somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের মুক্তিযুদ্ধঃ বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা।।

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ত্রিপুরার ভৌগলিক অবস্থান অদ্ভুতভাবে গাঁথা বাংলাদেশের সাথে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৫ টি রাজ্যের সীমানা রয়েছে। অন্যান্য রাজ্যের যেখানে এক দিক থেকে সীমানা রয়েছে, সেখানে তিন দিকের বেশী দিক থেকে ত্রিপুরাকে আলিঙ্গন করে রয়েছে বাংলাদেশ। ত্রিপুরা রাজ্যের ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের ৮৩৯ কিলোমিটারই বাংলাদেশের সাথে। ত্রিপুরা ভারতের ৩য় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। এ রাজ্যের রাজধানী আগরতলা


১৯৪৭ সালে দেশ তথা বাংলা ভাগ করা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, যা একজন বাঙ্গালী হিসেবে কখনোই আমাকে সুখের অনুভূতি দেয়না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যে একটা ভূল সিদ্ধান্ত তার এক জ্বলন্ত প্রমান তো বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মানুষ। ৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকদের অত্যাচারে সহায় সম্বলহীনভাবে যখন আমাদের দেশের মানুষ ত্রিপুরা গেল নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে, তখন ত্রিপুরাবাসী আমাদের বুকে টেনে নিয়েছিল। হিন্দু মুসলমান প্রশ্ন তো তখন গৌণ ছিল। কই তখন তো কেউ কাউকে হিন্দু মুসলিম বলে দূরে সরিয়ে দেয়নি?

আমরা বাঙ্গালী এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের ত্রিপুরাবাসী যে পরিমান সাহায্য করেছে অতিথেয়তা দিয়েছে তা একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার পক্ষে কখনো অস্বীকার করা সম্ভব নয়। মুক্তিযিদ্ধের সময় বাংলাদেশ কে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, এবং ভৌগলিক কারনে ১ থেকে ৪ নম্বর সেক্টর ছিল ত্রিপুরা ঘেষা।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার (বর্তমানে মুজিবনগর) আম্রকাননে স্বাধীন বাংলার প্রথম অস্থায়ী সরকার যে শপথ গ্রহন করে তার সিদ্ধান্ত আগরতলা থেকে নেওয়া হয়। এবং সেটা ১২ এপ্রিল নেওয়া হয়েছিল। ১২ এপ্রিল আগরতলার সার্কিট হাউজে আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এক গোপন বৈঠক হয়। সেখানেই স্বাধীন বাংলা সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগরতলায় স্বাধীন বাংলা সরকারের সংবাদটি সমস্ত ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে প্রচারিত হয়। ১৩ই এপ্রিল ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ এ হেডলাইন ছিল এই রকম “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত, তাজউদ্দীন আহমেদের প্রধানমন্ত্রীত্বে স্বাধীন বাংলার মন্ত্রীসভা”।

মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর ছিল কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড তবুও সাংবাদিকরা আগরতলা প্রচুর ভিড় করতেন কারন ভৌগলিক কারনে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশে কি হচ্ছে তার খবরাখবর একমাত্র আগরতলা থেকেই যত সহজে পাওয়া যেত ভারতের অন্য কোন শহর থেকে ততটা সহজে পাওয়া যেত না।

ত্রিপুরাতে প্রচুর শরণার্থী ছিল সেসময়। ১৯৭১ সালে ত্রিপুরার এমন কোন পরিবার নেই যেখানে বাংলাদেশের শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়নি। সেসময় ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ, আর বাংলাদেশী শরণার্থী ছিল ১৪ লক্ষের উপরে। দরিদ্র রাজ্য ত্রিপুরাবাসীর পক্ষে এত মানুষের খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা করা খুব কষ্টের ব্যাপার ছিল। তারপরেও ত্রিপুরাবাসী আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশীদের বুকে টেনে নিয়েছে, একসাথে খেয়েছে, একসাথে ঘুমিয়েছে। আগরতলার জিবি ও আইজিএস হাসপাতালে প্রচুর শরণার্থী আসতেন। জায়গার অভাবে তাদের চিকিৎসা থেমে থাকেনি, আগরতলা শহর থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দুরে স্থানীয়দের সহয়তায় বাঁশ খুঁটি দিয়ে অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছিল যাতে কেউ যেন চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়।

