মহাজোটের অংশীদার জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু রাখঢাক ছাড়াই খোলামনে বলেছেন, কাল দেশে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় বা ভরাডুবি কেউ ঠেকাতে পারবে না। একই সঙ্গে তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত মন্তব্য করে বলেন, যদিও হয় তা হবে কিলাকিলি-কাটাকাটির নির্বাচন।
পরিস্থিতি উন্নতির কোনো আলামত তিনি দেখছেন না এবং সেই সম্ভাবনা নেই বলেও মন্তব্য করেন এ দেশের রাজনীতির গভীর পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মঞ্জুর ভাষায়, প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তার দল ও মাঠপ্রশাসন। তিনি অনেক ভালো কথা বললেও মাঠে তা কার্যকর হয়নি, হচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের রায়কে সাংঘর্ষিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও যা না থাকলেও তা। মানে অনিশ্চিত নির্বাচন হলেও মারামারি অনিবার্য। গতকাল প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত, হতাশ, ক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এ কথা বলেন।
এ দেশের সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সন্তান মঞ্জু ইত্তেফাক সম্পাদকই নন, একজন রাজনীতিবিদও। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ষাটের দশকে ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাই নন, ফজলুল হক হলের ভিপি, জিএসও ছিলেন। এরশাদের গুড মিনিস্টার মঞ্জু শেখ হাসিনার প্রথম ঐকমত্যের সরকারেরও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। রাজনীতির অন্দরে-বাইরে তার যোগাযোগ যেমন শক্ত, নজর তেমনি তীক্ষ্ন। খালেদার প্রথম শাসনামলে রাজপথে বোমা খাওয়া, জেলখাটা মঞ্জুর দুই নেত্রীর সঙ্গেই সুসম্পর্ক। পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধুর স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা মঞ্জুকে মুজিব পরিবারের অঘোষিত সদস্যও বলা যায়। বন্ধুবৎসল, দিলখোলা তুখোড় আড্ডাবাজ মঞ্জু একসময় বন্ধুদের নিয়ে রাতবিরাতে লংড্রাইভে বের হতেন। বয়স বাড়ছে, পরিস্থিতি পাল্টেছে চিরসবুজ মঞ্জু লংড্রাইভ কমিয়েছেন। রেস্টুরেন্টের খানাপিনা আড্ডায় বিরতি দেননি। তার নির্বাচনী এলাকায় কখনো ভোটে হারেননি। ১৯৯৬ সালে তার ছেড়ে দেওয়া একটি আসনের উপ-নির্বাচনে তার প্রিয়তম পত্নী তাসমিমা হোসেনকে জিতিয়ে আনেন। ওয়ান-ইলেভেনে নীড়হারা ঝড়ের পাখি মঞ্জুর নির্বাসিত দুটি বছর ছিল দুঃসহ মানসিক নির্যাতনের।
মঞ্জু বলেন, দেশে যদি নির্বাচন সুষ্ঠু স্বাভাবিক থাকত তাহলে কোনো সমস্যাই সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখানে বিপরীতমুখী রাজনীতির জন্য অবস্থা স্বাভাবিক নয়। দেখতে হচ্ছে সামনে অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকার। আল্লাহর অসীম রহমতে মিরাকল কিছু যদি না হয় তাহলে সুস্থ স্বাভাবিক নিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই। যদিও এ কথা উল্লেখ না করলে অবিচার হবে যে শুধু এ দেশেই নয়, আমেরিকা-ইউরোপসহ দুনিয়াজুড়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেখানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চাকরি-বাকরির ব্যাপারটা প্রধান। এখানে অর্থনীতি ও রাজনীতির অনিশ্চয়তা দুটোই তীব্র। যদি রাজনীতিবিদরা সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে জয়-পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতায় নির্বাচনের পথে হাঁটতেন তাহলে সম্ভাবনার আলো দেখা যেত। কিন্তু এর লক্ষণ আড়াই বছরেও দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুদ্রাস্ফীতির সংকটকে উচ্চপর্যায়ে চিন্তার ব্যাপার ভাবলেও গ্রামে-গঞ্জে, জেলা-থানায় যা হচ্ছে তাতে কারও পক্ষে আশাবাদী হওয়া সম্ভব নয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু স্বগতোক্তির মতো বললেন, 'কিন্তু এ অবস্থা কি রাজনৈতিক দল মেনে নেবে?' যে অবস্থা বিরাজ করছে! মাঠের শাসক দল প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে! তিনি যা বলেন ও করেন তা মাঠে প্রতিফলিত হয় না। প্রশাসন কোথায় তাদের প্রতিরোধ করবে তা না উল্টো তাদের পদলেহন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। যে অবস্থায় সরকারি দলের ওপর দায়দায়িত্ব পড়ছে তা তো দলীয় প্রধান করতে বলছেন না। তিনি বলেন, এরশাদ-খালেদা-হাসিনা তিনজনই প্রশাসনকে কঠোর হাতে দমন করতে বলেছেন। এরশাদের জাপার মহাসচিব ও মন্ত্রী মঞ্জু বললেন, এরশাদের দল ছিল না। যেটা ছিল তা ছিল জ্ঞানী, গুণী ও সুবিধাবাদীদের মহামিলন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি রাজনৈতিক দল। কিন্তু এবারের মতো মাঠে শাসক দল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়াভাবে হাতের বাইরে যেভাবে গেছে অতীতে কখনো যায়নি। এদের মাঠপ্রশাসন উসকাচ্ছে। আগামীতে শুধু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেই কিছু হবে না। