By-- স্বপ্না ইসলাম ছোঁয়া।।
-এক্সকিউজ মি, কি এমন লিখছ ডায়েরী'তে,
এতবার ডাকলাম শুনতে পাওনি?
বলেই ছোঁ মেরে ডায়েরী'টা নিয়ে নিল রাতুল।
মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পুরো হতভম্ব হয়ে গেল নীরা।
সে হাত বাড়িয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু এইটুকু বলল,
-প্লিজ, আমার ডায়েরী'টা পড়ো না। তাছাড়া একজনের ডায়েরী
অন্যজনে বিনা অনুমতিতে পড়া নিষেধ এইটুকুও জানো না?
নীরার দু'চোখ ভরে অভিমানের জল টলমল করছে।
আস্তে আস্তে হার্টবিট বেড়ে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে,
এই ছেলেটাকে দেখলেই সে ক্রমশঃ তলিয়ে যেতে থাকে
অজানা,অচেনা অন্য এক জগতে। রাতুল আর নীরা একই
ব্যাচে পড়ে। বি,এ প্রথম বর্ষ। কিন্তু দুজনের কলেজ ভিন্ন।
রাতুল এখানের স্থায়ী বাসিন্দা, নীরা মামার বাড়ি থেকে পড়ালেখা
করছে। মাঝে মাঝেই রাতুলের কলেজ বন্ধ থাকলে সে নীরাদের
কলেজে আসে, হয় বেড়াতে পুরনো বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে,
নয়ত কোন অকেশনে। রাতুলকে নিয়ে এই কলেজের বেশির ভাগ
মেয়েই কল্পনায় রোম্যান্টিক জগতে ঘুরে বেড়ায়। স্বপ্ন দেখাটাই
স্বাভাবিক, শ্যামলা রঙের ছয় ফুটের কাছাকাছি এই ছেলেটা
দেখতে এতোটাই আকর্ষণীয় যে, যেকোন মেয়েরই মাথা নষ্ট হয়ে যায়।
নীরাও সেই দলের মধ্যে একজন। কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখে
রাতুলের কাছ থেকে, কারন, একই কলেজে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে
পড়া সুমির সাথে রাতুলের প্রেম সবাই জানে। কাজেই,এ ব্যাপারে
না এগোনোই ভাল। কিন্তু মন এত ব্যাকুল
কেন তার কথা শুনলেই? তাকে দেখলেই নীরার হার্টবিট এত
ওঠানামা করে কেন? এটা তো কিছুতেই কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না।
নীরার সাথে রাতুলের প্রথম আলাপ হয় রাজনীতি অঙ্গনে পা রাখার
প্রথম দিনই। রাতুলকে এক সিনিয়র বড় ভাই বলে দিলেন,
রাতুল যেন নীরাকে উপযুক্ত করে তোলে এবারের কলেজ নির্বাচনে।
কিসের কি! রাতুল নীরাকে যতই বোঝাতে চেষ্টা করে কিভাবে
রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা যায়, সাফল্য লাভ করা যায়। নীরা যেন
ততই হারিয়ে যায় অন্য জগতে। সেখানে রাতুলকে ছাড়া আর
কাউকেই দেখতে পায় না। দু'জন মুখোমুখি বসে পার করে
দিচ্ছে অফুরন্ত সময়। কল্পনার জগতটা এত সুন্দর হয় কেন?
-কি ভাবছ? বললে না, কি লিখছ?
-কি লিখছি সেটা তোমার না জানলেও চলবে, প্লিজ
ডায়েরীটা দিয়ে দাও। কলেজ ছুটি হয়ে গেছে আমি বাড়ি যাব।
ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলে মেয়েই চলে গেছে ছুটি হওয়ার সাথে সাথে।
শুধু নীরা আর ৭-৮ জন ছেলেমেয়ে আছে এখনও। কেউ কেউ
ক্যারাম খেলছে বেঞ্চের উপর বসে বসে, আবার কেউ কেউ আড্ডায়
মশগুল। আজ ছুটির আগের পিরিয়ড টা অফ গেছে, তাই নীরা
ডায়েরীতে কোটেশন লিখছে। এই এক বদভ্যাস ওর। ক্লাসের
ফাঁকে ফাঁকে ডায়েরীতে কোটেশন লিখা আর নয়ত পেন্সিল নিয়ে
চোখ আঁকা। বড় বড় দুটো কাজল কালো চোখ আঁকবে। বন্ধুরা
দুষ্টুমি করে বলে,
-গরুর চোখ আঁকলি কেন? অবশ্য তোর চোখও অমনই।
এই নিয়ে বন্ধুদের সাথে প্রায়ই খুনসুটি হয় নীরার।
চোখ আঁকতে এত্ত ভাল লাগে কেন,নিজেও জানে না।
আর কোটেশনে লিখে, বিখ্যাত মনিষীদের বাণী,
নয়ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুটো লাইন।
আজ লিখেছে-
"ভালোবেসে সখা নিভৃত যতনে,
তোমার নামটি লিখেছি মনের মন্দিরে"
কার উদ্দেশ্যে এটা লিখল, সেটাও সে ভেবে পাচ্ছে না।
এরইমধ্যে এই ছেলেটা এসে হানা দিল।
কিছু বলতেও পারছে না সে, মনে হচ্ছে মুখে কেউ
দামী ব্র্যান্ডের স্কচট্যাপ লাগিয়ে দিয়েছে। কিছু একটা করতেই হবে।
নইলে যদি সে ডায়েরীটা পড়া শুরু করে?
