এই পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে বহু জ্ঞানী, গুনী ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছিল। এই সকল জ্ঞানী, গুনী ব্যক্তিরা তাদের মেধা,বৃত্তি ও মনন দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পৃথিবীর জন্য , পৃথিবীর মানুষের জন্য অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন , আবার অনেক জ্ঞানী প্রতিভাবান ব্যক্তি সৃষ্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ পর্যন্ত করে গেছেন। আজ এমনি ১০ জন প্রতিভাধর ত্যাগী ব্যক্তির সমন্ধে সংক্ষেপে আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
১.মাদাম কুরি ( মেরি কুরি)ঃ রসায়ন শাস্ত্রে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য দুই বার নোবেল পুরুস্কার লাভ করেন এই বিদুষী নারী মাদাম কুরি ( মেরি কুরি )। তেজস্ক্রিয়তার ময়দানে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিষয়ে প্রথম মৃত্তিকাখনক বা পথপ্রবর্তক হিসাবে পোল্যান্ডের বংশভূত ফ্রান্সের নাগরিক মাদাম কুরির আবিস্কৃত সূত্র বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানেও নানাবিধ ব্যবহার হয়ে থাকে। তিনি হচ্ছেন মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি দুইবার নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে এসে এই মহিয়সী নারী আবিস্কারের নেশায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সোপর্দ করেন গবেষনার কার্যে । দিনরাত বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভুলে যান নিজের দেহ ও স্বাস্থের কথা। এইভাবে নিজের শরীরকে অবজ্ঞা করার কারণে কোনো একসময় তার দেহে বাসা বাধে মরণঘাতী রোগ আর তেজষ্ক্রিয় রশ্মির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় দুই চোখের জ্যোতি হারিয়ে হয়ে যান সম্পূর্ণ অন্ধ। অবশেষে ১৯৩৪ সালে এই ক্ষণজন্মা নারী মৃত্যু বরণ করেন।
২.অট্টলিলিয়েনথালঃ বিমান চালনার কৌশল বা বিদ্যায় যে সকল পথপ্রবর্তকদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদেরই মধ্যে একজন এই জার্মানির প্রকৌশলী ও বৈমানিক অট্টলিলিয়েনথাল। এই প্রতিভাবান বৈমানিক ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ২ হাজারেরও অধিক ফ্লাইট অত্যন্ত সফলতার সাথে সমাপ্ত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ১৮৯৬ সালের ৯ আগস্ট তার উপর নেমে আসে অশুভের কালোছায়া। সেদিন একটি বিমান পরিচালনা করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবসত ১৭ মিটার উচ্চতা থেকে বিমানসহ নিচে পরে গিয়ে তিনি গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যায় , চিকিৎসার জন্য তাকে দ্রুত বার্লিন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলেও এই প্রতিভাবান উদ্ভাবককে বাচাঁনো সম্ভব হয় না। মৃত্যুর প্রাক্কালে প্রতিভাবান ত্যাগী বিজ্ঞানী বলে গিয়েছিলেন "প্রয়োজনের খাতিরে সবসময় ছোট খাটো কিছু উৎসর্গ করতে হয় "।
৩. টমাস মিডগ্লেইঃ এই প্রতিভাবান ব্যক্তিটি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রর একজন প্রকৌশলী। প্রথম জীবনে প্রকৌশলী হলেও শেষ জীবনে তিনি রসায়ন শাস্ত্রে গবেষণা করে পেট্রোল ও সীসা বিষয়ক প্রভূত উন্নতি ও সম্প্রসারিত করেন। রসায়নবিদ্যায় গবেষণাকালে একসময় তিনি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়েন। কিন্তু তার এই শারীরিক দুর্বলতা তার ভেতরের আবিস্কারের ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি।
