প্রায় ন’মাস আগে ব্লগে আমার আগমন। ব্লগে থেকে থেকে পড়তাম, দু-চারটি মন্তব্যও করতাম। একটা লেখাও প্রকাশ করি। ব্লগ থেকে ভালোই সাড়া পাই। সবকিছুই ভালো চলছিল। হঠাৎ আমার ছন্দপতন!
ব্লগে আমার প্রবেশ কোন এক বিচিত্র কারণে বন্ধ হয়ে গেল। কোনক্রমেই ব্লগে ঢুকতে পারছিনা। অনেকবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পর্দায় দেখাচ্ছিল ‘Server not found’। মাঝে মাঝে সামুতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। একসময় আশা ত্যাগ করলাম।
হঠাৎ সেদিন কি মনে করে ব্লগে ঢুকলাম। দেখলাম সবকিছুই আবার আগের মত ঠিক হয়ে গেছে। লগইন করার প্রথম চেষ্টাই সফল হল। ব্লগে লগইন করেই পড়তে লাগলাম। একটা লেখা লেখার ইচ্ছা জাগলো। ভাবলাম এখন যা মাথায় ঘুরছে তা নিয়েই লিখব।
আমার একটা বদঅভ্যাস রয়েছে। কোন একটা বিষয় মাথায় ঢুকলে সেটা নিয়েই পরে থাকি। কিছুদিন আগে মাথায় ‘কেল্টিক মিউজিক’ ঘুরছিল। পুরো বাসার লোক অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল আমার মিউজিক শুনে। তার আগে মাথায় ছিল ‘অটোবায়োগ্রাফী’। তার আগে ‘আফ্রিকার ইতিহাস’।
তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর ‘সামরিক বাহিনী’ নিয়ে ইন্টারেস্ট জাগলো। কয়েকটা বই পড়লাম, কয়েকটি ডকুমেন্টারি দেখলাম আর দেখলাম কিছু ‘War Film’। মাথা থেকে ‘সামরিক বাহিনী’ উড়ে গেল। ভূতের মত ঘাড়ে চেপে বসলো ‘War Film’। হ্যাঁ আজকের লেখাটা ‘War Film’ নিয়ে। সম্প্রতিকালে দেখা বিশ্বের কিছু অসাধারণ সিনেমার রিভিউ।
এই সিনেমার তালিকা শুধুমাত্র যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। অনেকেই ভাববেন ‘The Bridge on the River Kwai’, ‘Casablanca’ কিংবা ‘The Pianist’ নেই কেন? এর কারণ এই সিনেমাগুলোর ভিত্তি যুদ্ধ ছিল না। যেমন ‘The Bridge on the River Kwai’ ছিল ‘প্রিজনার অব ওয়ার’ নিয়ে, ‘The Pianist’ ছিল বায়োগ্রাফীক্যাল, ‘Casablanca’ ছিল কিছুটা এন্টি-ওয়ার প্রোপ্যাগান্ডা কিছুটা রোমান্টিকতা নিয়ে। কিন্তু আমার এই সিনেমাগুলো মোটামুটি ব্যাটেল নির্ভর।
Patton: আমার দেখা সবচেয়ে ভালো সিনেমা। ১৯৭০ সালে মার্কিন সেনা অফিসার জেনারেল জর্জ প্যাটনকে নিয়ে সিনেমাটি তৈরি হয়। এটি ‘Based on true story film’। ইতিহাসবেত্তা ল্যাডিসলাস ফ্যারাগোর বই ‘Patton: Ordeal and Triumph’ ও মার্কিন সেনা অফিসার এবং জেনারেল প্যাটনের বন্ধু জেনারেল অব দ্য আর্মি ওমর ব্র্যাডলির বই ‘A Soldier's Story’ থেকে সিনেমাটি বানানো হয়। সিনেমাটিতে এমন কিছু ব্যাটেল সিন রয়েছে যা দেখলে মনে হবে যে ফ্রন্ট লাইনে দাড়িয়ে নিজেই যুদ্ধ করছি। অস্কার বিজয়ী পরিচালক ফ্রাঙ্কলিন স্যাফনার সিনেমাটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটি ১১টি অস্কার মনোনয়ন ও ৭টি অস্কার জয় লাভ করেন। কিন্তু অভিনেতা জর্জ স্কট সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন।
সিনেমাটির মূল আকর্ষণ থাকে এর হিউমারে। বিভিন্ন রকম হিউমারে ভরপুর সিনেমাটি। এক দৃশ্যে দেখা যায় জেনারেল প্যাটন সোভিয়েত জেনারেলের সাথে ড্রিঙ্কস করতে রাজি না, তিনি বলেন যে কোন রাশিয়ান ‘Son of a B****’ এর সাথে তিনি ড্রিঙ্কস করবেন না। উত্তরে রাশিয়ান জেনারেল বলেন যে প্যাটনও একটি ‘Son of a B****’। তখন জেনারেল প্যাটন হাসতে হাসতে বলেন, “I’ll drink to that, one son of a b**** to another son of a b****”। আমার রেটিং ৯/১০। (IMDb-8.0) Trailer
