পাঁচ হাজার বছরের দালিলিক (Recorded) ইতিহাসসমৃদ্ধ সভ্যতার ঐতিহ্যবাহী গাঙ্গেয় নিম্ন অববাহিকা আমাদের বঙ্গ ভূখন্ড, অধুনা স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ। ভারত, বার্মা আর বঙ্গোপসাগরের বেষ্টনে লাল-সবুজের স্বাধীন-সার্বভৌম এই বাংলাদেশের সপ্রতিভ অবস্থান। যুগে যুগে যোজন যোজন দূর থেকে আগত মনীষীরা পাগল হয়েছেন এর প্রকৃতির প্রেমে, পাগল হয়েছেন নৃতাত্ত্বিকরা এর বৈচিত্র্যময় বিন্যাসে। অন্যদিকে এর সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনায় লালায়িত হয়েছে লোভীরা, লুন্ঠনে লুন্ঠনে জর্জর করেছে অসংখ্যবার।
যখন নিতান্তই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তখনই প্রতিবাদী হয়েছে এদশের সহজ সরল মানুষ, অসীম ত্যাগের বিনিময়ে জন্ম দিয়েছে এক একটি মহাকাব্যের। পৃথিবীর ইতিহাসগ্রন্থে স্বর্ণের হরফে লেখা তেমনি এক মহাকাব্যের নাম ১৯৭১র মুক্তিযুদ্ধ। মহান সেই যুদ্ধে এদেশের মানুষ তাদের রক্তের নদী বেয়ে নিয়ে এসেছে স্বাধীনতার সাম্পান। আর এত অল্প সময়ে এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছিল সেই সংগ্রামে দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পৃক্ততার কারনেই। সম্পৃক্ততা ছিল এদেশের বাঙালি ভিন্ন আরও অর্ধশত জনগোষ্ঠীর, যারা আমাদের মূলস্রোতেরই অংশ, এই দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়। এক প্রাথমিক হিসেবে জানা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আদিবাসীর সংখ্যা সহস্রাধিক। যুদ্ধে শহীদ আদিবাসীর সংখ্যা শতাধিক। সংখ্যাহীন এমন অনেক আদিবাসী যোদ্ধা রয়েছেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব রেখে এদেশের বিজয়কে অনুকূলে এনে দিয়েছেন। অথচ স্বাধীন দেশের ক্রমাগত নিগ্রহ, বঞ্চনা ও অস্বীকৃতি তাদের অনেককে দেশান্তরিত হতে বাধ্য করেছে, কুন্ঠিত করছে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতে। তেমনি এক অবহেলিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বীর মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত ইউ কে চিং মারমা বীরবিক্রম।
'মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং মারমা বীরবিক্রম; সম্প্রতি খাসিয়া মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিকে বীরপ্রতীক উপাধি প্রদানের আগপর্যন্ত তিনিই ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় অর্ধশতাধিক আদিবাসী বা অবাঙালী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত বীরসেনা। জন্ম ১৯৩৭ বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর থানার লাঙ্গিপাড়া গ্রামে। মাতা হ্রিংসাউ আর পিতা বাউসাউ মারমা। স্থানীয় বোমাং রাজা পরিচালিত স্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করে ইউ কে চিং ১৯৫২ সালে ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স (ইপিআর)-য়ে। দীর্ঘ ৩০ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে ১৯৮২ সালে অবসর নেন হাবিলদার মেজর হিসেবে। বর্তমানে তিনি তাঁর জন্মস্থান লাঙ্গিপাড়ায় অবসরজীবন যাপন করছেন।
‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী' শীর্ষক শিরোনামে পরিচালিত একটি গবেষণাকান্ডের অংশ হিসেবে ২০০৭ সালে সারাদেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রয়াস পাই; সাক্ষাৎ গ্রহনের সুযোগ লাভ করি ইউ কে চিং মারমার সাথে, পাহাড়ের দীর্ঘ প্রান্তদেশ পেরিয়ে ২০০৭ এর জুন মাসের একটি দিনে, তাঁর প্রান্তিক বসতভিটায়। চারিদিকের আরণ্যক আবহে আবিষ্ট ইউ কে চিং এর নড়বড়ে ঘরটিতে ঝোলানো ছিল তাঁর যৌবন ও যুদ্ধকালীন কিছু অস্পষ্ট ছবি। কেবল স্পষ্ট ছিল তাঁর কন্ঠস্বর, প্রানবন্ত তাঁর হাসি। সেদিনের সেই অন্তরঙ্গ আলাপে তিনি অকৃপনভাবে উন্মোচন করেছিলেন তাঁর জীবন ও যুদ্ধের অনেক অনুল্লিখিত কথা। নানাবিধ নিগ্রহে নিপতিত একমাত্র বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত আদিবাসী এই যোদ্ধা নিজেকে একরকম আড়াল করেই রেখেছেন। আড়ালে রয়েছি আামরাও তাঁর কাছ থেকে বহুদিন।
[‘ইপিআর’ - যে জীবন অন্য জীবন]
: পাহাড়ের কোলে কেমন কাটতো জীবনের প্রথম বেলা?
:: নিজের লোকালয়ের পাহাড়গুলোকে ভালবাসতে গিয়ে ভালবেসে ফেলেছিলাম পৃথিবীর সব পাহাড়মাতাকে। বুঝতে না পারার মতো ছোট যখন তখন ভাবতাম- আমার আর আমাদের জন্ম বুঝি বা ঐ পাহাড়কোল ফুঁড়েই। তাইতো তারা মানুষদের আশ্রয় দেয়, আহার দেয়। সত্যিই বুঝতে পারার মতো সময়ের অনেকটা পেরুনোর পর ভাবতে পারতাম না পাহাড় ছেড়ে আমি পালাতে পারব।
: কিন্তু শেষপর্যন্ত পালাতে পারলেন কী করে?
