মাত্র কয়েকদিন আগে। রাজনের মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়েছি আমরা। শোকাহত। বিবেকের দংশনে জর্জরিত। প্রতিবাদে মুখর ছিলো প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও ছিলো প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল। নিন্দিত শব্দাবলীতে উচ্চকিত। এবং আমিও। হ্যাঁ, আমার মতো নগন্য একজন মানুষও ছিলো সেই শোকার্ত সময়ে অভিযোজিত, অভিনিবিষ্ট স্ব-মনে, স্ব-শরীরে।
রাজন। রাজন।
কিন্তু কেন রাজন? রাজনের মৃত্যুর মতো এমন অমানবিক, এমন পাশবিক, এমন লোমহর্ষক ঘটনা কি ভীষণ নতুন ছিলো আমাদের দেশে? এ ধরনের শিশু মৃত্যুর ঘটনা কি ছিলো ভীষণ দুর্লভ? না-তো!! দুর্লভ নয় কোনভাবেই। রাজনের মৃত্যুর মতো অথবা রাজনের মৃত্যুও চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কজনক, ভয়াবহ অনেক মৃত্যুর সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরিচয় ঘটতে পারে আমাদের যদি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করি অত্যন্ত নিকট অতীতে।
খুব বেশি উদাহরণ বিরক্তির কারণ হতে পারে, তাই শুধু শিশু হারুনের কথা বলি।
দুটি কিডনিই কেটে নেয়ার পর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ছয় বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে কিডনি পাচারকারী সন্দেহে খলিল (২২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কোহিনুর আরজুমানের আদালতে খলিল স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দিয়েছেন।
মৃত হারুন (৬) সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার উধুনিয়া ইউনিয়নের তেবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হান্নানের ছেলে।
উল্লাপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল জলিল জানান, গত ২২ এপ্রিল বিকালে শিশু হারুন নিখোঁজ হয়। ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় পার্শবর্তী ফইলার বিলের একটি ডোবায় কচুরীপানার নিচে তার ‘কিডনিবিহীন’ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় হারুনের বাবা আব্দুল হান্নান একই গ্রামের তিন জনকে সন্দেহজাজন আসামি করে থানায় মামলা করেন।
রোববার (২৭ এপ্রিল) রাতে ‘পালিয়ে যাওয়ার সময়’ উপজেলার সীমান্তবর্তী কালিয়াকৈর এলাকা থেকে খলিলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার আদালতে হাজির করলে খলিল স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দেন। এরপর তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। খলিল উল্লাপাড়ার উধুনিয়া ইউনিয়নের তরফবাড়িয়া গ্রামের কালু প্রমানিকের ছেলে।
এ মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান এসআই জলিল।
আদালতে জবানবন্দি প্রদান শেষে খলিল সাংবাদিকদের জানান, ঢাকার সাভারের একটি চক্রের কাছে শিশু ‘হারুনের কিডনি’ বিক্রির জন্য তরফবাড়িয়া গ্রামের বেলাল হোসেনের ছেলে চাদ আলী (২৫), মন্টু প্রমানিকের ছেলে মতিন (৩০) ও দুলালের ছেলে দেলোয়ার ১০ লাখ টাকায় একটি চুক্তি করে।
এরপর তারা হারুনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। এজন্য কয়েকদিন ধরে তারা হারুনকে নানা খাদ্যদ্রব্য কিনে দিয়ে মন ভোলায়।
খলিল জানান, গত ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাড়ির পাশ থেকে অজ্ঞান করে বস্তায় ভরে হারুনকে নিয়ে যায় চাদ, মন্টু ও দেলোয়ার। এরপর বিষয়টি তারা খলিলকে জানায়।
ওইদিনই রাত ২টার দিকে উধুনিয়া ব্রিজের নিচে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার পর খলিল দেখেন সেখানে আগে থেকেই আরো তিন জন অপেক্ষা করছিল, যারা ঢাকার সাভার থেকে আসে।
এদের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিল বলেও খলিল জানান।
খলিল বলেন, সবাই সেখানে পৌঁছানোর পর ব্রিজের নিচে শিশুটির দুইটি কিডনি কেটে নিয়ে স্যালাইনের প্যাকেটে ভরে সাভার থেকে আসা তিন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
খলিলকে দুই লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও শেষে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিতে চাইলেও তিনি নেননি বলে জানান। পরে শিশুটির লাশ আবার বস্তায় তুলে ফইলার বিলের কচুরীপানার নিচে ফেলে রাখেন। (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৯ এপ্রিল, ২০১৪)
দুঃখিত। কোন ভিডিও ফুটেজ নেই ঘটনাটির। গতবছরের ঘটনা। এমন আরো কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনার কথা তথ্যপ্রমাণসহ উল্লেখ করা যায়, তবে দুঃখিত পুনরায়, কারণ, কোন ভিডিও ফুটেজ নেই সেগুলোর।
আবার উল্লেখ করতেই হচ্ছে, রাজনের মৃত্যুর মতো অথবা রাজনের মৃত্যুও চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কজনক, ভয়াবহ অনেক মৃত্যুর ঘটনা দুর্লভ নয় আমাদের দেশে। দুর্লভ ভিডিও ফুটেজ। যেটি রাজনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে আমাদের। এবং রাজনের সৌভাগ্য(!) যে, দুর্লভ একটি ভিডিও ফুটেজ প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বিবেক, যেটি অন্যদের ক্ষেত্রে হয়নি!!
