আমার স্ত্রী আর আমার কর্ম জীবন কাল প্রায় একই সময় । আমার স্ত্রীর কর্মস্থল ছিল একটি ব্যাংক আর আমি ছিলাম টেলিকমের সেলসম্যান । অসাধারণ এক কর্ম প্রাপ্তি ছিল আমার । মাইনে বেশ মোটা । কিন্তু দেখতে দেখতে আমার স্ত্রীর মাইনে আমাকে ছাড়িয়ে যেতে বছর খানেকও লাগলো না । ব্যাপারটা এতো সহজ কিছু না । অন্তত সামাজিক ভাবে । ভাগ্য ভালো বিধায় এই যাত্রা মান রক্ষা হলো । না হলে এতদিনে আমি হয়তো আমার স্ত্রীর ব্যাংকে সেলসম্যানের কাজ করতাম । দেশে ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় কয়েক ডজন । অথচ লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে হাতে গোনা চার পাঁচটি ব্যাংক । ঠিক কিভাবে আমাদের দেশে এতো ব্যাংক আমার জানা নেই । তবে আর যাই হোক অনেকের কর্মপ্রাপ্তি বেশ ভালো বিধায় কেও হয়তো এই পর্যন্ত ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করেননি ।
ব্যাংক গুলু নিয়ে তুলকালাম চলছে দেশে । একের পর এক ব্যাংক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে । যে দেশের ব্যাংক গুলুর সাথে বাইরের কোন দেশের ব্যাংকের সরাসরি লেনদেন নেই তারা কিভাবে সমস্যায় পরে তা একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে পারবে । এমনিতেই বিশ্বের প্রায় সব দেশের ব্যাংকিং অবস্থা প্রায় একই রকম । আমেরিকাতে প্রায় প্রতি দশ বছরে অন্তত একবার রিসেশন হবে । বন্ধ হবে ব্যাংক বীমা । অতঃপর সরকার হস্তক্ষেপ করে সব সমস্যা সমাধান করে দিবে । সোজা কথা যে টাকা ব্যাংক ক্ষতি করে তা সরকার প্রিন্ট করে আবার ব্যাংকে দিয়ে দেয় । মোটামুটি এটাই বিশ্ব ব্যাপী ব্যাংকের কন্সপিরেসি ইকোনোমিক্স ।
আমাদের দেশেও হয়তো তাই হবে । সরকার একসময় অনেক টাকা প্রিন্ট করে ব্যাংকগুলোর ভল্টে ঢুকিয়ে দিবে । টাকা প্রিন্ট করতে তো আর সমস্যা নেই । যারা মোটামুটি জ্ঞানী তারা এতক্ষনে বলে বসতে পারেন "রাবিশ" । আদতে নিজের চোখে দেখা তো আর অবিশ্বাস করা যায় না ? ২০১০ এর দিকে ব্রিটেনে ঠিক একই সমস্যা হয় । ব্যাংক গুলু সব লিকুইডিটি সমস্যায় জর্জরিত । হটাৎ একদিন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রউওন রাতের বেলা পাউন্ড প্রিন্ট করে ভরে দিলেন ব্যাংক গুলুর এ টি এম এ । এরপর উনি অবশ্য বলেছিলেন ওই রাতে যদি ব্যাংক গুলুকে টাকা দেয়া না হতো পরের দিন লন্ডনের কোনো এ টি এম এ টাকা থাকতো না । সমস্যা সমাধান ।
এক্ষেত্রে কোনো মুদ্রানীতি কাজ করে না । কারণ স্বর্ণের রিজার্ভের উপর টাকা পয়সার দিন এখন আর নেই । যে কোনো দেশের সরকার যখন খুশি তখন যত খুশি টাকা প্রিন্ট করতে পারে । এটাই ছিল ডিপ রিসেশন থেকে বের হবার একমাত্র উপায় । যদি তাই হয় তাহলে আমাদের সরকার চাইলেই বেশ কিছু টাকা প্রিন্ট দিয়ে ব্যাংক গুলুকে দিয়ে দিলেই হয় । কিন্তু সারা দিন বসে যদি টাকা কোথায় গেলো তা নিয়ে টক শো করা হয় তাতে কি টাকা ফেরত আসবে ? কোনো দেশেই আসে না । আমাদেরও আসবে না । অতঃপর সরকার