:: স্বভাবতই প্রকৃতিতে আমি ছিলাম এক আদর্শ দুষ্টু ছেলে। পড়াশোনা কিছুটা করেই তাতে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। সবছেড়ে ছন্নছাড়া আমি কাজের চেয়ে অকাজেই লিপ্ত থাকতে পছন্দ করতাম। সেই দশা থেকে মুক্ত করার জন্যে আমার এক ভগ্নিপতি আমাকে জোর করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ইপিআর-এ ভর্তি করে দেন। এটাকে পালানো না বলা গেলেও এ্টাই ছিল পলায়ন প্রক্রিয়ার শুরুর পর্ব। কেননা, কিছু দিন গত হতেই আমি আমার প্রাচীন সংস্কারকে এড়াতে পেরেছিলাম।
: ইপিআর-এ যোগ দেবার পর প্রথমজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
:: আমি তখন নিতান্তই এক পাহাড়ি কিশোর। ভেতরে সর্বদা ভয় ভয়। আমার জš§স্থান বান্দরবানে থাকাকালে সমতলের মানুষদের সঙ্গে তেমন করে মেশার অভিজ্ঞতাও তেমন ছিল না। তাছাড়া, আমি পাহাড়ি, আমাদের খাদ্যাভাসও আলাদা। খাবারের সময়গুলো পাহাড়ি সমাজে খুব তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়। প্রথম দিকে এসব ব্যাপারে অনভ্যাসহেতু কিছু সংকোচ ও সমস্যা মানসিকভাবে পীড়া দিত বৈকি! কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা অচিরেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই ট্রেনিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ায়। ট্রেনিংয়ে শেখানো কৌশলগুলো ও শরীরগঠন করার পদ্ধতিগুলো আমার কাছে মজার কোনো খেলার মতোই মনে হয়েছে। কারণ, আমি পাহাড়ি ছেলে, পাহাড়িদের জীবন আরো অনেক কঠিন ও কৌশলময়। তাই আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হতাম। এমনকি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ১৯৭১ সালে এবং অন্যান্য সময়ে বিভিল্পু দলকে ট্রেনিং দেওয়ারকালে আমি আমার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে দেখেছি। আমার অধীনস্থরা সেগুলো ভালোভাবেই গ্রহণ এবং প্রায়োগ করতে পেরেছে।
[মুক্তির মহানযুদ্ধে]
: মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে আপনি কোথায় অবস্থান করেছিলেন?
:: তখন আমি রংপুরের হাতিবান্ধায় ইপিআর-এর বর্ডার আউটপোস্টে নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। যুদ্ধ শুরু হলে আমাকে হাবিলদার পদে উন্নীত করা হয়।
: সে সময়ে আপনি উল্লেখযোগ্য কোন্ কোন্ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন?
:: আমার অধীনস্থ দলে ৬৫ জন সৈনিক ছিল। আমি তাদের নিয়ে রংপুর, লালমনিরহাট, পাখিউড়া, কাউয়াহাগা, বাঘবান্ধা, হাতিবান্ধা, চৌধুরীহাট, ভুরুঙ্গামারী, কুলাঘাট প্রভৃতি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি।
: এবার এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো অপারেশনের বর্ণনা করুন।
:: কাউয়াহাগার অপারেশন দিয়ে শুরু করা যায়। যুদ্ধ দেশব্যাপি বিস্তৃত হয়েছে কিছুদিন হল। লালমনিরহাট নদীটির ওপারে আমরা একদিন দেখতে পেলাম আগুন জ্বলছে। আমার সঙ্গে গার্ড হিসেবে ছিল দু’জন সেপাই। ওদের বললাম, কোনো ফায়ার-টায়ার করার দরকার নেই, শুধু দেখতে থাকো। এর আগে অবশ্য আমরা ওখানে অ্যামবুশ করেছিলাম। এক সময় দেখলাম, দু’জন পাকিস্তানি প্যান্ট-শার্ট ক্লোজ করে শাড়ি পরে ঘরে ঢুকছে। ভাবলাম, যদি গুলি করি তাহলে হয়তো মারা যাবে, নয়তো পালিয়ে যাবে। কিন্তু ওদের জীবিত ধরতে হবে নয়তো জানা যাবে না মূল ঘটনাটা। তাই ওদের দু’জনকে জীবিত ধরে আনার জন্য ৪ জনকে পাঠালাম, সঙ্গে গরু বাঁধার দড়ি। বলে দিলাম, যদি ঘরে দুটি দরজা থাকে তাহলে দুই দরজায় দু’জন দাঁড়াবে আর দু’জন ঘরে ঢুকবে। আর যদি একটি দরজা থাকে তাহলে দু’জন দরজায় দাঁড়াবে, আর দু’জন ঘরে ঢুকবে। যেই কথা সেই কাজ। কিন্তু একজন তবুও পালিয়ে গেল, আর একজন জীবিত ধরা পড়ল। ওটা ছিল একজন পাঞ্জাবি সেনা। সেনাটিকে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলোÑকি জন্য ছ™§বেশ ধরেছে, তার দলের নেতা কে? দলের কে কোথায় আছে ইত্যাদি। সে সবই বলে দিয়েছিল। কারণ, তাকে বলা হয়েছিল যে সে বাঁচতে চায়, নাকি মরতে চায়! যদি বাঁচতে চায় তাহলে আমাদের সব কথা শুনতে হবে, আর মরতে চাইলে এখনই তাকে বেয়নেট চার্জ করা হবে। তাই সে বাঁচার জন্য সবই বলে দিয়েছিল।
