চৈত্রের শেষ দাবদাহে অতিষ্ঠ
হয়ে হাঁসফাঁস করে হাসুর মা;
'আসমান ফাইট্যা মনে অয় রইদ
পড়ে গো হাসু, বোশেখ মাসেও
দ্যাখবি গরমের কি তেজ!' কথাগুলো
বলে সদ্য স্নান সেরে আসা হাসুর মা
ভেজা কাপড় চিপে পানি ফেলে
ঘরের দাওয়ায়;
হাসুর সামনে মাটির বাসনে
মোটা চালের পান্তাভাত,
একটা ছোট্ট বাটিতে কচুরলতি
দিয়ে নোনা ইলিশ রান্না করা।
রাগে ফুঁসছে হাসু, প্রকৃতির সমস্ত
খরা তার চান্দির মধ্যে চড়চড় করছে।
চোখ ফেটে ফোঁটা ফোঁটা পানি
বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পান্তাভাতে যোগ হচ্ছে,
গলা চড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে-
'আম্মা, তোমারে না কইলাম,
বাপজানরে কইতে, উত্তর পাড়ার
ময়নাল এর বাপের মত রূপালী
রঙের ইলশা মাছ আনতে।
তুমি কও নাই? কি আনছে বাপজান
এগুলা,আমি খামু না।'
ঠ্যালা দিয়ে সরিয়ে রাখে মাটির প্লেটখানি।
ভেজা কাপড় মেলে দিতে দিতেই
হাসুর কথাগুলো শুনতে পায় তার মা।
বাসি ঘর,উঠোন ঝাড় দিয়ে গোসল
সেরে এসেছে একটু আগে।
নিঙড়ানো পানি শুকিয়ে যাবার আগেই
মাটিতে নেমে আসে দুটো শালিখ।
হূটোপুটি করে ঠোঁট ডুবিয়ে দু'ফোঁটা
পানি চটজলদি তুলে নেয়।
ঘরের চালে চ্যালাকাঠ শুকোতে দেয়া আছে,
ইচ্ছে করছে ওখান থেকে একটা
কাঠ নামিয়ে নিজের মাথা নিজেই
ফাটাতে।
অবুঝ ছেলেকে কি করে বোঝাবে বাবার
অসামর্থ্যের কথা।
বিরস মুখে ঘরে ঢুকে হাসুর মা,
ছেলেকে প্রশ্ন করে-
'বাজান ক' তো সোনার দাম বেশি
না-কি রূপার দাম বেশি?'
হাসু মায়ের আঁচলে চোখ মোছে।
ঠোঁট উল্টিয়ে বলে- 'মনে অয় সোনার
দামই বেশি মা, তা নাইলে কি বাপজান
তোমারে সোনা রাইখা রূপা দিয়া
হাতের বয়লা বানাইয়া দেয়?'
মা নড়েচড়ে বসে, 'দ্যাখছস বাজান,
তুই কত্ত বুদ্ধিমান পোলা আমার,
জলদি কইরা বুইঝা ফালাইলি।'
হাসু বোঝেনা, কেন তার মা এসব বলছে।
ছেলেকে কাছে টেনে বসায় মা,
শোন বাজান- 'সোনার দাম যেমন
বেশি, তেমনি সোনালী ইলশার দামও
বেশি, হেগোর ইলশা রূপার মত, দাম কম। আমাগো ইলশা সোনার মত চকচকা, তাই
নুন দিয়া বেডারা মাছের গতর ঢাইকা রাখছে,
যাতে কারোর নজর না লাগে।'
ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে হাসু বলে,
' কিন্তু মা, ময়নালের বাপে যহন অই ইলশা ডা আনল,তহন তো কত্ত মানুষ
হেরে ঘিরা ধইরা দাম জিগাইল,
কই আমার বাপরে তো কেউ দাম জিগাইল না?'
হাসুর মা মনে মনে ছেলের বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না।এইটুকু
ছেলের কি নিখুঁত বিশ্লেষণ। দামী আর সস্তার পার্থক্যটা শিখে ফেলেছে সে।
লম্বা শ্বাস ছেঁড়ে ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন,
'উদলা জিনিসের দাম তো মানুষ জিগাইবই, রূপা উদলা রাখলে সমস্যা নাই, সোনা ঢাইকা রাখতে হয় বাপ,
তাই তোর বাপে কলাপাতায় মোড়ানো
ইলশা আনছে। যাতে কারোর নজর না লাগে। আমরা এইসব দিয়াই বোশেখ পালন করমু বাজান।'
মায়ের কথাগুলো বিশ্বাস করতে মন সাঁয় দিচ্ছে হাসুর।মা'রা কি কখনো মিথ্যে কথা বলতে পারে!!
বাধ্য ছেলের মত পান্তাভাত খেতে বসে
হাসু, মনে মনে এক প্রশান্তি ঢেউ খেলে যায়।
এই মুহুর্তে মায়ের হাতে রান্নাকরা নোনাইলশা তরকারিটাই এত্ত মজা লাগে, সব চেটেপুটে খেলেও
হাসুর যেন তিয়াস মিটবে না।]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৬