট্টা করছিলো। একজন নারীর প্রসব বেদনা কতটা প্রখর তা নিজে না দেখলে বুজতাম না । এই যন্ত্রনা সহ্য করার মতো না । আমার স্ত্রী বারবার চিৎকার করে বলছিলো ইনজেকশন বা পেইন কিলার দিতে । কিন্তু আমাদের দুজনের কথা সেখানে ছিল অচল । স্বাভাবিক এই যন্ত্রনা ভোগের পর একজন মা তার সন্তান এর জন্ম দেয় । এটাই প্রাকিতিক নিয়ম । এই সময় সব স্ত্রী তাদের স্বামীদের অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে এটাও খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । এই অতি স্বাভাবিক নিয়মটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে খুবই অস্বাভাবিক । কয়েক ঘন্টার প্রসব বেদনা যেতে না যেতেই সি-সেকশন বা সিজার করে সন্তান বের করে আনা হয় । দেশের কতজন চিকিৎসকে এই সিজার বা অপারেশন কতটা অস্বাভাবিক তা কি রোগীর কাছে ব্যাখ্যা করেন ? মনে হয় না খুব বেশি বরং এই পদ্দ্বতিতে প্রসবকে রীতিমতো সহজলভ্য সামগ্রী করে দিয়েছেন আমাদের চিকিৎসাবিদরা ।
আমার মেয়ের বয়স যখন ৪ মাস তখন আমরা দেশে চলে আসি। এরপর দেশের ডাক্তারের কাছেই সব রকম চিকিৎসা পরামর্শ নেয়া হতো । খুবই আশ্চর্জজনক ভাবে আমার মেয়ের নাড়ি শুখাচ্ছিলো না । স্বাভাবিক ভাবে যেটা শুকিয়ে ঝরে পরে যাবার কথা তা না শুখিয়ে বেশ বড় আকার ধারণ করে । এবং আমরাও বেশ স্বাভাবিক ভাবে শহরের সবচেয়ে বড় শিশু বিশেষজ্ঞ ও মেডিকেল কলেজ এর বিভাগীয় প্রধান এর কাছে মেয়েকে নিয়ে গেলাম । দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষার পর এই ডাক্তার সাহেবান অতি দ্রুত নাড়ি কেটে ফেলার তাগিদ দিলেন । বললেন নাড়ি কাটা ঠিক হয় নাই তাই এমন হচ্ছে । একটা অপারেশন এর মাধ্যমে নাড়ির বাড়তি অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে । আমি ঠিক বুজতে পারছিলাম না উনি কি বলছিলেন । কারণ আমার মেয়ের নাড়ি আমি নিজেই কেটেছি । আর বাড়তি বা অল্প এই সব এমনিতেই তো শুখিয়ে যাবার কথা । যাই হোক মা মেয়ে দাদি নানী সবার মাঝে কান্নার রোল । মাত্র ছয় মাসের একটা বাচ্চাকে অপারেশন । ভাবাই যায় না ।
মেয়ের জন্মের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আমি কন্যা দায় গ্রস্থ পিতায় পরিণত হলাম । কি করবো বুজতে না পারলেও একটা চরম কুসংস্কার করে বসলাম । মেয়ের নাড়ির উপর একটা ধাতব পয়সা দিয়ে সব সময় চেপে রাখতাম । মাস খানেকের মধ্যে আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল । এখন ওর বয়স ছয় বছর । আমার কুসংস্কার করার পেছনে অতীব পার্থিব যে কারণ তা হচ্ছে আমি মনে প্রাণে স্বাভাবিক আচরণ বিশ্বাস করি । যদি রয়েল লন্ডন হসপিটালে বেশির ভাগ ডেলিভারি খুব স্বাভাবিক নিয়মে হতে পারে ধাত্রীর হাতে তবে মাঝে মধ্যে মা খালার টোটকা ডাক্তারি মেনে নেয়া যেতেই পারে ।
এই ধরণের নানান ঘটনায় আমি আর আমার স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেই আমরা খুব সহজে ডাক্তারের দেয়া ওষুধ হড়হড় করে খেয়ে ফেলবো না । আমরা যে জিনিসটি করি এখনো তা হলো একই সাথে কয়েকটা ডাক্তারের কাছে পরামর্শের জন্য যাই যে কোন ব্যাপারে । এরপর সব ডাক্তারের পরামর্শ গুলো টালি করে গুগল করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেই । এক্ষেত্রে আমাদের সবসময় যে খুব বেশি রোগ বিরাজ লেগে ছিল তা কিন্তু না , বলতে পারেন আমরা প্রায় সুস্থ জীবন যাপন করছি ।
একজন ডাক্তার তার চেম্বারে সর্বোচ্চ রোগী দেখেন ২০ মিনিট আর এই ২০ মিনিটে রোগীর ২০ বছরের সমস্যা ডায়াগনসিস প্রায় অসম্ভব । প্রতিটা মানুষ আলাদা । আলাদা তাদের শারীরিক গঠন । আপনার শরীরে যে ওষুধ কাজ করবে আমার নাও করতে পারে । প্রচন্ড নেশা করে এমন একজন মানুষকে এনেস্থেসিয়া দিতে আমার আপনার চেয়ে একটু বেশি মাত্রার ইনজেকশন লাগতে পারে । নাহলে হয়তো অপারেশন এর মাঝখানে উনি উঠে বসে যেতে পারেন । কিন্তু ইমার্জেন্সিতে কতজন ডাক্তার রোগীর এই রকম ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন আমার জানা নেই । আর অপারেশন থিয়েটারে কত জন রোগী মাঝপথে উঠে বসে তাও একমাত্র ডাক্তাররাই বলতে পারেন ।
