ছোটবেলা থেকেই আমি শারীরিক ভাবে, গঠন গত দিক দিয়ে একটু দুর্বল প্রকৃতির ছিলাম।তবে মানসিক ভাবে কখনোই দুর্বল ছিলাম না,এখনো নেই এটা আমার ধারনা না আমার বিশ্বাস।ছোট বেলায় দাদু বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে যে হাসগুলো এক ঝাপটায় আমাকে পানিতে ফেলে দিয়েছিল অথবা ২০১১ এর আমার একটা সুন্দর সকাল কে মাটি করে দিয়ে এক দল দুর্বৃত্ত সাদা গাড়িতে চেপে এসে মুহূর্তেই এক ঝাপটায় আমাকে মৃত্যুর পথে ফেলে রেখে গিয়েছিল আমি পড়ে থাকিনি।ঠিক সেখান থেকে উঠে দাড়িয়েছি।।
আমি যখন দেখলাম আমার বাম হাতের কনুইর কাছে সাদা রঙের কি যেন কাঠির মতন বের হয়ে আছে নিজের চোখে সবকিছু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া দেখছিলাম।বুঝতে বাকি রইলনা রেডিও আলনা সব ভেঙ্গে একাকার। শরীর থেকে এত রক্ত কখন ঝরলো টের ও পেলাম না।রাস্তা লাল রঙের রক্তে রাঙ্গানো।আমার চারপাশে একদল মানুষ,পথচারী দাঁড়িয়ে আছে।যারা নানান কথায় মশগুল ,তাদের আমাকে ঘিরে কোন মতামত নেই।সাদা রঙের গাড়িটা কোন পথে এসেছে কয়জন ছিল এইসব বলাবলি করছে।আমি খুব বিরক্তই হচ্ছিলাম এইসব শুনে।আমার মনে হচ্ছিলো েই আলাপের চেয়ে বেশি জরুরী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার আলাপ,যা তারা কেউই করছেনা।আমার শরীর দুর্বল হচ্ছে ,হঠাৎ মনে হল আমি কি এখানেই মারা যাবো?? খুব ভয় হল আমার।আম্মুর কথা মনে হল খুব কান্না পেল।কি আশ্চর্য!! আমার চোখে কোন পানি নেই। মৃত্যু কেমন?? তাতো জানিনা ,বোকার মতন মনে হচ্ছিলো শরীর থেকে সব রক্ত এভাবেই বের হতে থাকলে পরে তো আর বাচবোনা,ফিরে এসে বলাও হবেনা মৃত্যু কেমন ছিল!!
যাইহোক মনে মনে ভাবলাম মাথা খাটাই,কি করবো কি করা যায়? বাঁচতে তো হবে কত কি দেখার বাকি।মনে হল আমার ভাইকে কল করি তখন মনে হচ্ছিলো ও আসলেই আমার আর কোন টেনশন নাই আমি ঠিক হয়ে যাবো।
একজন পথচারীকে বললাম
-ভাই একটা মোবাইল দেন কল করবো।
পথচারী নোকিয়া ১১০০ সেট তা এগিয়ে দিল।।
বাটন গুলো চাপতে কষ্ট হচ্ছে ।তারপর ও চোখ বন্ধ করে ভাইয়াকে ডায়াল করলাম। মেসেজ লিখতে লিখতে হাত পটু হয়ে গিয়েছিল। পরক্ষনেই মেজাজ খুব খারাপ হল শুনে-দুঃখিত আপনার মোবাইলে যথেষ্ট পরিমান টাকা না...।মোবাইল টা ফেরত দিলাম।(ইচ্ছে করছিল আছাড় দিয়ে ভাঙ্গি)শরীর নিস্তেজ হচ্ছে ক্রমশ আর ভয়টা আর ও বেশি করে ভর করছে।হঠাৎ দূত হয়ে একজন আমার জন্য সিএন জি ঠিক করল আমাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে।আমার একটু স্বস্থি লাগলো।সিএনজিতে উঠার সময় আমি বললাম এমন দুইজন উঠেন প্লিজ যার মোবাইলে ব্যালেন্স আছে আমার কথা গুলো জড়ানো ছিল তারপরও বোঝা যাচ্ছিল। কারন আমি জানি ভাইয়াকে এখনো কল করা হয়নি।আর আমার খুব ঘুম ঘুম লাগছে তার আগেই ভাইয়াকে কল দিতে হবে।কল দেয়া পর্যন্ত আমার কাজ।আমরা ভাইবোন সবাই রাত জাগা পাখি সকালের ঘুমটা আমাদের প্রিয় ভাইয়াকে কয়বার কল করে পাব তাই ভাবছিলাম। ভাইয়াকে দ্বিতীয়বার কল করে পেলাম, জানালাম আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে আমাকে পঙ্গু হস্পিটাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ।