somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দূর্ভেদ্য দেয়াল

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বকর সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন।তাঁর নতুন মডেলের দামী গাড়ি টি মসজিদের গেটের বাইরেই অপেক্ষা করছে।তিনি ভাবলেন বাসায় ফেরার পথে হাইওয়ে সুইটস থেকে দুকেজি স্পঞ্জ মিষ্টি আর দুকেজি গাজরের হালুয়া কিনে নিয়ে যাবেন। দশ লাখ টাকার নগদ চেক টা তিনি আজকেই হাতে পেয়েছেন। সামনে মেয়ের বিয়ে। মেয়ের বিয়েতে টাকা টা কাজে লাগবে।

গাড়িতে উঠে পেছনের সীটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন বকর সাহেব। তাঁর মন ফুরফুরে মেঘের মতই মুক্ত। যে গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে তিনি টাকাটা নিয়েছেন তারা কোটি কোটি টাকার মালিক। যে প্রজেক্টের ছাড়পত্র দেবার বিনিময়ে তিনি দশ লাখ টাকা নিয়েছেন সেই প্রজেক্টের বাজেট বারশ কোটি টাকা। দশ লাখ টাকা বারশ কোটি টাকার কত পারসেন্ট? আই পডে রবীন্দ্র সঙ্গীত চালিয়ে দিলেন বকর সাহেব। ‘ আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রান/ সুরের বাঁধনে’ শুনতে শুনতে বকর সাহেবের মনে হল তিনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন। তিনি ত টাকা খেয়ে কোন হেরোইন বানানোর প্রজেক্ট করার অনুমতি দেন নাই। এটি ওষুধ কারখানার প্রজেক্ট। এদের ওষুধ খেয়ে ভবিষ্যতে কত শত রোগী বাঁচবে। সেই সব রোগীদের জীবনের তুলনায় ও ত দশ লাখ টাকা কিছু নয়! সিটে সিনা টান করে বসে খামাকাই একবার ডাইনে আরেকবার বাঁয়ে তাকালেন তিনি। তাঁর মনে হতে লাগল- তিনি একজন মহান মানুষ। এই দশ লাখ টাকা থেকে এক হাজার টাকা গ্রামের মসজিদে দান করে মহান হবার ব্যাপার টাকে একেবারে সত্যায়িত করে ফেলা যায়!

বাড়িতে ফিরে স্ত্রী পুত্র কন্যা সহ লাক্ষা মাছের তরকারী দিয়ে পেট ভরে ঝোল ভাত খেলেন বকর সাহেব। লাক্ষা মাছ পাঠিয়েছে কন্টাক্টর খোরশেদ। তাঁর পর্যায়ের কাউকে শুরুতেই কন্টাক্টর খোরশেদ লেভেলের কেউ টাকা অফার করতে পারে না।তাঁর অতি প্রিয় লাক্ষা মাছ পাঠিয়ে খোরশেদ প্রমাণ করেছে সে ভদ্রতা জানে। আর ভদ্রলোকদের কাজ পেতে সাহায্য করার মধ্যে ত অন্যায় কিছু নেই! লাক্ষা শুঁটকির টুকরা দাঁত দিয়ে চিপে রস বের করতে করতে বকর সাহেব গভীর সুখ অনুভব করলেন।চোখের সামনে বসা তাঁর ফুটফুটে পরির মত মেয়েটা মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে, পাকা আপেলের মত রাঙ্গা ছেলেটা এ লেভেল পরীক্ষা দেবে এবার। এ লেভেল পাশ করলেই ছেলেকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেবেন। তাঁর ত টাকার অভাব নাই। আর? কি হবে এই দেশে থেকে!দেশ ত রসাতলে গেছে!!

খাওয়া দাওয়া শেষ করে এশার নামাজ পড়ে বুকে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন বকর সাহেব।


(২)
ফরিদ সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন।তিনি তাঁর স্যান্ডেল জোড়া মসজিদের বারান্দার বাইরে রেখে এসেছেন। বারান্দা পার হয়ে আসতে আসতে তাঁর বুক ধবক করে উঠল! গত শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদের বারান্দা থেকে স্যান্ডেল চুরি গেছে। এই জোড়াও হারানো গেলে তাঁকে মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত স্রেফ খালি পায়ে অফিস করতে হবে। মাস শেষ হতে আরো সাত দিন বাকী। ঘরে কোনমতে টেনেটুনে এই সাত দিনের বাজার খরচ আর একমাত্র মেয়ের টায়ফয়েডের ওষুধ কিনার টাকা আছে। পনের দিনের টায়ফয়েডে বিবাহ যোগ্য মেয়েটা শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে। ফরিদ সাহেবের বুক চিরে একটা দীর্ঘঃশ্বাস বের হয়ে আসল। ভাল করে ফল ফ্রুট খাওয়াতে পারলে মেয়েটা হয়ত আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেতে পারত। কিন্তু ফল ফ্রুটের যে অনেক দাম!