সারা রাত আগুন জ্বলল নদীর ওপারের গ্রামটায়। তবুও আমরা রাতে কোনো ফায়ার ওপেন করলাম না। কারণ, জানতে পেরেছিলাম পাকিস্তানিদের কেউই আর ওখানে নেই। তাই আমি রাতে সেনাটাকে ভারতীয় ফোর্সের কাছে পৌঁছে দিতে যাই। অবশ্য ওকে বাঁচিয়ে রাখার বিরুদ্ধে আমার দলের অনেক সেনা আপত্তি তুলেছিল। আমি তখন ঠাণ্ডা মাথায় তাদের বুঝিয়ে বলেছিলামÑ ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের স্বার্থেই। তাছাড়া পাকিস্তানিদের হাতে আমাদের দেশের অনেক মানুষ বন্দি হয়ে আছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ওদের জেলে বন্দি। ওকে আমরা তখনই ফিরিয়ে দেব যখন ওরা আমাদের কমপক্ষে ২০-২৫ জনকে ফিরিয়ে দেবে। তাই রাতেই আমি পাঞ্জাবি সেনাটিকে ভারতীয় ফোর্সের কাছে হ্যান্ডওভার করে আসি। ওকে পৌঁছে দিয়ে এসে আমি আমার দু’জন সেনা নিয়ে আবার নদীর ঘাটে গেলাম। কান পেতে শুনলাম, মহিলা ও বাচ্চাদের কান্না শোনা যাচ্ছে। সেপাইরাও শুনল। সারা গ্রাম তো পুড়ে ছাই, বাচ্চারা আসল কীভাবে? তাড়াতাড়ি করে মাঝিকে খুঁজে বের করে এনে বললাম, নদীর ওপারে গিয়ে তোমাকে জানতে হবে কারা ওখানে কাঁদছে, কেনইবা কাঁদছে! মাঝি তো ভয়ে অস্থির। কারণ, ওখানে পাকিস্তানিরা থাকতে পারে। যাই হোক, তাকে অভয় দিয়ে পাঠালাম নদীর ওপারে। ফিরে এসে সে বলল, স্যার ওপারে কোনো পাকিস্তানি নাই, অনেক মহিলা আর বাচ্চা বালির মধ্যে গর্ত করে বসে বসে কাঁদছে। তাকে বললাম, যে করেই হোক ওদেরকে এপারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। মাঝিকে বললাম, তুমি গিয়ে বলো যে, মুক্তিফৌজের হাবিলদার সাহেব আপনাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন। এভাবে ৬টি ক্ষেপ দিয়ে ৩২ জন মহিলা আর তাদের সন্তানগুলোকে নদী পার করে এনে গ্রামের স্কুলে নিয়ে ওঠালাম। গ্রামের মাতুব্বর, স্কুলের শিক্ষকদের ডেকে সব বাড়ি থেকে কাঁথা, শাড়ি, চাল, ডাল তুলে ওদের সব কিছুর ব্যবস্থা করলাম। এরপর ওদের সবার নাম রেজি¯িট্র করে ক্যা¤েপ পৌঁছে দিয়ে এসে আবার নদীর ওপারে গেলাম আমার দল নিয়ে। তার আগে অবশ্য নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ওখানে কোনো পাকিস্তানি নেই। গিয়ে দেখি কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই সেখানে। কেবলি আগুনে পুড়ে যাওয়া কালো কালো ছাইয়ের স্তুপ। এর মধ্যে আমাদের দেখে কচু ক্ষেতের মাঝ থেকে একজন বুড়ো আর একটি বাচ্চা বেরিয়ে এলো। ওরা দু’জন গোপনে লুকিয়ে ছিল। তাদের কাছ থেকে শুনলাম, যত বাঙালি পুরুষ ছিল, সবাইকে ব্রাশ করে মেরে ঘরের চাল তাদের উপরে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পাকসেনারা। ওদের কথামত টিনগুলো উঁচু করে দেখি সেই বিভৎস দৃশ্য। কাউকে চেনার উপায় নেই, কেবলি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মাংসের কালো কালো স্তুপ। ওই অবস্থায়ই গর্ত করে তাতে দু’জন দু’জন করে সমাহিত করে আমরা আমাদের ব্যারাকে ফিরে আসি। আমার স্মরণে এটা ছিল এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ।
: একজন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধার কাছে নিঃসন্দেহে এটা একটা দুর্বিষহ স্মৃতি। এরকম কি আরও ঘটেছে?
:: এরকম অসংখ্য অঘটনের জন্ম দিয়েছে ঐ বেজন্মা পাকিস্তানিরা। আমার আরও মনে পরছেÑ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে আমি তখন রংপুরে অবস্থানরত। এক সকালে সঙ্গে কয়েকজন সেপাই নিয়ে গেলাম শহরের পাশে। সেখানে একটি ছোট ব্রিজ ছিল। দেখলাম ব্রিজের নিচে অনেক চাটাই স্তুপ করা। সঙ্গীদের নিয়ে একে একে ৭টি চাটাই তুললাম। চাটাই তুলে যা দেখলাম তা বলতে আজও আমি শিহরিত হই। সেই বীভৎস দৃশ্য ভোলার নয়Ñ প্রতিটি চাটাইর নিচে রক্তে ভেজা ক্ষত-বিক্ষত মানুষের লাশ। সব লাশই ছিল মেয়েদের। হাতে ঘড়ি, পায়ে জুতা দেখে বুঝলাম স্কুল-কলেজের ছাত্রী। চেহারা দেখে চেনার কোনো উপায়ই ছিল না। কারণ, সবারই মুখের আর বুকের মাংস খুবলে নিয়েছে পাকিস্তানি শয়তানের বাচ্চারা। পাশর্^বর্তী আরেকটি ব্রিজের নিচে দেখলাম কচুরিপানাগুলো কেমন যেন এলোমেলো। সন্দেহ জাগায় সেনাদের বললাম কচুরিপানাগুলো তুলে দেখতে। সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হলোÑ বাঙালি নারীদের বিভৎস মৃতদেহ। কারোই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আস্ত নেই। খুবলে খেয়েছে জনমক্ষুধার্ত হানাদাররা। হাতের ঘড়ি, পায়ের জুতা, আঙ্গুলের আংটি সবই ঠিক আছে, শুধু দেহটা যেন শকুনের পাল্লায় পড়া মৃতগরুর। মেয়েদের লাশগুলো তুলে এনে সারা শহরে মাইকিং করলাম যে, এরকম মেয়ে কারো আছে কিনা, বা ছিল কিনা। কেউই সাড়া দিল না, তাই রংপুর টাউন হলের পাশে ওদের একত্রে দাফন করি। এর কয়েকদিন পর আবার হাঁটতে হাঁটতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার সময় একদিন দেখলাম কাঁচা মাটির তৈরি হালকা উঁচু ঢিবি। কেমন যেন সন্দেহ হলো আমার। সেপাইদের বললাম, মাটির উপর ঘা দিয়ে দেখতে। ওরা ঘা দিয়ে দেখল নরম নরম লাগে। মাটি খুঁড়তে বললাম ওদের। দেখতে পেলাম ২টি করে লাশ একেকটি গর্তে হাত-পাত বাঁধা। এরকম ৩-৪টি গর্ত খুঁড়লামÑ একই অবস্থা। লাশগুলোর চেহারা দেখে বুঝলাম ওরা হয়তো উচ্চবিত্তস¤পন্ন পরিবারের মানুষ ছিলেন। আর না খুঁড়ে সেনাদের বললাম, পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে রাখতে, অনর্থক মৃতদের কষ্ট দিলে পাপ হবে।
: অন্য কোনো এলাকায়?