এইরে! এটা ভাবতেই অস্পৃশ্য এক উষ্ণ অনুভূতি ছুঁয়ে গেল,
মাথা থেকে মেরুদণ্ডের শেষ মাথা পর্যন্ত।
ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ ঢেউ খেলে যাচ্ছে আপাদমস্তকে।
মনে হচ্ছে পায়ের তলায় কেউ উনুন জ্বালিয়ে রেখেছে।
রাগে, অপমানে নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করছে।
সব কিছুই কি সবাইকে জানতে দিতে হবে? কিছু কথা,কিছু ফিলিংস
শুধুই একান্ত নিজের করে রাখতে হয়। নইলে, এই দামী ফিলিংসটুকু
প্রকাশ হবার পর এতোটা যতনে রাখা যায় না, সস্তা হয়ে যায়।
মাথা নিচু করে বেঞ্চের উপর কলম দিয়ে খোঁচাচ্ছে সে।
চোখ তোলে রাতুলের দিকে তাকাবার সাহস সে হারিয়ে ফেলেছে
সূচনালগ্নেই। চাপা স্বভাবের কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের মনের
প্রতিচ্ছবি হচ্ছে চোখ। এরা হাসলে চোখ হাসে।
এদের মন খারাপ থাকলেও চোখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট আকার
ধারণ করে। নীরা হচ্ছে সেই দলের মানুষ।
এক্ষুনি যদি রাতুল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনের না বলা কথা গুলো
অনর্গল পড়তে শুরু করে? তাহলে লজ্জার আর অবশিষ্ট কিছু থাকবে না।
তারচেয়ে বরং এই ভাল, মাথা নিচু করে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব এড়িয়ে
যেতে পারছে।
রাতুল অনেকটা হৈ-হুল্লোড় করা টাইপের ছেলে।
এরা গোপনীয়তা বজায় রেখে চলতে পারে না।
এদের মনে অবশ্য প্যাঁচও নেই তেমন।রাখঢাক ছেড়েই এরা
জীবন পথে চলতে অভ্যস্ত। কোন বদনামই এদের স্পর্শ করতে
পারে না, এরা এসবকে সুযোগও দেয় না।
কিন্তু নীরা সম্পূর্ণ অন্য ছাঁচে তৈরি। ওকে কেউ
ইঙ্গিত করে কিছু একটা বলবে, সেই কিছু একটাও
সে বরদাস্ত করতে পারে না, বা পারবেও না ভবিষ্যতে।
রাতুল ঠোঁট উল্টে বলল,
-ঠিক আছে, যখন বলবে না তখন ডায়েরী'টা
আমার দখলেই থাকুক।
এই বলে রাতুল হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
নীরা লাফ দিয়ে ওঠে রাতুলের পথ আগলে দাঁড়ায়।
এবার বেশ রুক্ষ স্বরেই বলে বসে,
-বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি কেন আমার ডায়েরী
পড়বে? সেই অধিকার কি তোমায় দিয়েছি আমি?