আমাদের দেশের রোগীদের মেডিকেল হিস্টোরি বলে কিছু নেই । যখন যে ডাক্তারের কাছে যাবেন উনি আবার প্রথম থেকে সব শুরু করবেন । একত্রে আপনার বয়স যত বেশি হবে আপনার জন্য তত সমস্যা হবে নিজের হিস্টোরি বলতে । আর ঠিক কতজন ডাক্তার রোগীর মেডিকেল হিস্টোরি জানতে চান তাও ভাববার ব্যাপার । দেশ ডিজিটালি এতো এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের সবার জন্য সামান্য একটা মেডিকেল হিস্টোরি বানানোর ক্ষমতা কারো নেই । অথচ এটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার । চাইলে আমি আপনি নিজে নিজেদের মেডিকেল হিস্টোরি সবসময় আপডেট করে রাখতে পারি । আপনার হাতের ছোট মোবাইল এর একটা আপসেই এইসব জমা রাখা যায় । ডাক্তার দেখতে না চাইলেও দেখান । কারণ অসুখ আপনার আর আপনার ডাক্তারের পক্ষে ২০ মিনিটে আপনাকে বোঝা আসলেই কঠিন ব্যাপার ।
আমার বৃদ্ধ পিতাকে নিয়ে আমরা নগরীর প্রখ্যাত এক ক্লিনিকে যাই । উনি যে কদিন ওখানে ছিলেন প্রায় প্রতিদিন রাতেই রোগীর স্বজনদের সাথে ক্লিনিক কতৃপক্ষের হাতাহাতি হতো । দুচার দিন পর আমি অনেকটা যুদ্ধ করে উনাকে আ . সি . ইউ . থেকে বাসায় নিয়ে আসি । এর জন্য আমাকে পরিবারের পক্ষ থেকে রীতিমতো দোষারোপ করা হচ্ছিলো। কেও বলছিলো টাকা বাঁচাবার জন্য কেও বলছিলো সময় বাঁচাবার জন্য আমি এ কাজ করেছি। কিন্তু আমি আমার বাবাকে বাঁচাবার জন্য সেদিন ওই ক্লিনিক থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম । বাবার রুম টাকে ক্লিনিকের মতো করে সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলাম । অক্সিজেন ক্লিনিক বেড সহ প্রায় সব কিছু । আর ডাক্তার ছিলাম আমি আর আমার বড় ভাই । দুজনে মিলে পালা করে বাবার পাশে বসে সেবা করতাম । দীর্ঘ প্রায় এক বছর শয্যাশায়ী থাকার পর বাবা আমার কোলে মারা যান ।
এটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আপনার কাছে । অথচ একবার ভাবুন এমনটাই কিন্তু হবার কথা ছিল । একজন ডাক্তার বা চিকিৎসক সর্বোচ্চ কি করতে পারেন আপনার জন্য ? তাহলে এতটা আশা কেন করেন একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে ? আমার আপনার চাহিদাই উনাদের আজকে এই রকম ব্যাবসায়িক প্রেসক্রিপশন লিখতে বাধ্য করছে ।
আমাদের মাঝে অনেকে আছেন যারা পীর বা হুজুরের ফু দেয়া পানি খান । একবার ভাবুন আপনি একগ্লাস পানি নিয়ে গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে আর ডাক্তার সাহেবকে বললেন ফু দিয়ে দিতে । উনি কি করবেন ? ভাবতেই যেন কেমন লাগছে । কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই মুহূর্তে যদি আপনি এক গ্লাস পানি নিয়ে কোন ডাক্তারের চেম্বারে যান উনি নির্ঘাত একটা লম্বা ফু দিয়ে দিবেন । হয়তো আপনি এই ফু তে উপকার পেতেও পারেন । সরকার ওষুধ ব্যাবসায়ী আর চিকৎসদের এই রকম অদ্ভুত আচরণকে কি কুসংস্কার বলা যায় না ? সরকার ভাবছে বড় হরফে ওষুধের নাম লিখলে রোগীর সুবিধা কিন্তু আমি বা আপনি ওষুধের নাম দিয়ে কি করবো ? পাড়ার মোড়ের ওষুধের দোকানদার পড়তে পারলেই তো হলো । এই অবস্থা চলতে থাকলে খুব শীগ্রই হয়তো ওষুধ প্রস্তূত কারকরা ওষুধের নাম আই ফোন স্যামসাং এই ধরণের রাখবেন । কারণ চিকিৎসকের পক্ষে জেনেরিক নাম ছাড়া ওষুধের প্রকৃত নাম মনে রাখা প্রায় অসম্ভব ।
যে চিকিৎসকদের উপর সাধারণ মানুষের এমনিতেই বিশ্বাস কম সেখানে সরকারের নতুন এই নিয়ম আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কি কাজে আসবে আমার জানা নেই । তাই বলছি আসুন সবাই মিলে চিকিৎসকদের কাছে পানি ফু নিতে যাই । অন্তত যতদিন না তারা সঠিক ভাবে ওষুধের নাম মুখস্ত করতে না পারেন । কারণ এই মুহূর্তে একজন রোগী হিসেবে আপনি মারাত্মক ঝুঁকির মাঝে বসবাস করছেন ।
https://www.facebook.com/asraful.alam
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:২৪