:: এছাড়াও দিনাজপুর এলাকায় দেখেছিলাম বিহারিদের অকথ্য নৃশংসতা। ওরা ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে পানির মধ্যে চুবিয়ে মারত। প্রথমে গলার উপরে পা দিয়ে পানির মধ্যে চেপে ধরে রাখত। যখন বাচ্চাগুলোর আর ছোট ছোট শরীর নড়াচড়া করত না, ঠিক তখনই ছেড়ে দিত। অর্থাৎ মরে যাওয়ার পর ছেড়ে দিত পানির মধ্যে। এভাবে অসংখ্য শিশুকে মেরেছে বিহারিরা। এই বিহারিরাই আবার কোথাও নদীর ধারে নারীদের লল্ফ^া লাইন করে দাঁড় করিয়ে ইচ্ছেমত বেঘোরে পেটাত। যখন মহিলারা অজ্ঞান হয়ে যেত বা মারা যেত তখন ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিত। এমনি করে নৃশংসভাবে অসংখ্য মহিলাকে খুন করেছে বিহারিরা।
: কোনো প্রতিশোধ নিতে পেরেছিলেন কি এইসব ঘটনার?
:: হ্যাঁ পেরেছিলাম। একবার দিনাজপুরেই স্বামী-স্ত্রী আর দু’টি মেয়ে মোট ৪ জন বিহারিকে ধরলাম। ১টি মেয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ত, আরেকটি ক্লাস নাইনে। খুবই মায়াবী চেহারার মেয়ে দু’টো। আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে স্বামী-স্ত্রী অনেক কান্নাকাটি করে বলল, আল্লাহরওয়াস্তে আমাদের বড় মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখুন। ওকে আপনারা বিয়ে করতে পারেন, সে খুবই ভালো মেয়ে। আমাদের তিন জনের জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার এ মেয়েটিকে বাঁচান। আমার স্মৃতিতে তখন ভাসছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার দৃশ্য। তাই কান দিলাম না ওদের আবদারে। প্রথমে বাচ্চা দুটো মেরে পরে মারলাম স্বামী-স্ত্রীকে। চারজনকে একটি গর্তের মধ্যে মাটিচাপা দিয়ে একটি প্রতিশোধের শান্তি পেয়েছিলাম সেদিন।
: এমন কি হয়েছে- কাউকে কাউকে বাগে পেয়েও মেরে ফেলেন নি বা প্রতিশোধ নেন নি?
:: হ্যাঁ ঘটেছে। কাউকে কাউকে হাতের কাছে পেয়েও মারতে পারি নি। কারণ, যুদ্ধ শুরুর আগে আমরা একই সঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, গল্প করেছি। ওদের মধ্যে কেউ কেউ খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের আমি মারতে পারি নি। কিন্তু যাদের নামে আমার কানে অভিযোগ এসেছে তাদের ক্ষমা করিনি, তারা যতই পরিচিত বা ঘনিষ্ঠ হোক। তারপরও কোনো কোনো পাকিস্তানি অফিসারকে মারার সময় সেনাদের মধ্যে কেউ কেউ আপত্তি করত, কাঁদত। আমি তখন ওদের পাকিস্তানিদের অমানবিক অত্যাচারের কথা শুনিয়ে শান্ত করতাম।
[সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা]
: যুদ্ধ চলাকালে হারিয়ে ফেলা কোনো সহযোদ্ধার স্মৃতি কি আপনাকে কাতর করে কখনও?
:: যুদ্ধ যখন চলে তখন সহযোদ্ধাদের সবার প্রাণ এক প্রাণে পরিণত হয়। তাই সে সময়ে হারানো কোনো বন্ধুর কথা মানুষ সহজে ভুলতে পারে না। আমিও পারি নি। বাঘবান্ধায় অবস্থানকালে আমার ডিফেন্সে দু’জন আনসার ছিলেন-আপন দুই ভাই। যুদ্ধের মাঝখানেই বড় ভাই এক ডেলিভারি কেস থাকায় বাড়িতে যায়। বাড়ি থেকে ফেরার সময় সে খাওয়ার জন্যে একটি মুরগি নিয়ে আসে। বহুদিন পর বাড়ির সবাইকে দেখতে পেয়ে সে তখন খুব উৎফুল্ল। মুরগিটি জবাই করার জন্য বাংকারের সামনে যায় ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। ওদিকে পাকিস্তানিরা অদূরেই তাদের ক্যাম্প থেকে সব সময় আমাদের বাংকারে দৃষ্টি রাখত। আমি বুঝতে পেরে ওদের দুই ভাইকে বকাঝকা করে বাংকারে ঢুকতে বললাম। ঠিক তখুনি বোমা নিক্ষেপ করে পাকবাহিনী। প্রথম বোমাটি পড়ল ওদের ২৫ গজ ডানে, ™ি^তীয়টি ২৫ গজ বামে। এই অবস্ট’া দেখে ওরা ভয় পেয়ে বাংকারের মুখের দিকে দৌঁড় দিল। তবুও শেষ রক্ষা হলো না ভাই দু’টির। তৃতীয় বোমাটি পড়ল ঠিক বাংকারের মুখবরাবর। ঘটনাস্ট’লেই দুই ভাই শহীদ হন সেদিন। আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম সেই সহোদরদের মৃত্যুতে। এরপর ভুরুঙ্গামারীতে হারিয়েছিলাম একজন সৈনিক। এক পাকিস্তানিকে সে নিজ হাতে মেরে খুশি মনে লাশ আনতে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেও লাশ হয়ে ফিরে এসেছিল।
তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম চৌধুরীরহাট অপারেশনের সময়। সেই অপারেশনে আমাদের সঙ্গে এক লেফটেন্যান্ট ছিলেন। খুবই সুদর্শন, বিএ পাস একজন যুবক। বুদ্ধিমত্তা ও নৈপুণ্যের কারণে ভারত থেকে তাকে এই উপাধি দেয়া হয়েছিল। তো রাতের বেলা আমরা পাশ^বর্তী পাকিস্তানি ঘাটিতে অ্যাটাক করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিনি আমাকে দিলেন ডান দিক, আর নিজে নিলেন বাম দিক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাম দিকে কয়েক গজ এগুতে না এগুতেই একটি বোমা এসে পড়ে তার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে মারা যান তিনি। কতটা কষ্ট যে সেদিন মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়েছিল সেই রাতের আঁধারে, তা আর বলে বোঝানো যাবে না। তাঁর নাম ছিল আব্দুস সামাদ। ভুরুঙ্গামারী বাজারের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়েছিল। আজো সেই অঞ্চলে সামাদনগর নামে একটি এলাকার পরিচিতি রয়েছে। লেফটেন্যান্ট সামাদ সাহেব আজো বেঁচে আছেন ওই এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
[অপ্রীতিকর ঘটনা]
: যুদ্ধ চলাকালে কি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে আপনাকে ?
