যখন থেকে ক্লাব ফুটবল বুঝি তখন থেকেই আমি মাদ্রিদিস্তা। এবং তখন থেকেই শুনে আসছি রিয়াল মাদ্রিদের ”লা ডেসিমা” ”লা ডেসিমা” কাতর ধ্বনি। চ্যাম্পিয়নস লীগে দশম শিরোপার জন্য প্রাণান্ত হাহাকার। নামিদামি কোচ, হাজার কোটি টাকার খেলোয়াড় কিছুই বাদ গেল না। কিন্তু সেই সোনার হরিণ আজও অধরা।
মাদ্রিদ থেকে বহুদূরের শহরে শহরে, এই দেশে চলছে আরেক খেলা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখানেও লা ডেসিমা বা দশম শিরোপা । স্প্যানিশ লীগে যেমন দল অনেক থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটা দ্ইু ঘোড়ার লড়াই, এখানেও তেমনি। সেই দুই ঘোড়ার এক ঘোড় রিয়াল মাদ্রিদের লা ডেসিমার সাথে এখানে পার্থক্য একটাই, রিয়াল মাদ্রিদের লা ডেসিমা হলো চ্যাম্পিয়ন্স লীগে তাদের ব্যাক্তিগত শিরোপার সংখ্যা আর এই দেশের সেই খেলায় লা ডেসিমা হলো দেশটির ইতিহাসের মোট টুর্নামেন্টের সংখ্যা।
রিয়াল মাদ্রিদ মাঠের বাইরে তাদের যা কিছু করা সম্ভব করছে, খেলোয়াড়, ম্যানেজার এবং অন্যান্য করণীয় কিছুই বাদ দিচ্ছে না। তবুও তাদের অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোয় না। কারণ, তারা মাঠের করণীয়টাই শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি শেষ করে উঠতে পারছে না, সেমি-টেমিতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। কিন্তু এই দেশের সেই খেলার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দলটি কিন্তু রিয়ালের মতো দীর্ঘসূত্রিতার পথে যাবার মতো ভুল করছে না। এবং তারা উপলব্ধি করেছে যে, কেবল মাঠের বাইরের উন্নতিসাধন করলেই চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। যা করার তা আসলে করতে হয় মাঠেই। আর মাঠ থেকে ফলাফল আদায় করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো যদি প্রতিপক্ষ মাঠেই না নামে বা বলা যায় যদি তাদেরকে মাঠেই নামতে না দেওয়া হয়। তখন রীতিমতো যাকে বলে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া। আর এই পথে আমাদের বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা অনেকদূর এগিয়েও গেছে।
কিন্তু এই চ্যাম্পিয়নস লীগ এত সহজ কোন খেলা নয়, রিয়ালদের চ্যাম্পিয়নস লীগের চেয়ে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ, ঢের বেশী ”অর্থবহ”। বিশ্বের¦ সবচেয়ে বেশী প্রাইজমানি, সবচেয়ে বেশী ক্ষমতা এবং শৌর্যের হাতছানি, পাঁচ বছরের জন্য শিরোপা এবং আরও অনেক কিছুই; কাজেই অপর দলটিই বা ছেড়ে কথা কইবে কেন?
ছেড়ে কথা কইছেও না তারা। অর্জনের আশা বাদ দিয়ে অন্য দলটি এখন বর্জনের কথা বলছে। তারা এখন না খেলার কথা বলছে, টুর্নামেন্ট বর্জনের হুমকি দিচ্ছে। হুমকির পাশাপাশি তারা ধামকিও দিচ্ছে। এতে কিছু কাজ হচ্ছে মনে হচ্ছে। দর্শকরাও এখন আর সেই ক্রিড়ামোদী মুডে নেই। গতবারের রানার আপ এবং অন্যান্য দলের ব্যাপক প্রস্তুতির মুখেও বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা যদিও তাদের অবস্থানে অনড়, কিন্তু ওদিকে আবার মুভমেন্ট একেবাওে বন্ধ হয়ে গেছে আম আদমিদেরও।
আকাশ পথ ছাড়া আমজনতার নড়াচড়া করার আর কোন উপায় নেই এখন আর। সড়কপথে পেট্রোল বোমা আর আগুন, গাছ কেটে ফেলে রাখা, রাস্তা কেটে রাখা; বনবাদাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া রেলের ফিশপ্লেট খুলে ফেলা সেই তুলনায় আবশ্য আয়েশসাধ্যই বলতে হবে। শোনা গেল ”বাংলাদেশে এই প্রথম” নৌকা আর স্পিডবোট নিয়ে নৌপথ অবরোধের খবরও। পরে আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং কোস্টগার্ড-এর সম্মিলিত চেষ্টায় নাকি সেই অবরোধ খোলা হয়েছে। যাই হোক বাংলার আকাশ পরিবহন শিল্পে যে একটা অপার সম্ভবনা আছে তাও এবার অঙ্কুরিত হবার সুযোগ পেল। খতিয়ে দেখা হচ্ছে আন্তজেলা সাবমেরিন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর সম্ভাব্যতাও, খোলা হবে বাংলাদেশ আন্ডার ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বা বিইউডব্লিওটিএ নামে একটি আধাসায়ত্বসাশিত সংস্থাও।
