এই ঘটনাটি ঘটেছিলো আমার দশম শ্রেণীর শুরুর দিকে: আমার ঘনিষ্ঠ ক্লাশমেট, মেশকাত ইলেকটিভ ম্যাথে একটু কাঁচা ছিলো; সে আমার দলে ফুটবল খেলতো; তাই, তাকে অংকে সাহায্য করতে হতো মাঝে মাঝে। আমি ফুটবল খেলে, সন্ধ্যার পর বাড়ীতে ফিরতাম, খেয়েদেয়ে পড়তে বসলে ঘুম এসে যেতো, আমি ঘুমিয়ে পড়তাম; রাত ১০টা, ১১টার দিকে ঘুম ভাংতো, উঠে ঘন্টা'খানেক পড়ে আবার ঘুম। সপ্তাহে দু'এক রাতে মেশকাতকে পড়াতে যেতাম; আমাদের বাড়ী থেকে দেড় মাইল দুরে ওদের বাড়ী; রাত ১১টার দিকে রওয়ানা হতাম, এক দৌড়ে দেড় মাইল, ১৫ মিনিটের মত সময় লাগতো; রাত বারোটার দিকে আরেকবার দৌড় দিতাম আমাদের বাড়ীর দিকে। সারা গ্রাম ঘুমে, পথে মোটামুটি মানুষজন থাকতো না, শিয়াল মিয়াল সামনে পড়তো।
ওদের গ্রাম ও আমাদের পাড়ার মাঝখানে একটি হিন্দুপাড়া ছিল; রাস্তাটি একটি কালী মন্দিরের সামনে দিয়ে গিয়েছে; কালী মন্দিরটি একটি আদি বটগাছের নীচে, চাঁদনী রাতেও যায়গাটা কিছুটা অন্ধকার হয়ে থাকতো। দক্ষিণ দিকের বাড়ীগুলো মন্দির থেকে একটু দুরে ছিলো; মন্দিরের উত্তর পাশে একটি দরিদ্র বাড়ী ছিল, মন্ডল বাড়ী।
এক রাতে মেশকাতকে পড়ায়ে বাড়ী ফিরছি, তখন কালবোশেখীর সময়, পথে বের হওয়ার পর ঝড় শুরু হলো, বিদ্যূত চমকাচ্ছে ঘনঘন; আমি দৌড়াচ্ছি; আমি কালীঘরের কাছাকাছি আসতে বৃষ্টি শুরু হলো; কালীঘরের বারান্দায় উঠার জন্য বেগ বাড়িয়ে দিলাম। কালীঘরের কাছে আসতে, বিজলীর আলোতে আমি কালীঘরের বারান্দায় ১ জন মানুষকে দেখলাম; আমি বারান্দায় উঠার সময় মানুষটি মুল ঘরের ভেতরে চলে গেলো, এলাকাটি বেশ অন্ধকার। আমি প্রশ্ন করলাম,
-ঘরে কে?
-বাবা, আমি গোপালের মা।
গোপাল হলো মন্দিরের উত্তর পাশের বাড়ী, মন্ডল বাড়ীর ছেলে, ৮/৯ বছর বয়স হবে; বছর খানেক আগে ওর বাবা, দুলাল মন্ডলের মৃত্যু হয়েছে; ওরা খুবই গরীব; গোপাল জেঠাদের গরু ছাগল দেখে, স্কুলে যায় না। গোপালের মা বিধবা হওয়ার পর রাস্তাঘাটে তেমন বের হন না আর; আগে মাঝেমাঝে গ্রামের রাস্তা দিয়ে অন্য বাড়ীতে যেতে দেখতাম। সামনাসামনি পড়লে নমস্কার বলতাম।
-কাকিমা তুমি পুজা দিতে এসেছ?
-না, বাবা আমরা গরীব মানুষ, কেহ কালীভোগ দিয়েছে কিনা, দেখতে এসেছি!
অনেক কষ্ট পেলাম মনে; কালীভোগ মানে, মানুষ কিছু মানত করে, সাদা ভাত ও পুরো একটি গজার মাছকে ভাজি করে, কালী মায়ে'র উদ্দেশ্যে মাঝরাতে এখানে রেখে যায়; আগে, মানুষ বটের মুলে রেখে যেতো; শিয়াল কুকুর খেয়ে ফেলতো; আজকাল, কালীঘরের বারান্দায় একটা তাকের মতো করে দিয়েছে, ওখানে রেখে যায়; কেহ চাইলে খেতে পারে, অনেকে ভয়ে খেতো না, হাজার হলেও কালীভোগ!
মনে এত কষ্ট পেলাম যে, ইচ্ছে হলো ভিজে ভিজে রওয়ানা দিতে; আমি বললাম,
-কাকিমা, আমি চলে যাচ্ছি; আগামীকাল পুকুর থেকে একটা বড় মাছ ধরে, গোপালের জন্য পাঠাবো; তুমি ওকে রান্না করে দিয়ো।
-না বাবা, পাঠাইও না; গোপালের জেঠা পছন্দ করবেন না, উনি মনে করবেন যে, আমি ভিক্ষা করছি!
-কাকীমা, জগৎ কাকু (গোপালের জেঠা ) আমাদের ঘরের কাজ করেন প্রতি বছর; আমার মা পাঠালে উনি কিছু মনে করবেন না; আমাদের বুড়ো মিয়া এসে দিয়ে যাবেন; বুড়োমিয়ার সাথে জগৎ কাকুর সদ্ভাব আছে; জগৎ কাকুর জন্যও পাঠাবো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:১৬