:: মনে পরছে, আমি আমার দল নিয়ে তখন অবস্থান করছি কুলাঘাটে। অতি সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছি। অন্যদিকে নিকটবর্তী পাকিস্তানি টিম একের উপর্যুপরি গুলি ছুড়ে যাচ্ছে। দিনেরবেলা ভারতীয় ফৌজ আসল। জিজ্ঞাসা করল, হালচাল কী, ওদের অবস্থন এখান থেকে কতদূরে...ইত্যাদি। আমি তাদের অভয় দিয়ে বললাম, শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা আমাদের মতো নিরাপদ দূরত্বে আছি, এবং আরও গুছিয়ে নিচ্ছি। এরপর সকাল তখন ১০-১১টা হবে। মেশিনগান বসালাম একটি গাছের ওপর। ব্রাশ মারলাম পর পর কয়েকটা। দেখলাম সব নিশ্চুপ, সাড়াশব্দ নেই। সেদিন সারাদিন আমরা বাংকারে অবস্থান নিয়ে থাকলাম। রাত ৯টার দিকে ওরা প্রথমে ফায়ার ওপেন করল, এরপর শুরু করল বোম্বিং। এই অবস্থাায় আমি সেনাদের প্রস্তুত হতে বলার জন্য বাংকারে যাই। গিয়ে দেখি বাংকারে কেউ নেই, সবাই হেড কোয়ার্টারে চলে গেছে। সারারাত একাই ওদের রেসপন্স করে সকালে গেলাম হেড কোয়ার্টারে। দেখলাম, সবাই খোশ-গল্পে মেতে চা-নাস্তা খাচ্ছে। রাগে-ক্ষোভে তখন আমার সারা শরীর কাঁপছে। রাগের মাথায় কয়েকজনকে লাথি মেরে জিজ্ঞাসা করলাম, যুদ্ধ করতে এসেছো, নাকি পেট পুরতেই এসেছো? আমাকে একা বাংকারে ফেলে রেখে তোমরা কীভাবে আসতে পারলে? যুদ্ধের ময়দানে এত ভয় পেলে চলবে কী করে? আমি তো মরিনি, এখনো বেঁচে আছি। এক সিলেটি হাবিলদার ছিলেন আমার দলে। দেখি তিনি রিসিভার হাতে নিয়ে আরামে চা খাচ্ছেন। টেলিফোনের রিসিভারটা তাঁর কাছ থেকে নিয়ে বললাম, যতদিন এখানে আছেন ততদিন আপনি আর রিসিভার ধরবেন না, সেই যোগ্যতা আপনি আজ থেকে হারিয়ে ফেলেছেন।
[এর পর]
: এর পর?
:: আমি তখন রিসিভারটা নিয়ে ভারতে কল করলাম। ধরলেন এক মেজর। তাঁর বাড়ি ছিল পাবনায়, এক হিন্দু অফিসার। সব বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে কমান্ডার সাহেব আমি এক্ষুণি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা সবাই হাতিয়ার রেখে গাড়িতে উঠে চলে আসেন। মেজর সাহেবের কথামত গাড়ি আসলে আমরা সবাই বেডিংসহ গাড়িতে উঠে ভারতে চলে গেলাম। গিয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছলাম, সেখানে ১টি অফিস ও ১টি ক্যান্টিন আছে, আর আছে ‘একটি বিশালাকার গোডাউন’। প্রথমে ভেবেছিলাম, খাবারের গোডাউন হবে। কিন্তু না, পুরোগুদাম ভর্তি হাতিয়ার। রাশিয়ান অস্ত্র। মেজর সাহেবের নির্দেশমত সবাই যে যার ইচ্ছেমত হাতিয়ার নিয়ে আমরা চলে এলাম ভুরুঙ্গামারী ও বাঘবান্ধার মাঝামাঝি একটি জায়গায়। সেখানে ডিফেন্স নিয়ে আমরা পাকা রোডের ওপর দুটি এলএমজি বসালাম। বাংকার বানালাম গাছের আড়ালে। সেখানে খাট পাতা, খাটের ওপর মশারি ও হারিকেন। বাংকার থেকে ৫০ গজ দূরে রোডব্লক দিলাম যাতে পাকিস্তানিরা গাড়ি নিয়ে আসলে রাস্তা ক্রস করতে না পারে। পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের পাকিস্তানিদের দুটি আর্টিলারি ছিল। রাতে খুব আর্টিলারি মারল। ওদের অটোমেটিক ভালো ছিলÑবোমাগুলো সব আশপাশে পড়ত। আমি আমার সেনাদের বললাম, ফায়ার ওপেন করার দরকার নেই। ওরা যদি সামনা সামনি আসে তবেই আমরা যুদ্ধ করব। তবুও তোমরা সব সময় প্রস্তুত থাকবে। সেই রাতে পাকিস্তানিরা আমাদের একটানা খুব ফায়ার করল। আমরা চুপচাপ রাত কাটিয়ে দিলাম। সকালবেলা ভারতীয় ফৌজ নিয়ে মেজর সাহেব আসলেন। পাক সেনাদের অবস্থান জানতে চাইলে বললাম ভুরুঙ্গামারী বাজারের পাশে আছে ওরা। মেজর ওদের দেখতে চাইলে তাঁকে নিয়ে একটি ঢালু জায়গা থেকে বাইনোকুলার দিয়ে দেখলাম পাকিস্তানিদের। সকালবেলা ওদের চা-নাস্তা খাওয়াচ্ছে এক বাঙালি মহিলা। দেখে-শুনে মেজর বললেন, যে করেই হোক ওদের খতম করতে হবে। এরপর তিনি আমাদের বাংকার দেখতে গেলেন। বাংকার দেখে খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আজ রাতেই শুরু হবে আখেরি অপারেশন। তোমরা ততক্ষণ নিশ্চিন্তে বসে থাকো। রাতের বেলা আমরা ১০-১২টা তিন ইঞ্চি মর্টার, ১০-১২টা চার ইঞ্চি মর্টার, আর মেশিনগান নিয়ে আমরা তৈরি হলাম। এরপর সারা রাত ধরে চলল ফায়ারিং, বোম্বিং। সকালে আসলেন জেনারেল অরোরা। আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, শুনলাম ভুরুঙ্গামারী অঞ্চল ক্লিয়ার, তাই না? আমারও সেরকম মনে হয়েছিল তাই মাথা নাড়ালাম। রাস্তার উপর দেয়া বাঁধটি খুলে দিলাম জেনারেলের গাড়ি যাওয়ার জন্য। যেই উনি বাঁধটি ক্রস করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে ফায়ারের উপর ফায়ার। জিপের ওপর দিয়ে, আরোরা সাহেবের মাথায় ওপর দিয়ে গুলি ছুটে চলল একের পর এক। ভাগ্য নিতান্তই ভালো যে গাড়ির চাকা এবং ওনার মাথায় কোনো গুলি লাগেনি। তড়িঘড়ি করে জিপ থেকে নেমে এসে জেনারেল বললেন, ইউ কে তোমার সন্দেহই বোধ হয় ঠিক। ওরা এখনো স্ট্রং আছে। এরপর আমরা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে পর পর ৩০টি বোমা মারলাম। দেখি কোনো সাড়া-শব্দ নেই আর। শেষে যখন ওখানে গেলাম, দেখি ৪টি লাশ ছাড়া আর কিছু নেই। ৪ জনই ছিল সেখানে।