যাই হোক, লা ডেসিমার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে উত্তেজনা-উন্মাদনা। ব্যাপারটা আসলেই এখন উন্মাদনার পর্যায়ে পৌছে গেছে। শিরোপার জন্যে প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত একথা এতদিন খেলার পাতায় পড়েছি, এখন দেখতেও পাচ্ছি আশে পাশে। যদিও এখানে জীবন দিতে চাওয়ার চেয়ে জীবন নিতে চাওয়াতেই দলগুলোর আগ্রহ বেশী, তবু এটি কিন্তু সার্বিকভাবে শিরোপার প্রতি তাদের যে ভালোবাসা, তাদের যে আত্মনিবেদন সেটিরই বহিঃপ্রকাশ।
আমজনতা চলাফেরা না হয় একটু কমই করলো ফাইনালের আগপর্যন্ত। উত্তেজনা উন্মাদনার সহিংস ক্ষততো আছেই, আছে সুদূর প্রসারি অহিংস প্রভাবও। এটি একটি পুরোদস্তুর স্পোর্টস ফিচার, তাই আর সহিংসতার খবরে না গিয়ে জানানো যাক অহিংস খবরগুলোই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজনের কাছে শোনা গেল যে, তিনি তার একমাত্র সন্তানের অন্নপ্রাসনের দিন তার কোন নিকট আত্মীয়কে কাছে পাননি। তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যমতে পরিবারের সবারই অন্নপ্রাসন হয়েছে নিজ জেলার স্থানীয় এক মন্দিরে। ছেলের অমঙ্গলের আশংকা আর হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে তিনি জানান, নিজের ছেলের বেলায় দেশের পরিস্থিতির কারনে পারেননি গ্রামে যেতে, পারেনি ছেলের দাদা বা নানা বাড়ির কেউ ঢাকা আসতে। শেষ পর্যন্ত বাসার পাশের ছোট একটা মন্দিরেই মামাকে ছাড়াই সারতে হয় অন্নপ্রাসনের আনুষ্ঠানিকতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় একজন চিন্তাবিদ জানান যে, জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে উপরওয়ালার হাতে থাকলেও ইদানিং একদমই কমে গেছে বিয়ের হার, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেশজ জন্মহারে। আর এই বিয়ে এবং জন্মের হার কমে যাওয়ায় সামগ্রিক স্ট্রাইক রেট ঠিক রাখতেই যেন বেড়ে গেছ মৃত্যুহার।
সরেজমিন তদন্তে প্রমাণ মিলেছে চিন্তাবিদের চিন্তিত মতামতের। অনেককেই দেখা যাচ্ছে এই অস্থিরতায় তাদের প্রেমটাকে ঠিকমতো জমিয়ে তুলতে পারছে না; যার প্রেম জমেই আছে তিনি পারছেন না বিয়ের আয়োজনটা সেরে ফেলতে বা অপ্রেমিক পাত্র হয়ে থাকলে পাত্রী দর্শনে যেতে; যারা বিয়ে করেছেন, স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকায় বৃহস্পতিবারে একটু আগেই অফিস থেকে বের হয়ে যে দৌড় মারতেন বাড়িতে, তারাও গত মাসখানেক যাবৎ রাজধানীতে অবরুদ্ধ। জন্মসূচকে এর একটা প্রভাবতো থাকবেই।
ভার্সিটিতে এক শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম তিনি যখন পিএইচডি করতে বেলজিয়াম গিয়েছিলেন তার পিএইচডি ইন্সট্রাকটর তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ”বাংলাদেশের সবার জন্ম তারিখ একই কেন? সবাই শীতকালেই কেন বা সন্তান জন্ম দেন?” সেই ইন্সট্রাকটর নাকি আমার শিক্ষকসহ যতজন বাংলাদেশী দেখেছেন সবার জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি।! বিব্রত আমার শিক্ষকটি তার নির্দেশককে নাকি আর বুঝিয়ে বলতে পারেন নি যে, আমাদের দেশে মাধ্যবিক পরীক্ষার আগে যখন রেজিস্ট্রেশন করা হয় অধিকাংশ সময়ই শ্রেণী শিক্ষক ইচ্ছেমতো বসিয়ে দেন জন্ম তারিখ, কখনও কখনও ভালো নামটিও। এ জন্যেই এদেশের বিশেষত তাদের সময়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরই কাগজে কলমে জন্ম তারিখ ছিল ০১-০১-**!
