বাটা সিগন্যাল থেকে নিউমার্কেটের দিকে চলে যাওয়া পথ ধরে খানিকটা এগোলেই সুপরিচিত সুপরিসর একটি বিপণী বিতান। বিপণী বিতানটির ঠিক উল্টোদিকেই একটা অন্ধগলি। গলিটির শেষমাথায় একটি বাড়ি। বাড়িটির নাম ‘কণিকা’- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মৃতিবিজড়িত বাসগৃহ।
শনিবার। মধ্যাহ্ণের ঠিক পরপরই আমাদের রিকশাটা এসে থামলো শহীদ জননীর স্মৃতিবিজড়িত বাসগৃহের সামনে। রিকশা থেকে নামলাম আমরা। ‘কণিকা’ নামের বাড়িটি এখন রূপান্তরিত হয়েছে একটি বহুতল ভবনে। সেই ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।’
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর পারিবারিক জীবনের সস্নিগ্ধ স্মৃতিগাথা, সাহিত্য জীবনের সুললিত চিহ্ন এবং আন্দোলন-সংগ্রাম মুখর জীবনের স্মারক সৌন্দর্যে ভাস্বর এই জাদুঘর, অনন্য এই স্মৃতিপ্রান্তর পরিভ্রমণের শুরুতেই আমরা থমকে দাঁড়াই যে অংশটিতে, সেখানে দেয়ালাকৃতির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা জাহানারা ইমামের পারিবারিক নানা ছবি।
ছবিগুলো কি বিভাজিত কোন পর্বাকারে?
জানতে চাইলে হ্যাঁ-বোধক জবাব দেন জাদুঘরের প্রতিনিধি। তিনি জানান, একেবারে উপরে কচি কলাপাতার মতো সবুজ রংয়ের পশ্চাৎপটে রাখা ছবিগুলো ধারণ করে আছে শহীদ জননীর শৈশব কৈশোর এবং তার পরবর্তীকালীন কিছু স্মৃতি।
জাহানারা ইমামের জন্ম ৩ মে, ১৯২৯, মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিসেবে বেড়ে উঠলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা সৈয়দ আব্দুল আলী এবং মা হামিদা বেগমের প্রেরণায় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে- তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ অন্যজীবন এর পাতায় পাতায় এসব কথার অনেকটাই উঠে এসেছে ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারণের এক অতিদুর্লভ আটপৌরে ভঙ্গীতে।
তারপর ঘন সবুজ পশ্চাৎপটে স্থাপিত ছবিগুলো জাহানারা ইমামের পত্রপল্লবে পূর্ণবিকশিত জীবনকালের, যখন তিনি রংপুর ছেড়ে উচ্চশিক্ষালাভার্থে কলকাতা গমন করলেন, পাশ করলেন বি.এ., পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন প্রকৌশলী শরীফ ইমামের সাথে, কর্মজীবনে করলেন প্রবেশ, একসময় জননী হলেন শাফী ইমাম রুমী এবং সাইফ ইমাম জামীর- এভাবেই সুখ-আনন্দে কেটে যাওয়া সময়গুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অতিবাহিত হলো ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০। এরপর ১৯৭১- কৃষ্ণযবনিকা নেমে এলো জননী জাহানারা ইমামের জীবনে।
স্বাধীনতার সূর্যরশ্মির অবাধ বিচ্ছুরণ নিশ্চিত করতেই শহীদ হলেন রুমী, পাক হানাদারদের নির্মম অত্যাচার-অপমানের গ্লানি আর পুত্রশোকের ভয়াবহ আঘাতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবার মাত্র তিন দিন আগে মৃত্যুবরণ করলেন তাঁর স্বামী। এই পর্যায়ের ছবিগুলোর পশ্চাৎপট শোকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থাৎ কালো।
শোকের পর স্বাভাবিকভাবেই বেদনা। তাই এই পর্যায়ের ছবিগুলোর পশ্চাৎপট নীল। বেদনা পরবর্তী ছবিগুলোর পশ্চাৎপটে একটু উষ্ণ বর্ণ, মানে কমলা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এরই মধ্যে শোক বেদনা অনেকটাই সামলে উঠেছেন মা জাহানারা ইমাম। ছোট পুত্র, পুত্রবধূ ফ্রিডা আর দুই নাতনী লিয়ানা ও লিনিয়ার ভালবাসা আঁকড়ে ধরে উঠে তিনি দাঁড়িয়েছেন আবার। শোক-বেদনাকে রূপান্তরিত করেছেন শাণিত শক্তিতে। মন দিয়েছেন সাহিত্যচর্চায়। অসাধারণ নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশভঙ্গীতে একাত্তরের দিনগুলোর মতো রক্তাক্ত ব্যাক্তি অভিজ্ঞতা বর্ণনায় আপ্লুত করেছেন সাধারণ মানুষকে, স্বপ্রণোদনায় পূর্ববর্তী কথার সাথে এই কথাগুলোও যোগ করলেন জাদুঘরের প্রতিনিধি।
পুরো জাদুঘরে রক্ষিত অসংখ্য স্মারক যেন বহন করছে সেই সব সময়েরই স্মৃতি। জাহানারা ইমামের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, তৈজস, হাজার রকম দলিল-দস্তাবেজ, চিঠি, লেখার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী বেদনাদ্র মন নিয়ে ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় এসে দাঁড়ালাম একচিলতে বারান্দায়। সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল ১৯৮১ সালের কথা, যখন ক্যান্সারের সাথে বসবাস করছেন জাহানারা ইমাম। অফুরান জীবনীশক্তির প্রায় পুরোটাই তখন অধিকৃত সেই মরণ ব্যাধিতে। কিন্তু কোন কোন মানুষ যে তাঁর মস্তিষ্কের মনিকোঠায়, তাঁর অবিনশ্বর চেতনায় সঞ্চয় করে রাখেন জীবনীশক্তির চাইতে আরো মহাশক্তিধর প্রাণসত্ত্বাকে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল বাঙালি জাতির বৃহত্তর এক প্রয়োজনের মুহূর্তে-
একাত্তরের ঘাতক দালালদের যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবীতে সোচ্চার হলেন জাহানারা ইমাম। চরম শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে অনিবার্য এক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। একাত্তরের পর সত্যিকার অর্থেই আবার উত্তাল হলো দেশ। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গঠিত হল গণআদালত। গণমানুষের সেই আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘোষিত হলো মৃত্যদণ্ডাদেশের ঐতিহাসিক রায়। এবার আর জাহানারা ইমামের মাতৃত্ব তাঁর পারিবারিক গণ্ডীর একক পরিসরে সীমাবদ্ধ রইলো না; গণআন্দোলনের নেতৃত্ব তাঁর মাতৃত্বকে পৌঁছে দিলো বহুত্বের পরিসীমায়-
জাহানারা ইমাম আজ নেই, কিন্তু তাঁর শুরু করা কাজ কি শেষ হয়েছে এখনও? না। দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে বারান্দা থেকে ফিরে এলাম আমরা। দাঁড়ালাম শহীদ জননীর আন্দোলন-সংগ্রাম মুখর জীবনের স্মারকচিহ্নগুলোর সামনে। চোখ রাখলাম হাসপাতালের মৃত্যুশয্যা থেকে সহযোদ্ধা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে শহীদ জননীর নিজ হাতে লেখা চিঠিটির শেষ চরণদুটিতে, যেখানে স্পষ্টাক্ষরে বিবৃত- "একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের- বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।"
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:২৮