আরেকটি অপারেশনের কথা মনে পড়ছে। ওই পাকিস্তানি দলটিরও দ’ুটি আর্টিলারী ছিল। খুবই নিরাপদ স্থানে থেকে আমাদের ফায়ার করত একের পর এক। ভারতীয় ফৌজের মেজর এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ওদের অবস্থান কোথায়! ওদের অবস্থান জানার পর বললেন, ৩ মাইল দূর দিয়ে ঘুরে গিয়ে ওদের কাউন্টার-অ্যাটাক করতে হবে, সামনাসামনি নয়। তার কথা অনুযায়ী কয়েকজন সাহসী রাজপুত সেনা নিয়ে ৩ মাইল ঘুরে ওদের বাঙ্কারের কাছাকাছি গেলাম। রেল লাইনের স্লিপারের নিচে গর্ত করে বাংকার বানিয়েছিল ওরা। সেই গর্ত থেকেই ফায়ার ও বোম্বিং করত। আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়েই রাজপুত সেনারা একেবারে বাংকারের মুখে গিয়ে বলল, হ্যান্ডসআপ। হাতিয়ার রেখে একে একে বেরিয়ে এলো সাতজন। একজন কমান্ডার ছয়জন সেপাই। ওই সাতজনকে আমরা গুলি করে মারি নি। মেরেছিলাম বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে। একটি ইনজেকশনই যথেষ্ট। এভাবে সাতজনকে মেরে রাস্তার ওপর লাইন করে শুইয়ে দিয়েছিলাম আমরা।
[গ্রামবাসীদের সহযোগিতা]
: যুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় গ্রামবাসীদের কেমন সহায়তা পেয়েছেন?
:: অবশ্যই। সম্ভবপর সব ধরণের সহযোগিতা করেছেন তারা। কেননা, যুদ্ধের সময় শত্রু ছাড়া বাকি সবাই একে অন্যের মিত্র। আমরা যেমন গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি। গ্রামবাসীরা আমাদের জন্য তার চেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে। চাল, ডাল, কাঁথা, কাপড়, আশ্রয়Ñসবকিছু দিয়েই পাশে থেকেছে তারা। ভাত না থাকলে ভাতের ফ্যান দিয়েছে, ঘরে চাল না থাকলে গ্রামের সবার থেকে চাল উঠিয়ে আমাদের দিয়েছে। এমনকি গরু, হাঁস, মুরগি, ছাগল এগুলোও দিয়েছে। তবে আমাদের দলটি যেহেতু ইপিআর-এর সৈনিকদের নিয়ে, ফলে আমরা খাবার-দাবারের ব্যাপারে তেমন চিন্তা-ভাবনা করতাম না। এমনকি আমি যেখানেই আমার দল নিয়ে গেছি সেখানেই টেলিফোন পর্যন্ত চলে গেছে।
: আর সাধারণ মুক্তিবাহিনীরা ?
:: যখন পেট্্রলে যেতাম, চোখে পড়ত অসহায় ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ। আমাকে দেখে আবদার করত, অভাব-অভিযোগ জানাত। বলত, বাবা আমরা মুক্তিযোদ্ধা, না খেয়ে লড়তেছি। আমাদের ভাত নেই, তরকারি নেই, শুধু গুলি-বোমা আছে। আমি তখন আমার দলের তরফ থেকে, গ্রামের মুরুব্বীদের থেকে চেয়ে নিয়ে ওদের খেতে দিতাম।
[স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতা]
: তখন নিশ্চয়ই কোন স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনুপ্রেরণা কাজ করত?
:: স্বপ্ন তখন একটাই ছিলÑ দেশটা কেমন করে আজাদ হবে, মানে স্বাধীন হবে। কেননা, এই দেশকে আমার নিজের দেশই মনে করতাম, করেই যাব আমৃত্যু। এখানেই আমার তিন পুরুষের নাড়ি পোঁতা। তাই দেশ আমাকে যাই মনে করুক, আমি নিজেকে এই দেশের বাইরের ভাবতে পারি না। মায়ের মতোই ভালোবাসি এই মাতৃভূমিকে। আর এই ভালোবাসা থেকেই আমি প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। আমার স্মরণে ১৯৭১-র ভয়াবহ যুদ্ধের উত্তাল সময়গুলোতে কখনোই ভাবতে পারিনি আগামীকাল আমি বেঁচে থাকব। প্রত্যেকটি দিন জীবনের বোনাস টাইম মনে হতো। তাই যত বিপদেই পড়েছি ঘাবড়ে যাইনি, ভয় পাইনি। আমার সেক্টর কমান্ডার আবুল বাশার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইউ কে আপনি কি মনে করেন দেশটা স্বাধীন হবে! জবাবে বলেছিলাম, অস্ত্র যখন হাতে নিয়েছি স্যার যতক্ষণ আমার অস্ত্র ধরে রাখার শক্তি থাকবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সাহস আছে তো লড়ে যাওয়ার? বলেছিলাম, আমাকে সাহস দেয়া না দেওয়ার ব্যাপার আমার সৃষ্টিকর্তার। তবে স্যার এখনো আমি কিছুতে সাহস হারাইনি, ভয়ও পাইনি। এভাবেই আমি আমার দেশমাতার মুক্তির স্বপ্নকে সামনে রেখে এগিয়ে গিয়েছি সব ভয়-ভীতি বাধা-বিপত্তিকে পেছনে ফেলে। কেননা, মুক্তির প্রশ্নে ভীতি কখনো সাফল্য আনতে পারে না। স্বপ্নের মূল্যায়ন করতে হয় সাহস দিয়ে।
[বিজয় বাংলাদেশ]
: ডিসেম্বর মাসের বিজয়পর্বে কোথায় অবস্থান করছিলেন?