Paths of Glory: ১৯৫৭ সালে ‘2001: A Space Odyssey’ খ্যাত পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক সিনেমাটি নির্মাণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এই সিনেমাটি তৈরি। সিনেমাটিতে অভিনয় করেন কার্ক ডগলাস, জর্জ ম্যাকরেডিসহ আরও অনেক নামকরা অভিনেতারা। সিনেমাটি সাদাকালো পর্দার। বলা হয়ে থাকে ৫৭তে মার্কিন মুলুকে সাদাকালো সিনেমা কেন? এর কারণ ছিল সাদাকালো পর্দা পুরনো দিনের প্রতিনিধিত্ব করে। স্ট্যানলি কুবরিক একজন অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। তিনি তাঁর অনেক সিনেমারই সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। তিনি স্পেশাল ভিজুয়াল ইফেক্ট ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারও লাভ করেন। বোঝাই যাচ্ছে পর্দা নিয়ে তিনি খেলতে পছন্দ করতেন।
সিনেমাটিতে ফ্রেঞ্চ জেনারেল মিরোকে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন যে একটি বিশেষ স্থানে আক্রমণ করতে। কিন্তু জেনারেল মিরো তাতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ এতে করে তার ডিভিশন বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে জানান যে সে যদি আক্রমণ করে তবে তার কাঁধে আরেকটি তারকা বাড়বে। জেনারেল মিরোর মনে লোভ ঢুকে পরে। সে তার অধস্তন কর্মকর্তা কর্নেল ড্যাক্সকে আক্রমণ করতে বলে কিন্তু কর্নেল কিছুতেই রাজি হয় না। এরকম করতে করতে একপর্যায়ে সেনারা আক্রমণ করে। আক্রমণ আরও জোরালো করতে লে. জেনারেল তার আর্মিদের ভয় দেখানো শুরু করে। পরবর্তীতে ভয় আরও বাড়াতে জেনারেল মিরো প্রহসনমূলক একটি কোর্ট মার্শাল ডাকে যাতে কিছু নিরপরাধ সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, কারণ হিসেবে বলা হয় কাপুরুষতার জন্যে তাদের এই দণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাটেল কিভাবে হত তা সিনেমাটিতে খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়। মিলিটারি কালচার সুন্দরভাবে ফুটে উঠে এই সিনেমাটিতে। সিনেমাটির কোর্ট মার্শাল হওয়ার সময় কর্নেল ড্যাক্সের একটি ভাষণ সত্যিই হৃদয় ছোঁয়ার মত। আমার রেটিং ৮.৫/১০। (IMDb- 8.5) Trailer
Max Manus- Man of War: ২০০৮ সালে জোয়াকিম রনিং ও এসপেন স্যান্ডবার্গ নির্মিত এই সিনেমাটিতে নরওয়েজিয়ান ফ্রিডম ফাইটার ম্যাক্স ম্যানাসের অপারেশন গুলো দেখানো হয়। এটি ‘Based on true story film’। ম্যাক্স অত্যন্ত ধূর্ত একজন সাবুতেওর ছিলেন। যার জন্যে পুরো নাৎসি বাহিনী ভয়ে থাকত। সে নাৎসিদের হাতে ধরা পরেও পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার পরও একের পর এক আক্রমন করতে থাকে নাৎসিদের ওপর। একসময় একটি যুদ্ধ জাহাজও ধ্বংস করে দেয়।
তাকে খুঁজতে নাৎসিরা তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর ধরতে পারে না এই যোদ্ধাকে। যে নাৎসি অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ম্যাক্সকে ধরতে সে শেষপর্যন্ত নিজেই ধরা পরে। সেই অফিসারের সাথে জেলে ম্যাক্স দেখা করতে আসে । সেখানে তাদের কিছু কথা হয়। তাদের সেই কথোপকথন সিনেমাটিকে আরও ফুটে উঠতে সাহায্য করে। সিনেমাটি নরওয়েজিয়ান, ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় নির্মিত হয়েছে। আমার রেটিং ৮.২/১০। (IMDb-7.3) Trailer
