মিশরের বহিস্কৃত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোরসীর(১৯৫১-২০১৯) মৃত্যু নিয়ে বাংগালীরা বিভক্ত কেন? এই ব্যাপারটা নিয়ে বাংগালীরা একমত পোষণ করলে কেমন হতো? মিশরীয়রা অনেকটা বাংগালীদের মতো ঐক্যহীন জাতি, তাদের মাঝে বড় ৩টি ভাগ আছে: (১) আরব জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয়রা, এরা আরব ব্রাদারহুড ও কয়েকটি দলে আছে (২) আমেরিকানপন্হী, সৈন্যবাহিনী ও ধনীক শ্রেণী, এরা শিক্ষিত, ব্যবসা বাণিজ্য এদের হাতে (৩) সন্মিলিত আরব ঐক্যের পক্ষের সাধারণ মানুষ: এরা জামাল নাসেরের ( প্রেসিডেন্ট, ১৯৫৬ -১৯৭০) আদর্শে বিশ্বাসী, সন্মিলিত আরব ঐক্যে বিশ্বাসী; এদেরকে অনেকে 'বাম' বলে; আসলে, এরা বাম নয়, জামাল নাসেরের সময়, প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়ন মিশরকে বড় আকারে সাহায্য করে: নীল নদীতে বাঁধ দেয়, উহার নাম "আসোয়ান বাঁধ"; এই বাঁধের ফলে মিশরে সেঁচ ও বিদ্যূৎ উদপাদনের ব্যবস্হা হয়; এই সময়ে মিশরের বড় অংশ জনতা জামাল নাসের ও সোভিয়েতের নীতিকে পছন্দ করে। কিন্তু ধর্মীয়রা সোভিয়েতের এই সাহায্য পছন্দ করেনি; কারণ, সোভিয়েতের লোকজন ধর্ম মানতো না। জামাল নাসের অনেকটা শেখ মুজিবের মতো জনপ্রিয় ছিলেন। নাসের ইসরায়েল বিরোধী ছিলেন ও ইসরায়েলের বিপক্ষে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছিলেন।
নাসের একেতো ইসরায়েল বিরোধী যুদ্ধে পরাজিত, আবার সোভিয়েতকে নিয়ে দেশ গড়ছে, আমেরিকা এটি পছন্দ করেনি; আমেরিকা নাসেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মিশরের সামরিক বাহিনীকে ও ধর্মীয়দের ব্যবহার করে। এই সময় ব্রাদাহুড জাতীয় আরবেরা আমেরিকার পক্ষে ছিলো। নাসেরের পর মিসর আসলে সৈন্য বাহিনীর হাতে চলে যায়; সৈন্য বাহিনীর মুখপাত্র হিসেবে আনোয়ার সা'দাত(প্রেসিডেন্ট, ১৯৭০-১৯৮১) ক্ষমতায় আসেন। তিনি বুঝলেন যে, আরবেরা ইসরায়েল ও আমেরিকার মিলিত শক্তির সাথে পেরে উঠবেন না। মিশরের কিছু অংশ ইসরায়েল দখল করে রেখেছিলো, উহার মাঝে ছিল সুয়েজ খাল; সুয়েজ খাল ছিলো মিশরের আয়ের সবচেয়ে বড় পথ। আনোয়ার সা'দাত আমেরিকান নেতৃত্বে ইসরায়েল'এর সাথে চুক্তি করেন; তিনি সুয়েজ খাল ফেরত পান ও আমেরিকান ক্যাশ পেতে থাকেন।
সেনাবাহিনীতে অবস্হিত ধর্মীয় ও ইসরায়েল বিরোধীরা আনোয়ার সা'দাতের আমেরিকা ও ইসরায়েল প্রীতি পছন্দ করেনি, তারা উনাকে হত্যা করে; উনার উত্তরসুরী হয়ে আসেন হোসনী মোবারক(প্রেসিডেন্ট, ১৯৮১-২০১১)। আনোয়ার সা'দাত কিন্তু জামাল নাসেরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন; এতে করে, কিছুটা দেশ প্রেম ছিলো উনার মাঝে; কিন্তু হোসনী মোবারক আসলে মিলিটারী শাসনের লোক ছিলেন ও আমেরিকার গৃহপালিত রাজনীতিবিদ ছিলেন। ২০১১ সালে, তিউনিশয়া থেকে উদ্ভুত "আরব বসন্তে" উনি কুপোকাত হন। হোসনী মোবারকের সাথে সেনাবাহিনীও পরাজিত হয়। বিপ্লবে মিশরের সাধরণ মানুষই বেশী ছিলেন, নাসের পন্হীরা বড় ভুমিকা পালন করেছিলো; বিপ্লবে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারান, ইহাতে মোরসীর লোকজন বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা সেনা বাহিনীর বিপক্ষ অস্ত্র নিয়ে লড়ে; সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র ছিলো না; এদের হাতে অস্ত্র ছিলো; বিপ্লব পরবর্তী ভোটে এরাই জয়ী হয়ে যায়।
ড: মোরসী প্রেসিডেন্ট(জুন, ২০১২- জুলাই, ২০১৩) নির্বাচিত হয়; সেনা বাহিনী এতে খুশী ছিলো না; মিশরের সেনাবাহিনী মোটামুটি দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ: তাদের শিল্প কারখানা আছে, ব্যবসা বাণিজ্য আছে, স্কুল কলেজ আছে, আবাসিক এলাকা আছে, জায়গা জমি আছে। তারা ড: মোরসীকে সরানোর সুযোগ খুঁজছিলো ; সুযোগটা মোরসীই করে দিলো। নির্বাচনের পর, মানুষ 'নতুন সংবিধান' চাচ্চিল; মোরসী নতুন সংবিধান রচনার দাবী মেনে নেন, ১ বছর লাগবে সংবিধান তৈরি করতে। তিনি ও মানুষ জানতেন যে, ব্রাদারহুডের এমপি'রা নতুন কি ধরণের সংবিধান রচনা করবেন। এই মধ্যকালীন ১ বছর দেশ কিভাবে চলবে? দেশ চলবে 'প্রেসিডেন্ট ডিক্রিতে'; মোরসী এই ১ বছর ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে দেশ চালনা করার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন; নাসের পন্হীরা মোরসীর বিপক্ষে ফেটে পড়েন; সেনাবাহিনী এই সুযোগ খুঁজছিলো; তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়।
এরপর, মোরসীর লোকেরা মিলিটারীর বিপক্ষে অস্ত্রহাতে নেমে পড়ে; প্রচুর মানুষ প্রাণ হারায়; বিপুল পরিমাণ মানুষ গ্রেফতার হয়; মোরসীর বিচার চলছিলো; আদালতে হার্ট এ্যটাকে উনার মৃত্যু হয়েছে গতকাল; ৩/৪ টা পোষ্ট এসেছে ব্লগে, ব্লগারেরা উনার ভুমিকা নিয়ে বিভক্ত: কেহ বলছেন যে, ফেরাউনদের হাতে উনার মৃত্যু হয়েছে; অন্যেরা বলছেন, ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৯ রাত ১১:০৭