:: ১৪ ডিসেম্বর থেকে আমি আমার গ্রুপ নিয়ে তিস্তা ব্রিজ এলাকায় অবস্থান করছিলাম। টানা দু’দিন হালকা-পাতলা গোলাগুলি হলো। এরপর ১৬ ডিসেম্বর সকালে হঠাৎ করে আমাদের জানানো হলো ৯টা পর্যন্ত সময়, আর ফায়ার করা যাবে না। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, বিজয় ঘোষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা সকাল ৯টার আগেই ছোট্ট একটি অপারেশন সারলাম। চারজন পাকিস্তানি একটি বাংকারের সামনে বসে চা খাচ্ছিল। সবকিছু পজিশন করে দিলাম ব্রাশ। চারজনের মধ্যে দু’জন মারা গেল আর দু’জন পালিয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পর ৯টা বাজলে আশপাশের পাকিস্তানিরা সাদা পতাকা টানিয়ে দেয়।
: সেই সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলুন?
:: ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে’- এই কথাটুকুর তাৎপর্য যে কত ব্যাপক ও বিস্তৃত তখনও আমি বুঝে উঠতে পারি নি। বুঝতে পারলাম যখন আমরা তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে রেল স্টেশনে গেলাম। গিয়ে দেখি রেল স্টাফরা আনন্দে কথা বলতে না পারার মত সময়ের সন্ধিক্ষণেও গরু-খাশি জবাই করে আমাদের জন্য খাবার তৈরি করেছে। চারদিকে তখন বিজয়ের সুগন্ধি বাতাসের সন্তরন। পৃথিবীর দরিদ্রতম এই দেশটির মানুষের আনন্দের কত ধরনের প্রকাশ যে থাকতে পারে সেদিন দেখেছিলাম।
: এর পর অবস্থান গ্রহণ করেন কোথায়?
:: স্টেশনের খাওয়া সমাপ্ত করে দু’টি গরুর গাড়িতে আমাদের সব বেডিং আর অস্ত্র নিয়ে আমি রংপুরে রওনা হলাম, বাকিরা সবাই হেঁটে আসল। রাত ৯টায় গিয়ে উঠলাম রংপুর কলেজে। সেই রাতেই গ্রামের লোকজন আমাদের অভ্যর্থনা জানায় এবং গরু জবাই করে খেতে দেয়।
: সেই সময়ের কোনো স্মরণীয় স্মৃতি?
:: হ্যাঁ স্মরণীয়ই বটে। রাতেই জানতে পেরেছিলাম আÍসমর্পণকারী পাকিস্তানি সেনাদের অনেকে কলেজ গেটে অবস্থান করছে। সকালে সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে অনেককেই চিনতে পারলাম। কেননা, যুদ্ধের আগে আমরা একসঙ্গে থেকেছি, খেলেছি, খেয়েছি। আমাকে দেখেই তাদের কয়েকজন হাসিমুখে এগিয়ে আসল। অনেকদিন পরে ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন হয়। তেমনিভাবে বলে উঠল, শালা ইউকে, তুমি এখনো মরোনি দেখছি। জবাবে আমি বললাম, শালা আমি এখনো বেঁচে আছি বলেই তোমাদের জীবিত দেখছি। এভাবে কিছুক্ষণ বাক্যুদ্ধ করে হাত মেলালাম। ওরা বলল, ভাই তোমাদের দেশ তোমাদেরই থাক। সবকিছু ভুলে যাও, যা হয়েছে হয়তো বা ভালোই হয়েছে। তোমরা তো যাই হোক খেতে পেরেছ। আর আমরা না খেয়ে মরেছি। যাই হোক, এসব শেষ হয়েছে ভালো হয়েছে। তোমাদের শুভ হোক। আমিও ওদের কল্যাণ কামনা করে পরস্পর বিদায় নিলাম।
[অনাকাঙ্ক্ষিত]
: সেই সময়ের কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কথা কি মনে পড়ে যা তাৎক্ষণিকভাবে আপনাকে পীড়া দিয়েছিল?
:: যুদ্ধে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা অনভিপ্রেত নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক। এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিল যারা আদৌ যুদ্ধ করার ইচ্ছায় যায় নি, প্রাণ বাঁচাতে আর লুটপাটের সুযোগ নিতে গিয়েছে। তেমনি একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। সেটা অবশ্য বাংলাদেশীরা করেনি, মিত্রবাহিনীর সদস্যরা করেছিল। ঘটনাটা ঘটে ১৬ ডিসেম্বর রাতে। বাংলাদেশ তখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। তবুও লোকজন অনেকেই ঘর থেকে বেরুতে ভয় পেত। শহরগুলো সব প্রায় ফাঁকাই ছিল। বেশিরভাগ মানুষ তখনও গ্রামাঞ্চলে, নিরাপদ আশ্রয়ে। যাই হোক, ১৬ ডিসেম্বর যখন আমি আমার দলের বেডিং ও অস্ত্র নিয়ে দু’টি গরুর গাড়ি বোঝাই করে রংপুর শহরে আসি তখন শহর ক্রস করে কলেজে যাব এমন সময় দেখি বড় রাস্তার উপর ৪-৫টি আর্মির গাড়ি লাইন করে দাঁড়ানো। গাড়িগুলো দাঁড়ানো ছিল শহরের বড় দোকানগুলোর সামনে, যেগুলোতে দামি দামি জিনিসপত্র বিক্রি হত। দেখলাম দোকানগুলোর ঝাপ খুলে ইচ্ছেমত গাড়িতে মালামাল লুট করে ভরে নিচ্ছে। আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, শেষে আগুনটা যেন লাগাবেন না। অন্তত এই অনুরোধটা রাখতে বলে আমি মনের কষ্ট মনে নিয়েই চলে আসি।
[স্বাধীনতা-উত্তর ভাবনা]
: স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ নিয়ে কি ভেবেছেন?
:: ভেবেছিলাম, পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে পারলেই আমাদের দেশটাকে আমরা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেব। আমরা দেশের সবাই একসঙ্গে গড়ে তুলব আমাদের ভবিষ্যৎ। সুখে থাকার জন্যই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভেবেছি এবার সেই আকাক্সিক্ষত সুখ নিশ্চিত হবে। আমি মনে করি আমি যে আজো বেঁচে আছি এটা আমার বোনাস লাইফ। শুধু আমি নই যু™েব্দর ময়দান থেকে ফিরে আসা সব যো™ব্দারই বোধ হয় একই ভাবনা আমার মতো। স্বপ্ন জš§ দেয় সম্ভাবনা, আর সম্ভাবনা রূপ পায় বাস্তবে। আমাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা শুধু একটি শব্দ নয়, সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তি। নিপীড়ন, অত্যাচার, লুণ্ঠন, সা¤প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি। আমরা চেয়েছি, এমন একটি দেশ যে দেশ তার সব নাগরিককে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে দেবে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেবে, সুশাসন কায়েম করবে, আইন-কানুন প্রণয়ন করবে, যার পরিণতি একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
: ভাবনা আর বাস্তবতার সমন্বয় ঘটেছে কি?