ডিজিটাল বাংলাদেশে হয়তো এ সমস্যা অনেকটাই মিটে গেছে কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এদেশের জন্মচক্র যে মাস তিনেকের একটা পাকে পড়লো এ কথার বোধহয় একটা ভিত্তি আসলেই আছে। পত্রিকায় ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটা খবরের কথা পড়লাম। অনেকেরই পড়ে থাকার কথা খবরটা। বার্সেলোনার মানরেসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেসাস মন্তেসিনোসের এক গবেষণায় দেখা যায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কাতালান রাজ্যগুলোয় জন্মহার বেড়ে যায় শতকরা ১৬.১ ভাগ। পরের মাসেও জন্মহার স্বাভাবিকের চেয়ে ১১ ভাগ বেশী। কিন্তু এর আগে বা পরে জন্মহার স্বাভাবিক। কারণ খুঁজতে খুঁজতে অধ্যাপক সাহেব ফিরে যান দশ মাস আগের এক দিনে। ২০০৯ সালের ৬ মে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে চেলসির বিপক্ষে খেলছে বার্সেলোনা। এক গোলে পিছিয়ে থাকা বার্সেলোনা একেবারে শেষ মুহুর্তে ইনিয়েস্তার একটা অসাধারণ গোলে খেলায় সমতা ফেরায় এবং পরে দুই লেগ মিলিয়ে অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে উঠে যায় ফাইনালে। পরবর্তীতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে জিতে নেয় তাদের তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপাটিও। এই জয় পুরো কাতালান রাজ্যগুলোকে ভাসিয়ে দেয় আনন্দের বন্যায়। আর সেই বাধনহারা আনন্দ উদযাপনের সময়টাতেই বপণ করা হয়েছিল ১০ মাস পরে যেসব শিশুর জন্ম নেবে তাদের বীজ।
এটা হয়তো নিছকই কোন পরিসংখ্যান, তবে এই ”ইনিয়েস্তা প্রজন্ম”র ব্যাপারে অধ্যাপক হেসাসের ব্যাখ্যা-- জনসংখ্যার ওঠা নামায় বড় ভূমিকা রাখে মানুষের আবেগ। জাতীয় বা আঞ্চলিক কোন উৎসব বা আনন্দের মূহুর্ত মানুষের উদ্বেগ কমিয়ে দেয়, বাড়িয়ে দেয় ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার ফল জন্মহারের এই উল্লম্ফন।
আমাদের দেশেও কথাটা সমানভাবে প্রযোজ্য, কেবল একটু উল্টোভাবে। এদেশে লা ডেসিমার প্রভাবে বরং কমে গেছে ভালোবাসা, ভালোবাসার সুযোগ, বেড়ে গেছে মানুষের উদ্বেগ। জনসংখ্যা সত্যিই যদি কিছু কমে সেটাকেও বরং লা ডেসিমার সাফল্যই বলতে হবে।
রিয়াল মাদ্রিদকে ভালোবেসে লা ডেসিমার জন্য একযুগ ধরে অপেক্ষায় আছি, আর আমাদের এই লা ডেসিমা আবার ভালোবাসতে পারার জন্যে আমাদের কতদিন অপেক্ষায় রাখে কে জানে। এই লা ডেসিমার পর আবার আমাদের আনন্দের উপলক্ষ কবে আসে কে জানে, আবার আমাদের উৎসবের আয়োজন কবে হয় কে জানে, আবার আমাদের ভালোবাসার ইচ্ছে ও সুযোগ হয় কে জানে। কারণ, শিরোপ বেদখল হলে সব দল মিলেই জনগনের ঘুম আক্ষরিক অর্থেই হারাম করে ছাড়বে।
তবে সাধারণ মানুষ মাদ্রিদিস্তা বোঝে না, কাতালান বোঝে না, তারা উৎসব বোঝে; সাধারণ মানুষ ইনিয়েস্তা প্রজন্ম বোঝে না, তারা আনন্দ বোঝে; সাধারণ মানুষ লা ডেসিমা খোঁজে না, তাঁরা শান্তি খোঁজে।
.
.
.
২০.১২.২০১৩
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৫২