somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্বাসরুদ্ধকর ছয়টি দিন

৩০ শে মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দগ্ধ তপ্ত বিকেল। ঘেমে ওঠা মানুষ যখন একটু প্রশান্তির আশায় চোখে মাখছে ঘরে ফেরার কাজল, ঠিক তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির মতো মেঘনা গুহঠাকুরতার মুখোমুখি হলাম আমরা। অনেক অনেক পেছনে ফেলে আসা অতীতের ধূসর পাতা উল্টে শ্বাসরুদ্ধকর বিশেষ ছয়টি দিনের অভিজ্ঞতার বয়ান তুলে ধরার অনুরোধ জ্ঞাপন করলাম তাঁর কাছে।
তিনি বিপন্ন বোধ করলেন। তবু সজল দুচোখ শূণ্যে স্থাপন করে উচ্চারণ করলেন কিছু বিষণ্ন বাক্য। জানালেন, ‘আমি মেঘনা গুহঠাকুরতা। ডাক নাম দোলা। ১৯৭১ সালে চতুর্দশবর্ষীয়া আমি। দশম শ্রেণীতে পড়তাম।
বাবা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন, সেই সুবাদে থাকতাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত শিক্ষক-নিবাসের নিচতলায়। মা বাসন্তী গুহঠাকুরতা ছিলেন গেন্ডারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
আমরা তিনজন ছাড়াও আরো দুজন মানুষের অপরিহার্য উপস্থিতি ছিল সংসারে। স্বর্ণ মাসি এবং আমাদের বিশ্বস্ত গাড়িচালক গোপাল দে। এই পাঁচজন মানুষের আন্তরিক সহাবস্থানে বেশ শান্তিতেই কাটছিল আমাদের দিনগুলো। তবে সেই শান্তির স্থায়িত্ব ছিল ২৫ মার্চ রাত বারোটা অবধি।
তারপরই সমূলে বিনষ্ট হলো শান্তির সুললিত আবহ। বোধবুদ্ধির অতীত এক নারকীয়তা নিয়ে আমাদের ঘরে প্রবেশ করল পাকিস্তানি সেনারা। শুরু হলো আমার জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর ছয়টি দিন।

২৫ মার্চ:
প্রফেসর সাহাব কাহা হ্যায়?
ঘরে ঢুকেই বাবাকে খুঁজলো পাকিস্তানি সেনারা।
মা বলল, কেন, কি ব্যাপার?
অফিসার জবাব দিল, প্রফেসর সাহাবকো হামারা লে যায়েঙ্গে।
মা বলল, তাঁকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে?
মায়ের এই জিজ্ঞাসার কোন জবাব দিল না পাকিস্তানি সেনারা।
বাবা পাশের ঘরে ছিলেন। পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে বাবা এগিয়ে গেলেন তাদের সামনে। তখন অফিসার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?
বাবা বলল, ইয়েস।
ইয়াকুব!অফিসারের আহ্বান!
একজন বাঙালি লোক এগিয়ে এলো সামনে। ক্রুর চোখ তার। অফিসার জানতে চাইলো, বাত সাচ হ্যায়?
ইয়াকুব মাথা ঝাঁকিয়ে নিশ্চিত করলো অফিসারকে।
আউর কই যোয়ান আদমি হ্যায়?
মা বলল, হামারা একই লাড়কি হ্যায়।
ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, লাড়কি কো কোউন ডর নেহি।
অফিসার এবার বাবাকে বলল, আপকো হাম লে যায়েঙ্গে।
বাবা বলল, হোয়াই?
এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনে বাগানে। বাবাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পরপর দুটো গুলি করল তারা। একটা গুলি বাবার ঘাড়ের পাশে লাগল, আরেকটা গুলি লাগল কোমরে। বাবা আর্তচিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে মৃত ভেবে চলে যেতেই আমরা ছুটে গেলাম তাঁর কাছে। দেখলাম, বাবা বেঁচে আছেন তখনও। আমরা তাঁকে ধরাধরি করে ভেতরে আনলাম। লুকিয়ে রাখলাম ঘরের পেছনের বারান্দায়। ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বাবার তখন। অবিলম্বে চিকিৎসা দরকার তাঁর। কিন্তু বাইরে কারফিউ। উদ্বিগ্নতায়, উৎকণ্ঠায় কেটে গেল পঁচিশের রাত। সকালের আলো ফুটল আকাশে।

২৬ মার্চ:
সারাদিন বলবৎ রইল কারফিউ। অর্ধমৃত অবস্থায় পেছনের বারান্দায় পড়ে রইলেন বাবা। তেমন কিছু খেতে পারলেন না তিনি। কেবল তরল খাবার খেলেন খানিকটা। চিকিৎসা প্রয়োজন তাঁর দ্রুত। আমাদের বাসার এত কাছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল! অথচ এটুকু পথ অতিক্রম করে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাবার সাধ্য নেই আমাদের!
কি অসহ্য, কি অবর্ণনীয় এই অক্ষমতা!

২৭ মার্চ:
কারফিউ তুলে নেওয়া হল সকালে। অপরিচিত কয়েকজন মানুষের সাহায্যে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম আমরা। প্রথমেই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। চিকিৎসার তেমন কোন ব্যবস্থা হল না সেখানে। দুপুরের দিকে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলো ওয়ার্ডে। বেড দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন, ব্লাড প্রেশার মাপলেন, স্যালাইন দিলেন, দিলেন অক্সিজেনও। রাতে কারফিউর মধ্যে আবার শুরু হলো ভয়ংকর গোলাগুলি।

২৮ মার্চ:
সকালে কারফিউ উঠে গেলে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবরা বাবার সাথে দেখা করতে এলেন। সস্ত্রীক এলেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল গনি হাজারী। তাঁরা তখন থাকতেন ইন্দিরা রোডে। বাবাকে দেখে বাড়ি ফেরার সময় আমাকে তাঁরা সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন।
আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই রাজী হলেন মা। আমি বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়না হলাম আবদুল গনি হাজারীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

২৯ মার্চ:
হাসপাতালে ফিরেই দেখলাম বাবা অচেতনপ্রায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে শরীর নিস্তেজ স্বাভাবিকভাবেই। ডাক্তার স্যালাইন দিয়ে রক্তপ্রবাহ সচল রেখেছেন কোনক্রমে।

৩০ মার্চ:
আমার ঘুম ভাঙ্গলো আবদুল গনি হাজারীর বাড়িতে। আরো একটি বিষণ্ন দিন শুরু হলো। আমি তৈরী হলাম হাসপাতালে ফেরার জন্য। রাস্তার ঝক্কি-ঝামেলা এড়িয়ে বেলা সাড়ে দশটার দিকে যখন পৌঁছলাম হাসপাতালে, তখন সব শেষ! পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমার বাবা পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
আমি কাঁদলাম, সত্তার সবচাইতে অনুভূতিপ্রবণ অংশ উজার করে কাঁদলাম, যদিও সেই কান্না বাবাকে আর ফিরিয়ে দিল না আমার কাছে!’




ছবি: উপরেরটি (জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার পারিবারিক ছবি) সংগৃহীত

ছবি: নিচেরটি (মেঘনা গুহঠাকুরতা) নিজ সংগ্রহ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৩
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×