:: না। সাধারণ মানুষের সেই সুখ যেন অচিন পাখি। দেশের সাধারণ মানুষ আজো তার নাগাল পায়নি। আজো তারা অসহায়, জিম্মি কতিপয় অসাধারণ মানুষের কাছে, যারা স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে দুর্নীতি, খুন ও চাঁদাবাজির মধ্য দিয়ে। ভেবেছিলাম, দেশটা স্বাধীন হলে সংসদের সব মন্ত্রী-এমপি হবে এদেশের মানুষ। ডিসি-এসপি, বড় বড় অফিসার হবে এদেশের মানুষ। তারা সবাই দেশের উন্নতির কথা ভাববে। কিন্তু যা দেখার কথা তা এখনো দেখিনি। এখন দেখছি, যাদের হাতে দেশ তার পরিচালনার ভার দেয়, তারাই তাকে লুটেপুটে খায়। কোনো লাভই হলো না এত রক্তের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতায়।
: নিজের পক্ষ থেকে আপনার এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক প্রচেষ্টা ছিল?
:: চেষ্টার ত্র“টি করিনি। আমি এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্যে অবহেলা করিনি। যুদ্ধের আগে আমি ছিলাম ইপিআর-এ। যুদ্ধের পরে তার নাম হয় বিডিআর। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলÑ আমি আর্মিতে যাব, নাকি বিডিআর-এ থাকব। আমি বলেছি, যেহেতু এই ডিপার্টমেন্ট নিয়ে আমি যুদ্ধ করেছি, সেহেতু আমার মেধা-শ্রম সবই এই ডিপার্টমেন্টকে দিতে চাই। তাই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমি আমার ফোর্সকে গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। অসংখ্য নতুন নতুন সেনাকে ভর্তি করিয়ে নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আর এসব করেছি একজন নাগরিক হিসেবে দেশের ও পেশার প্রতি কর্তব্যের সুবাদে।
[অতঃপর অন্ধকার]
: কি পেলেন বিনিময়ে?
:: অনেক পেয়েছি। বাঙালির জন্যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সুন্দর পতাকা, নিজের দেশের বড় বড় মন্ত্রী, এমপি, অফিসার, সবই তো পেয়েছি। এমনকি দেশ আমাকে বীরÍের জন্য একটি উপাধিও দিয়েছে। আমার নাম এখন ইউ কে চিং বীরবিক্রম। বাহ্ কী সুন্দর নাম! আদিবাসী শত সহস্র মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত ইউ কে চিং র্মামা। অথচ তার পেটে এখন ইঁদুর দৌঁড়ায়, বাইরে বৃষ্টি নামার আগে ঘরে পানি পড়ে। তার কোনো জায়গা-জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তার সন্তানদের কোনো চাকরি-বাকরি নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো তাদের কোনো আয়ের উৎসও নেই। তার সন্তানরা এখন দিনমজুর। এই হলো একটি স্বাধীন দেশের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার হাল-হকিকত। প্রাণবাজী রেখে যুদ্ধ করার বিনিময়ে এইতো পেয়েছি।
: কখনো কি আপনাকে কোনো ধরণের আশ্বাস দিয়েছিল সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন?
:: সরকার থেকে একবার বলা হয়েছিল, যাঁরা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের একটি ঘর করে দেবে। জায়গা জমি দেবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য টাকা দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেসব অঙ্গীকার এখনো অঙ্গীকারের জায়গাতেই রয়ে গেছে।
: স¤প্রতি সম্মানী ভাতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে কি জ্ঞাত আছেন?
:: হ্যাঁ জানি, স¤প্রতি গরিব অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে মাসিক ৫০০ টাকা হারে সম্মানী ভাতা চালু হয়েছে। চাকরি-বাকরিসহ আরো কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আর এটাও জানি, এই সুযোগের আকাক্সক্ষায় প্রতি বছর বেড়ে চলছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। যারা এদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে নিচ্ছে, তারাই আবার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে। আর আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত বীর, আমি আমার ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্যের জন্য হাহাকার করে মরছি। আমাকে কেউ দেখে না। জঙ্গলে থাকি বলে কেউ খোঁজও নেয় না। সচ্ছল হলে তো কখনোই চাইতে যেতাম না ৫০০ টাকার সম্মানী ভাতা। অসচ্ছল বলেই চাইতে গিয়েছি। আমাকে সম্মানী ভাতা দেয়ার জন্য বই-খাতা সব প্রস্তুতও হয়েছে। এরই মধ্যে শঙ্কর কুমার চৌধুরী নামক এক অফিসার আমার ছবি দেখে বললেন, উনি তো পেনশন পান, সম্মানী ভাতা তাকে দেয়া যাবে না। আমি বললাম, দেখুন স্যার, আমি চাকরি করেছি বলে পেনশন পাই। দীর্ঘ নয় মাস যে রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করলাম, তার জন্য কি এই সামান্য সম্মানটা পেতে পারি না? সরকার কেন এই অসহায়, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাকে তা দেবে না? যুদ্ধের সময় তো মাটি আর গাছ ছাড়া একটি কাকও দেখতে পাইনি। আর আজ কত দাবিদার, শুধু আমি ঠাঁই পাই না।
ইউ কে চিং মারমা ৬নং সেক্টরে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল বাশার এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার সুবেদার আরব আলী, সুবেদার বোরহান উদ্দিনের অধীনে নিজে দলীয় কমান্ডার হিসেবে পরিচালনা করেছেন অসংখ্য অপারেশন। অধিকাংশ অপারেশনেই স্বীয় মেধা-মনন, কৌশল এবং বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বের কারণে অর্জন করেছেন সফলতা, ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা। পেয়েছেন বীরবিক্রম খেতাব। কিন্তু পাননি এখনো ভালোভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন, সামান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা। চরম আর্থিক দিনতায় হতাশ বীর মুক্তিযোদ্ধার এই কি যথাযথ সম্মান?
চারু হক
জুন, ২০০৭
লাঙ্গিপাড়া, বান্দরবান পার্বত্য জেলা
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:০৬