রক্ষা করবে ব্যাংক গুলোকে ।
গেলো সপ্তাহে ডলারের দাম বেড়ে প্রায় ৮৩ টাকা । আমার অনেক কলিগ নিউ ইয়র্ক থেকে সমানে দেশে টাকা পাঠাতে থাকলো । এই রকম রেট সব সময় পাওয়া যায় না । তবে আমরা জানতাম ঠিক কি কারণে ডলারের দাম বাড়তি ছিল । কারণ সরকার দেশি টাকা প্রিন্ট করতে পারলেও ডলার প্রিন্ট করতে পারে না । যদিও জিম্বাবুয়ে একসময় এই কাজটিও করেছিল । সমানে ডলার প্রিন্ট করলো দেশটি । সুতরাং সরকারকে যখন ডলার এ পেমেন্ট করতে হয় পদ্যা সেতুর বিদেশী কারিগরদের তখন ডলারের দাম একটু বাড়িয়ে আমাদের ডলার গুলু রিসার্ভ করে । খুবই সরল সমীকরণ ।
তাহলে কথা দাঁড়ালো যত খুশি অনাদায়ী ঋণ থাকুক না কেন ব্যাংক গুলো একসময় ঠিকই টাকা ফেরত পাবে । সরকার তো আছেই । তাহলে কিছু লোক ব্যাংক এর টাকা মেরে দিয়ে ভুঁইফোড় হয়ে গেলো ? হলই বা । তাতে আমাদের সমস্যা কি ? আমাদের আমানত এর খেয়ানত তো হয় নাই ।
ব্যাংক এর এই সব নিয়ে এতো কানাঘুষা হতো না যদি দেশে একটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক মনিটর করতো। এখন অর্থ মন্ত্রণলায় আর বাংলাদেশ ব্যাংক এই দুই প্রতিষ্ঠান একসাথে একটি ব্যাংককে মনিটর করছে । সমস্যা এই জায়গায় । কারণ এখানে একজন জানে ব্যাংক এর এই কন্সপিরেসি ব্যাংকিং থিওরি আর একজন জানলেও মানতে চায় না । অতঃপর সমাধান টিভি চ্যানেল এর টক্ শোতে । আর আমাদের মতন যারা সামান্য গাড়ির ইনস্টলমেন্ট টানতে হিমশিম খাচ্ছি তারা কোন ভাবেই মানতে চাচ্ছি না এই রকম হরিলুট । হরি থাকলে লুট হবেই । সবার ভাগ্যে ঋণ খেলাপি পদবি জুটে না ।
আমাদের সমস্যা আমরা ভুল করে কটলার পড়ে ফেলেছি । কিন্তু সরকার বা মন্ত্রনালয় অথবা ব্যাংকের মালিকরা কটলার চিনেন না । তাই তারা খুব সহজে টাকা প্রিন্ট করার কথা ভাবতে পারে । আর বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্মকর্তরা যেহেতু কটলার মানেন তাই ভাবতে একটু কষ্ট হয় । যে কোন অর্থনীতিবিদের সাথে এই নিয়ে কথা বলবেন দেখবেন ঘন্টা খানেক সমষ্টিক অর্থনীতি কপচিয়ে শেষমেশ ব্যাংকের এই কন্সপিরেসি ইকোনোমিক্স মেনে নিবেন । আর আমরা যাদের স্ত্রী ব্যাংক এ কর্মরত তাদের ব্যাংক নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করতে হয় । কারণ টাকা পয়সা গেলে ফেরত পাবার সুযোগ থাকে । কিন্তু মান সন্মান গেলে সমস্যা । সরকার তো আর মান সন্মান প্রিন্ট দিতে পারবে না ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:১১