এবার সাম্প্রতিক সময়। দুঃখিত। তবে যে কথা না বললেই নয়। রাজনের পরিবর্তে এবার রাকিবের কথা বলি।
সিলেটের রাজন হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের মধ্যে খুলনায় নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে ১২ বছরের একটি শিশুকে।
সোমবার রাতে নগরীর টুটপাড়া এলাকায় একটি মোটর গ্যারেজে মলদ্বারে পাইপের মাধ্যমে হাওয়া ঢুকিয়ে মো. রাকিব নামে ওই শিশুকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্থানীয়রা গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া (৪০) ও কর্মচারী শরীফ (৩৫) এবং তার মা বিউটি বেগমকে (৫৫) পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।
রাকিব টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের মো. আলমের ছেলে। সে টুটপাড়া কবরস্থানের কাছে মিন্টু মিয়ার মোটর সাইকেল গ্যারেজ ‘রোজ ব্যাটারিতে’ কাজ করত।
কিছু দিন আগে সে ওই গ্যারেজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ের আরেকটি গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানায়।
খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, কাজ ছেড়ে দেওয়ায় রাকিবের উপর ক্ষুব্ধ ছিল মিন্টু মিয়া।
“রাতে মিন্টুর গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় সে। একপর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে।”
তখন রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে মিন্টু ও তার কর্মচারী শরীফ পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করায় বলে পুলিশ জানায়।
সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর পরপরই রাকিব মারা যায়।
চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি সুকুমার বলেন, “রাকিবের শরীরের অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যায়। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে সে মারা যায়।”
রাকিবের লাশ ময়না তদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার তার ময়নাতদন্ত করা হবে।
গণপিটুনির শিকার মিন্টু মিয়া ও শরীফকে পুলিশ পাহারায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নির্যাতনের সময় বিউটি বেগম উপস্থিত থাকলেও তিনি শিশুটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি বলে জানান খুলনা সদর থানার ওসি। (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৪ অগাস্ট, ২০১৫)
দুঃখিত পুনরায়। কোন ভিডিও ফুটেজ নেই এই ঘটনাটিরও। সুতরাং রাকিবের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেক নড়বে কতটুকু তা নির্ধারণ করবে সময় আশাকরি।
তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চোখ কান একটু খোলা রাখলেই আমরা হয়তো আরো অসংখ্য রাজন, হারুন কিংবা রাকিবকে আবিস্কার করতে পারি আমাদের চারপাশে। এবং আরো অসংখ্য রাজন, হারুন কিংবা রাকিবকে জীবিতাবস্থায় আমরা আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার অংশ করতে পারি সহজেই, যারা অমানবিক অবস্থিতি বজায় রেখে ঝুলছে জীবন-মৃত্যুর সুক্ষ্ম সুতোয় এবং যাদের নৃশংস অকালমৃত্যু নিকট ভবিষ্যতে অবধারিত এবং এমন অনেক শিশুমৃত্যুর মঞ্চ প্রস্তুত আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দেবার জন্য, আরো অনেক বর্বর শিশুমৃত্যু অপেক্ষমান আমাদের অনিবার্য শোক-সন্তাপের উপলক্ষ্য হবার জন্য।
আপাতত রাকিবের জন্য শোক প্রকাশ করি আমরা।
ছবি: সংগৃহীত
সংযুক্তি (১): ঢাকা মেডিকেলের সামনে স্যুটকেসে শিশুর লাশ
সংযুক্তি (২): এবার চোখ উপড়ে শিশুকে হত্যা!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৫৬