Enemy at the Gates: ২০০৫ সালে সিনেমাটি নির্মিত হয়। জ্যঁ আনুদ সিনেমাটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটিতে অভিনয় করেন অভিনেতা জুড ল, ‘The Mummy’ খ্যাত অভিনেত্রী র্যাচেল ওয়েইজ। এটি ‘Based on true story film’। ভাসিলি জাইৎচেভ নামক এক স্নাইপার যোদ্ধাকে নিয়ে সিনেমাটির কাহিনী ঘুরতে থাকে। জুড ল ভাসিলির চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমায় সোভিয়েত আর্মির নিজের সেনাদের উপর চালানো বীভৎসতা, জার্মান আর্মির নিষ্ঠুরতা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা হয়।
ভাসিলি সেনাবাহিনীতে যোগদান করে সাধারন আর্মি হিসেবে কিন্তু পরে তার গুলি চালানোর দক্ষতার জন্যে স্নাইপার ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। ভাসিলি একের পর এক নাৎসি সেনা হত্যা করতে থাকে তার সেই স্নাইপার দিয়ে। নাৎসি বাহিনী ভাসিলিকে হত্যা করার জন্য মেজর আরউইন কনিগকে নিয়োগ দেয়। মেজর আরউইনও ছিলেন স্নাইপার চালনায় দক্ষ। তাদের মধ্যে ব্যাটেল হতে থাকে। অনেক স্নাইপার ব্যাটেলের পর শেষপর্যন্ত ভাসিলির জয় হয়। মেজর কনিগ ভাসিলির স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয়। সেই ব্যাটেলগুলো এতটাই থ্রিলিং যে মনে হতে পারে এক্ষুনি নিজের মাথায়ই গুলি লেগে গেল। আমার রেটিং ৮.০/১০। (IMDb-7.6) Trailer
The Great Raid: ২০০৫ সালে জেমস ফ্রাঙ্কো অভিনীত এই সিনেমাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের POW (Prisoner of War) ক্যাম্প নিয়ে। জন ডাল সিনেমাটি নির্মাণ করেন। এটি ‘Based on true story film’। যুদ্ধের সময় প্রায় ৫০০জন মার্কিন সৈন্য জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বলা হয়ে থাকে ইতিহাসে মার্কিন সেনাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়। আত্মসমর্পণকারী সেনাদেরকে POW ক্যাম্পে রাখা হয়। POW ক্যাম্পে মার্কিন সেনাদের ওপর যে নির্যাতন জাপানিরা করেন তা সিনেমাটিতে সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। একসময় মার্কিন সেনারা সেই প্রিজনারদের উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে পরে।
লে. কর্নেল মুচির নেতৃত্বে মার্কিন সেনারা POW ক্যাম্পটিতে উদ্ধার অভিযান চালায়। ফিলিপিনো গেরিলা যোদ্ধারাও এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। অভিযানের ফিল্ড কমান্ডার থাকেন ক্যাপ্টেন প্রিন্স। ক্যাপ্টেন প্রিন্স চরিত্রে অভিনয় করেন জেমস ফ্রাঙ্কো। তার অনবদ্য অভিনয় সত্যিই দেখার মত ছিল। যাহোক পরবর্তীতে মার্কিন সেনারা তাদের মেটদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দুঃখের বিষয় মার্কিন সেনারা জয় লাভ করলেও মার্কিন প্রযোজকরা জয় লাভ করতে পারেনি। সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিল। আমার রেটিং ৭.৫/১০। (IMDb-6.7) Trailer
আজ এপর্যন্তই। আরও কয়েকটি সিনেমার কথা লিখলে সত্যিই ভালো লাগত তবে তা একেবারেই পারছিনা। যেমন Braveheart, Kingdom of Heaven কিংবা Joan of Arc। কিন্তু অলসতা ইতিমধ্যেই আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। বলাই বাহুল্য অলসতার বিশ্বকাপ যদি হত তবে আমি চ্যাম্পিয়ন হতাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৪৬