তারপর আমার মনের মানুষ টাকে জানালাম । তাদের আমার এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে কেমন লেগেছিল জানিনা তবে আমার খুব হালকা লাগছিল মনে হচ্ছিলো দায়িত্ব শেষ বাকিটা ওরা এসে করবে।তারা দুজনই কোন কথা বললনা। সেদিন বুঝলাম,প্রিয় মানুষের দুর্ঘটনা মানুষকে বোধ হয় এভাবেই বাক রুদ্ধ্ব করে দেয়। আমার হাতের সার্জারি হল।হাতে একটা পাত বসিয়ে দেয়া হল।তিন চারটা মাস আমি বিছানায় ছিলাম আমার বাম হাত অকেজো ছিল।কত অসহায় ই না ছিলাম। আম্মু খুব কান্না করতো যা আর ও বেশি খারাপ লাগাতো।ছোট বড় সব কাজের জন্যে পরনির্ভরশীল থাকতে হত যা আমার পছন্দ ছিলনা।ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম।ভাগ্যিস ল্যাব ছিল তখন সেমিস্টার ড্রপ দিতে হয়নি।সেমিষ্টার ড্রপ দিতে হলে বেশি কষ্ট হত। আমার বন্ধুরা এগিয়ে থাকতো তার জন্য নয় আমি পিছিয়ে যেতাম তার জন্য খারাপ লাগত।
আমার ছোট বেলার পড়ে যাওয়া নিয়ে কেউ হেসেছে কেউবা আদর করেছে।বড় বেলাতে কেউ সমবেদনা জানিয়েছে কেউ শুভকামনা জানিয়েছে।আমি সব কিছু গ্রহন করেছি স্বাভাবিক ভাবেই।ভালো লাগাগুলোকে সাদরে গ্রহন করেছি খারাপ লাগাকে প্রতিবাদ জানিয়েছি।আমার ছোট একটা প্রতিবাদ কোন আহামরি পরিবর্তন আনবে না জেনেও প্রতিবাদ করেছি পরিবর্তন হয়ত আশা করিনি কখনো তবে নিজের অবস্থান টা জানান দিয়েছি পরিবারের কাছে ,প্রিয় মানুষ, বন্ধু স্বজনদের কাছে।।যেখানে আমার প্রতিবাদের ভাষা ছিলনা চুপ থেকেছি যদিও এই কাজটা করতে আমার বেশি কষ্ট হত। প্রতি নিয়ত কিছু দুর্বৃত্ত প্রায়শই চেষ্টা চালিয়ে যায় আমাকে অসহায় করার, আমাকে দুর্বল করে দেবার তাদের আপ্রান চেষ্টা। ভয়ংকর আগ্রাসন!! হ্যা তাদের তোলপাড় দেখে আমি মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাই। ভাবি-এইবার কি তাহলে পতন হবে?? আর উঠে দাড়াতে পারবোনা??তারপর আবার সাহস যোগাই লড়ে যাবার শক্তি খুজে পাই।যত বড় হয়েছি,একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি, জানতে শিখেছি ,বিশ্বাস করি জীবনে চলার পথে ভাল মন্দ দুই থাকবে ভালটাকে বুঝতে হবে, নিজের মাঝে ধারন করতে হবে, চর্চা করতে হবে।আর মন্দটাকে সবসময় দূরে সরিয়ে রাখতে হবে কাছে আসতেই জং ধরে যাবে আর সেই জং ধরা জীবন নিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবেনা।কাছে আসতেই দেয়া যাবেনা।আবার কিছু সময় ক্লান্ত লাগে এত প্রতিকূলতা কেন??জীবনটা আরেকটু স্মুথ হলে কি ক্ষতি??আবার কিছু সময় মনে হয় এটাই তো জীবনের আসল মজা।প্রতিকূলতা পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর তৃপ্তি একজন বিজয়ী শুধু জানেন । যে জীবনে কোন চ্যালেঞ্জ নাই,লড়াই নাই সে জীবনের মজা কোথায়।আকাবাকা পথে অসীম সাহসে এগিয়ে যেতে হবে ,পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেতে হবে , রক্তাত্ত হতে হবে আবার উঠে দাড়াতে হবে, জীবনের পথ হবে বন্ধুর!!