তিনি একসময় হাসপাতালের পঙ্গু ও অক্ষম রোগীরা বিছানা থেকে যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী সহজে উঠতে পারে সেজন্য মাথা খাটিয়ে বিছানায় রজ্জু ও কপিকল স্থাপন করার চিন্তা বার করলেন। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৪৪ সালের ২ নভেম্বর টমাস তার কঠিন উদ্ভাবনটির কার্যকারিতা সশরীরে পরীক্ষা করতে গিয়ে কপিকলের রশি তার গলায় পেঁচিয়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তিনি স্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান ।
৪.আলেকজান্ডার বোগডানোভঃ রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে মানব দেহে পুনর্যৌবন লাভ ও পুনরুজ্জীবন লাভের লক্ষে বিরামহীন গবেষণা চালিয়ে গেছেন বেলোরুশিয়ার বিদ্বান ব্যক্তি আলেকজান্ডার বোগডানোভ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধনকারী বোগডানোভ পুনরুজ্জীবন লাভ করার মত অভাবনীয় আবিস্কারের আশায় তিনি তার নিজ দেহে ১১ বার রক্ত পরিসঞ্চালন করেছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস ১৯২৮ সালে তার এক ছাত্র, যক্ষা ও ম্যালেরিয়ার রোগীর রক্ত নিজ দেহে পরিসঞ্চালন করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৭ এপ্রিল ১৯২৮ সালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ।
৫.উইলিয়াম বুলোকঃ যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিভাবান ব্যক্তিটি ১৮৬৩ সালে সংবাদ ছাপার ঘূর্ণনশীল মেশিন বা রোটারি মেশিন আবিস্কার করে উনবিংশ শতাব্দীর প্রিন্ট মিডিয়ায় অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিলেন । কিন্তু ভাগ্যের লিখন তারই আবিস্কৃত মেশিনের কারণে তাকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয় । ১৮৬৭ সালে ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় তার রোটারি মেশিনের গিয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেশিনের একটি রোল গড়িয়ে তার পায়ের উপর পরে এবং সাথে সাথে তার পা দুটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সেবা ও চিকিৎসার অভাবে এই হতভাগ্য প্রতিভাবানের পা দুটি পচন ধরে। অবশেষে ডাক্তারগণ বুলোক এর দুটি পা কেটে আলাদা করার দিনক্ষণ ঠিক করেন কিন্তু বুলোক তার আগেই ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান ।
৬.ফ্রান্জ রেইচেল্টঃ অট্রিয়ার দর্জি ফ্রান্জ রেইচেল্ট প্যারাসুট কোট আবিস্কারক হিসাবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি তার আবিস্কৃত কোটাখানা পড়ে কোনো উচ্চস্থান থেকে লাফিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে নামতে পারতেন। অবশ্য এর আগেও তার এ ধরনের কয়েকটি প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ১৯১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী তার জীবনের অন্তিম মহুর্ত্ত এসে হাজির হয় যখন তিনি প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে বিশাল দর্শক সমাগম করে তার আবিস্কারটি প্রদর্শনের উদ্যোগ নেন। ফ্রান্জ রেইচেল্ট তার প্যারাসুট পড়ে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের প্রথম ডেক থেকে নিচে ঝাপিয়ে পড়েন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার প্যারাসুটটি উন্মুক্ত না হওয়ার কারণে মাটিতে পড়ে তিনি সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করেন।