ক্লাসের বাকি ছেলেমেয়ে গুলোর নজর এইবার
এদের দুজনের দিকে আটকে গেছে।
কেউ কেউ বলছে,
-এই রাতুল, তুই এটা ঠিক করছিস না,
নীরার ডায়েরী'টা দিয়ে দে বলছি।
এদের মধ্যে একজন ছেলে নীরাকে খুব পছন্দ করে,
কিন্তু নীরা ওকে একজন ফ্রেন্ড ছাড়া কিছুই
ভাবে না। সে এগিয়ে এল রাতুলের কাছে।
এসেই বলল,
-ডায়েরী'টা ফেরত দিয়ে দে, নীরা
বাসায় চলে যাবে। আর কোন শয়তানী করিস না, প্লিজ।
রাতুল ডায়েরী'টা নিয়ে আস্তে আস্তে ক্লাসের জানালার
কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপরই হঠাৎ নীরাকে বলে
বসলো,
-তুমি সবার সামনে শুধু একবার বলো,
'আমি তোমাকে ভালোবাসি।' ব্যাস-
আর কিচ্ছু চাইব না। ডায়েরী'টা দিয়ে দেব। প্রমিস।
নীরা এ কি শুনছে! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
লজ্জায়, অপমানে ওর খুব কান্না পাচ্ছিল।
এতক্ষন যেটা ফাজলামি হিসেবে ধরে নিয়েছিল,
সেটা এখন কোন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করালো?
সে গম্ভীর গলায় বলল,
- অনেক হয়েছে রাতুল, প্লিজ স্টপ দিস ইডিয়টিক গেইম।
আমার আর এসব কন্টিনিউ করতে ভালো লাগছে না।
তুমি ভাবলে কি করে? আমি তোমায় এই কথা'টা বলব?
পুরো ক্লাস পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে আছে। সবাই স্তব্ধ।
এটা কি রাতুলের শুধুই ফাজলামো নাকি সে সত্যিই সিরিয়াস?
সবাই এটাই ভাবছে।
রাতুল দৃঢ় চিত্তে বলে ওঠলো,
-তুমি আমায় ভালোবাসো, এইজন্যে বলবে।
নীরা ঘোর আপত্তি জানাল, সে রাতুল'কে
ভালোবাসে না। বলার প্রশ্নই আসে না।
রাতুল খুব জেদ ধরে বসলো,
-তুমি যে আমায় ভালোবাসো, সেটা আমি প্রথম দিনই
বুঝে গেছি, তোমার চোখে সেই বার্তা আমি দেখতে পেয়েছি,
কিন্তু চুপ করে ছিলাম। তোমার মুখ থেকে
সত্যিটা শুনতে চাই। বলো প্লিজ-
নীরা আর কথা বাড়াতে রাজী হচ্ছিল না,
বেশ কঠোর হয়েই শেষ বারের মত অনুরোধ করল।
কাজ হল না।
নীরা এবার মুখ তুলে রাতুলের চোখে চোখ রাখল,
এবং বলল, তুমি তো সুমির সাথে এনগেজড,
তারপরও আমার সাথে এমন ফ্লার্ট করছ কেন?
লজ্জা করছে না তোমার?
রাতুল দ্বিধা সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলেই বলল,
-নাহ, একটুও লজ্জা করছে না। সত্যি যেটা
সেটা সবার সামনেই আসুক। তারপর ভাববো
আমি কি করব না করব। এখন তুমি আমার
বিশ্বাসটা কে নষ্ট হতে দিও না, প্লিজ,
শুধু একবার বলো ভালোবাসো আমায়,
আমি আর কিচ্ছু চাইব না। অনেক বাক বিতণ্ডা'র পর,
নীরা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না,
সবার সামনেই বলে দিল,
-' হ্যাঁ আমি তোমাকে ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি।'
নীরা কাঁদছে, সারা শরীর দুলে দুলে ওঠছে ওর কান্নার
ঢেউয়ে। মাথার ভিতর কে যেন হাতুড়ীপেটা করছে। আর কিছু
ভাবতে পারছে না। কোন কথাও তার কানে আসছে না,
ক্লাসমেটদের ফিসফিস, কানাকানি সব কিছুর উর্দ্ধে চলে গেছে সে।
রাতুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে
কিছু একটা জয় করে ফেলেছে, চোখে মুখে আনন্দের ছিটেফোঁটা।
নীরার হাতটা টেনে নিজের কাছে নিল,
টুপ করে ওর হাতে ডায়েরী'টা গুঁজে দিয়ে,
নিচু গলায় বলে গেল,
-'মেয়ে, ভালোবাসার মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে নেই,
ছিনিয়ে নিতে হয়, জোর করেই আদায় করে নিতে হয়।
ভালোবাসায় এতোটা উদার হওয়া ঠিক না, কিছুই পাবে না তাহলে।
আমি অর্জন করে নিয়ে গেলাম, তোমার অস্তিত্বের সবটুকু।
এবার তোমার পালা। চলি, ভালো থেকো, অন্তত আমার জন্য হলেও।'
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৭