শরণার্থীদের মধ্যে যারা মারা যেত তাদের সেখানেই কবর দেওয়া হত। বাংলাদেশ ত্রিপুরা সীমান্তের যেখানে যুদ্ধ হয়েছে সেখানেই রয়েছে বাংলাদেশের সোনার ছেলেদের কবর। ত্রিপুরাবাসীর এ ঋণ কিভাবে শোধ হবে জানিনা, তাদের কাছে আমরা বাংলাদেশীরা চির কৃতজ্ঞ। ১৯৭১ সালের সবচেয়ে বর্বর হত্যকান্ডটি চালানো হয় স্বাধীনতার ঠিক ২ দিন আগে ১৪ই ডিসেম্বর। সেদিন গভীর রাতে মুনীর চৌধুরী সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী শিক্ষকদের হত্যা করা হয়, হত্যা করা হয়েছিল দেশের সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার সহ সকল শিক্ষিত শ্রেনীর মানুষদের, তাদের হত্যা করে আমাদের শিক্ষাস্বরূপ মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। বুকভরা বেদনা নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। সেদিন বাংলাদেশ আনন্দ উৎসব করেছিল। সেই আনন্দ উৎসব টাও ছুয়ে গেছিল ত্রিপুরাবাসীর, সেদিন তারাও আমাদের সাথেও বিজয় মিছিল করেছিল নিশ্চয়।

ভারতের যেকোন অঞ্চলের চেয়ে ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে ভাল ও বন্ধুত্বপূর্ণ। আজ আমাদের ভাবতে ভাল লাগে, আমাকে ভাবতে শেখায় ত্রিপুরাবাসীর সেই ভালোবাসা এখনো সেই আগের মতই রয়ে গেছে। ভারতের অন্যান্য এলাকায় যখন বাংলাদেশী টেলিভিশন চ্যানেল চলে না সেখানে ত্রিপুরাতে ঠিক তার উল্টো চিত্র, ত্রিপুরাতে বাংলাদেশী চ্যানেলের ভাল কদর রয়েছে। আজ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ত্রিপুরার স্থানীয় পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইনে আসে। গত ১০ বছর ধরে আগরতলার বইমেলায় প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে রাখে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা এবং এই বইমেলার প্রধান আকর্ষণ বাংলাদেশের স্টল। বাংলাদেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের তারা তাদেরই একজন মনে করে। বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এই রাজ্য তথা সমগ্র উত্তপ পূর্ব ভারতে। দক্ষিন ত্রিপুরা জেলার চোত্তাখোলায় তৈরি করা হয়েছে “বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী উদ্যান”। চোত্তাখোলা মৈত্রী উদ্যানের সবচেয়ে উচু টিলার ওপর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনের আদলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি দীর্ঘ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ত্রিপুরার মানুষ ২১শে ফেব্রুয়ারী, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর সহ বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো অত্যন্ত শ্রদ্ধা, গভীর ভালোবাসা আর আনন্দের সাথে পালন করে থাকে।

এই ব্যাপারগুলো পেপারে পড়লাম, টেলিভিশনে দেখলাম কিংবা কারো কাছে শুনলাম এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ব্যাপারগুলো আমাকে খুব ভাবায়, ব্যাপারগুলো অনুভব করে নিতে হয়, হৃদয় দিয়ে। এগুলো ত্রিপুরাবাসীর কাছ থেকে এমনি এমনি আসেনা, সম্পূর্ণ ভালোবাসা থেকে আসে। তারা বিনিময়ে কিছুই চায়না, শুধু চায় আমরা বাঙ্গালীরা সবাই যেন একসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে একসাথে চলি।

ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের আত্মার সম্পর্ক। আজ বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মানুষ রাজনৈতিক কারনে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, বিদেশী বলে চিহ্নিত। কিন্ত নদীর জল মাঝখানে কাটলে যেমন আলাদা হয়না, তেমনি উভয় প্রান্তের মানুষকে তাঁরকাটা দিয়ে আলাদা করা সম্ভব নয়। আমরা এক ভাষায় কথা বলি, আমাদের হাসি, কথা, দুঃখ, বেদনা, চালচলন, আচার ব্যাবহার, জীবনধারা সবই এক। বাংলাদেশের সাথে ত্রিপুরায় বসবাসকারী সাধারন মানুষের কোন গড়মিল নেই, ন্যুনতম ভিন্নতা নেই তাঁরকাটার এপার ওপার কৃষকের মাঝে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম যেমন আমাদের প্রাণের সাথে মিশে আছে তেমনি ওপার মানুষের সাথেও। আমার দুটি দেশের নাগরিক হতে পারি, কিন্তু এরকর প্রতি অন্যের ভালবাসা, সহযোগিতা আগেও যেমন ছিল এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অটুট থাকুক ভাতৃত্বের বন্ধন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইরান ইসরাইলের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ আর আমাদের সুন্নী-শিয়া মুমিন, অ-মুমিন কড়চা।

লিখেছেন আফলাতুন হায়দার চৌধুরী, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩০

(ছবি: © আল জাযীরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক)

শ্রদ্ধেয় ব্লগার সামিউল ইসলাম বাবু'র স্বাগতম ইরান পোষ্টটিতে কয়েকটি কমেন্ট দেখে এই পোষ্ট টি লিখতে বাধ্য হলাম।
আমি গরীব মানুষ, লেখতে পারিনা। তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৯




আমরা পৃথিবীর একমাত্র জাতী যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এখানে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা মারমা তথা উপজাতীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। উপমহাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×