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও হবে। চরমভাবে হবে। ঢাকার বাইরে প্রশাসন আছে এটা এখন আর উন্মাদও বিশ্বাস করে না। তারা এখন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন, শাসক দলের মাঠ নেতা-কর্মীর স্বতঃপ্রণোদিত গোলামে পরিণত হয়েছেন। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী আর থানা প্রশাসন চলছে শাসক দলের নেতা-কর্মীর ইচ্ছায়। তারা উন্নয়নমূলক বরাদ্দ লুটে নিচ্ছে তাই নয়, তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে যাচ্ছে। বাড়িঘর দখল, খুন-খারাবি, থানায় এনে মানুষ নির্যাতন সব কিছুতেই তারা। প্রশাসন তাদের হাতমাত্র। দেশে স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র অনেক কিছুই দেখেছি, এবারের মতো প্রশাসনের নির্লজ্জ নগ্নরূপ কখনো দেখিনি। এর পরিণতি কী, জানতে চাইলে বেনসনের ধোঁয়া ছেড়ে, চকচকে কপালে হাত রেখে শান্ত ধীরকণ্ঠে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বললেন, এর পরিণতি বিশৃক্সখলা। এর পরিণতি নির্বাচন নয়, নৈরাজ্য। ছাইদানিতে সিগারেট রেখে মুনাজাতের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে আমরা ফরিয়াদ করি, অতীত অভিজ্ঞতায় সামনে যা দেখছি তা যেন না হয়। এই নৈরাজ্যের সুযোগ সবাই নিতে চাইবে। প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সবাই। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে সর্বত্র ন্যায়-নীতি, বিবেক, আইন-কানুনের কোনো বালাই নেই। মঞ্জু বলেন, তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা যদি কেউ করেন তিনি তার বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে করবেন না। করলে রাজনৈতিক কারণে করবেন। চারদলীয় সরকার কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মানুষ যেমন ভয়ভীতি ত্রাসের মধ্যে ছিল এখনো তেমনি ত্রাস ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত ব্যক্তি কোথাও গিয়ে সুবিচার পাবে, এমন অবস্থা দেশের কোথাও নেই। এমপি সাহেবরা কি বলেন, কি বলেন না তার প্রমাণ নেই। কিন্তু যা কিছু হচ্ছে তাদের নামে বাড়ি দখল, মামলা, থানায় নিয়ে নির্যাতন সবই হচ্ছে। মামলা নেওয়া না নেওয়া এটাও নির্ভর করছে নাকি নেতা-কর্মী, এমপি বাহাদুরদের কথামতো। আমরা বলি দেশে পয়সা নেই, অনেকের নাকি আয়ে জীবন চলে না। তাই যে যেখান থেকে পারছে সেখান থেকেই বাতাসা হরিলুট করছে। তবে এতকিছুর মধ্যে খুশি ও আনন্দের সংবাদ একটি তা হচ্ছে, আপনি সরকারি দলে থাকুন আর বিরোধী দলে থাকুন পকেটে পয়সা থাকলে কাজ করাতে পারবেন। এখানে কিছুই করা সম্ভব নয় আবার সবকিছু করাই সম্ভব। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যেন এককালের প্রভাবশালী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের মতো নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, তার কাছে এমন কিছু পিলে চমকানো খবর আছে যা প্রকাশ করলে আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হতে পারে। তিনি নিজেই প্রশ্ন করলেন তবে কি যারা মনে করেন মতলববাজরা প্রচার করেন দেশটি ব্যর্থরাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, সেদিকেই নেওয়া হচ্ছে? আমাদের মনে সন্দেহ কি রাজনৈতিক কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে যেসব দুর্নীতির লোমহর্ষক ঘটনা দলিল-দস্তাবেজ-প্রমাণাদি রয়েছে, তারাও অর্থের জোরে পার পেয়ে গেছে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না কি এই জোট বা ওই জোট, অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। লুটপাটের জন্য রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের মধ্যে অলিখিত জোট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে যদি টান মারে তবে আশ্চর্য হব না। দেশ এতই ছোট, যারা মনে করেন গোপনে সেরে ফেললে কেউ জানবে না তারা বোকার স্বর্গে ঘুমাচ্ছেন। সকালে যা ঘটছে বিকালেই মানুষের কাছে খবর চলে যাচ্ছে। জেলা-উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জে যান তারপর এসে কথা বলুন। মঞ্জু বলেন, বিকল্প কী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিরোধী দল কোর্ট-কাচারিতে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে পড়ে আছে। দল গঠনের সুযোগ নেই। আল্লাহ আল্লাহ করে যদি নির্বাচনী ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেত তাহলে সুনিশ্চিত নৈরাজ্য থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হতো। সেই সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
(বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অবলম্বনে)