৭.[sbজিমি হেসেল্ডেনঃ ] সেগওয়ে নামক আধুনিক দুই চাকাওয়ালা গাড়ী কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন এই ব্রিটিশ ধনকুবের জিমি হেসেল্ডেন। জিমি হেসেল্ডেন গতবছর ২৬ সেপ্টেম্বর মাসে তার কোম্পানির সর্বশেষ মডেলের দুই চাকা বিশিষ্ট গাড়ী চালানোর সময় তার বাড়ীর পার্শ্ববর্তী একটি নদীতে পড়ে মৃতুবরণ করেন। এই ধনকুবের জিমি হেসেল্ডেন এর সম্পদের পরিমান ছিল ১৬৬ মিনিয়ন পাউন্ড।
৮. আওরেল ভ্লাইকোঃ রোমানিয়ার এই প্রতিভাবান প্রকৌশলী ও বৈমানিক ১৫ জুন ১৮৮২ সালে জন্মগ্রহন করেন। জীবনের শুরু থেকেই বিমানচালনা ও বিমান চালনাবিদ্যার উপর ছিল তার দারুন নেশা কিন্তু কখনই তিনি কল্পনা করতে পারেননি স্বল্প বয়সে একদিন এই নেশাই তাকে তার সমাধিতে নিয়ে যাবে। এই প্রতিভাবান বৈমানিক বেশকয়েকটি এ্যারিয়েল বিমানের আদিরূপ বিমান তৈরী করেন এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে বিমান উড্ডায়ন ও অবতরণ পরীক্ষা সম্পন্ন করেন । ১৯১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল তার জীবনে চরম এবং শেষ দুর্যোগের দিন। সেদিন নিজের আবিস্কৃত বিমান "ভ্লাইকো II নিয়ে আকাশে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ বিমানের ইঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দিলে উদ্ভাবক চেষ্টা করেও বিমানকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হন। বিমানটি কার্পাথিয়ান পাহাড়ের গায়ে লেগে বিধ্বস্ত হয় এবং সেই সাথে প্রতিভাবান তরুণ আওরেল ভ্লাইকোর জীবনের অবসান ঘটে ।
৯.ভ্যালেরিয়ান আবাকোসস্কিঃ ১৮৯৫ সালে রাশিয়ায় এই উদীয়মান উদ্ভাবক জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তখনকার "এ্যারো ওয়াগেন" নামে দ্রুত গতিসম্পন্ন বিলাসবহুল রেলগাড়ির আবিস্কারক। ভ্যালেরিয়ান আবেকভস্কি তখনকার রাশিয়ার নামিদামি রাজনীতিকদের বিলাস ভ্রমণের কথা মাথায় রেখে এই দ্রুতগতির রেল ইঞ্জিন তৈরী করেছিলেন। বর্তমানে যে সকল দ্রুতগতি সম্পন্ন যানবাহনে এম-৪৭ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, ভ্যালেরিয়ানের ইঞ্জিন ছিল তার আদিরূপ।
২৪ জুলাই ১৯২১ সাল ছিল ভ্যালেরিয়ান এর রেলগাড়ি পরীক্ষার ১ম দিন। সেদিন ভ্যালেরিয়ানসহ রাশিয়ার ৬ জন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি এই রেলগাড়িতে আহরণ করেন। দ্রুতগতিতে রেলগাড়িটি চলার সময় এক পর্যায়ে চালক তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং রেল গাড়িটি লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। সেই সাথে জীবনের অবসান ঘটে ৬ জন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিসহ ভ্যালেরিয়ান আবাকোসস্কির।
১০. ডোনাল্ড ক্যাম্পবেলঃ ব্রিটিশ রেসার। তিনি ছিলেন ৫০ দশকে জলে ও স্থলে গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতায় একের পর এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকারী । তিনি প্রতিযোগিতায় যে জলযান ব্যবহার করতেন সেটার নামছিল ব্লু বার্ড -কে ৭ এবং এই গাড়িটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৩ শত মাইল। কিন্তু তার নেশা ছিল কিভাবে গতি আরো বৃদ্ধি করা যায় এবং দ্রুত জয় ছিনিয়ে আনা যায়। ১৯৬৭ সালের ৪ জানুয়ারী একটি প্রতিযোগিতায় ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল কৌশল প্রয়োগ করে তার গাড়ির গতি ঘন্টায় ৩ শত মাইল থেকে ৩৩০ মাইল বাড়িয়ে দেন ফলে জলযানটি ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে উল্টে যায় এবং একই সাথে নিভে যায় ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল এর জীবনের প্রদীপ ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:৩৯