স্যান্ডেল চুরি যায় নি দেখে ফরিদ সাহেবের চেহারা মুহুর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি খামোকাই হাত তালি দেবার ভঙ্গিতে এক স্যান্ডেলের তলা দিয়ে আরেক স্যান্ডেলের তলায় বাড়ি দিলেন! তারপর স্যান্ডেল পরে হন হন করে বাসার দিকে হাঁটা দিলেন। বাসা মোটে বিশ মিনিটের রাস্তা। হেঁটে গেলে শরীরের জন্য উপকার। রিকশা ভাড়াও বাঁচে!

হাঁটতে হাঁটতে ফরিদ সাহেব ভাবলেন বাসায় যাবার সময় ছোট ছেলেটার জন্য পাঁচ টাকার বাদাম বুট আর মেয়ের জন্য মোড়ের দোকান থেকে একটা ডিম কিনে নিয়ে যাবেন। একটা ডিম কিনতে কিছুটা লজ্জা লাগে। কিন্তু কি করা যাবে? একটা ডিমের দাম ই ত দশ টাকা!

অথচ আজকে তিনি চাইলেই এক টাকাও খরচ না করে দু কেজি আপেল, দু কেজি মোসাম্বি, আস্ত হরলিক্সের টিন মেয়ের জন্য নিয়ে আসতে পারতেন। এসব খেতে পারলে মেয়েটা নিশ্চয় তার দুর্বল শরীরে একটু হলেও শক্তি ফিরে পেত। অফিসে যে কাজ টা করা ফরিদ সাহেবের দায়িত্ব সেটা করার জন্য ই এক লোক ফরিদ সাহেব কে এসব বিনা পয়সায় সেধেছিল! সে লোক ফরিদ সাহেবের মেয়ের অসুস্থতার খবর কেমনে জানল জিজ্ঞেস করায় ধুর্তামির হাসি হেসে বলেছে- ‘আরে ফরিদ ভাই, আপনি হলেন আমার ভাই। ভাই এর খবর ভাই না জানবে ত কে জানবে?’

ফরিদ সাহেব যে পদে চাকরি করেন সে পদ থেকে কাউকে অন্যায় সুযোগ সুবিধা দেয়া সম্ভব না। কারন তাঁর সিগনেচারের সে অর্থে কোন দাম নাই। তিনি নিতান্তই কেরানী এবং তাঁর কাজ শুধু ফাইলের কাগজ পত্র সব আছে কিনা চেক করে ফাইল উপরে ‘পুট আপ’ দেয়া। কোন অকাজ না করে তাঁর কাজ টা করার বিনিময়েই তিনি চাইলে কারো থেকে একশ টাকা, কারো থেকে পাঁচশ টাকা নিতে পারেন। এভাবে করে তাঁর সহকর্মী দের অনেকে দেশের বাড়িতে অনেক জায়গাজমি কিনে ফেলেছেন। ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। মেয়ের ভাল বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব করতে ফরিদ সাহেবের মন কখনো সায় দেয় নি।

অথচ সংসারে কত অভাব। এইচ এস সি পাশ করা ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়। বাবাকে মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছে-‘বাবা শুধু আমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকা যাবার টাকা দাও। তারপর আমি নিজে টিউশনি টনি করে খরচ চালাব!’ কোত্থেকে টাকা দেবেন ফরিদ সাহেব? ঢাকা যাবার বাস ভাড়াই ত সাড়ে চারশো টাকা। যাওয়া,আসা, দুদিন থাকা, ফর্ম ফিলাপ- অনেক টাকার ধাক্কা।

মেয়েটার ভাল চিকিৎসা দরকার। খাওয়া দাওয়া দরকার। সরকার তাঁকে যে টাকা বেতন দেয় সে টাকা দিয়ে এই অস্থির উচ্চ মূল্যের বাজারে তিনি এসবের যোগান কেমনে দেবেন? যোগান দিতে না পেরেই সবাই শুরুতে অন্যায় পথে যায়। মুশকিল হচ্ছে অন্যায় পথে একবার গেলে দিন কে দিন সেটা বাড়তেই থাকে। অন্যায় হচ্ছে সাক্ষাত শয়তান। মানুষের প্রয়োজন কে সে দিন কে দিন বাড়িয়ে তোলে!

বাসায় ফিরে ফরিদ সাহেবের মুখ পুরাই আমসি হয়ে যায়। মেয়েটার মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার মাথাটা কোলে চেপে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন ফরিদ সাহেবের স্ত্রী। ছেলেটার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। লজ্জা, অপমানের সাথে এক তীব্র অভিমানের ছায়া ছেলেটার মুখে। ফরিদ সাহেবের একবার মনে হল এখান থেকে পালিয়ে যাবেন! আবার মনে হল কেন পালাবেন? তাঁর কি অপরাধ? তাঁর হাত দিয়ে যত ফাইল পুট আপ হয়, ফাইল পিছু পঞ্চাশ টাকা করে নিলেও ত তাঁর মেয়ের আজকে এই অবস্থা হয় না। কিন্তু তিনি ত জানেন এই কাজ টা ঠিক না!

তিনি বোঝেন তাঁর মত ছোট পর্যায়ের চাকুরে দের ছোট ছোট অন্যায় গুলো বড় চাকুরেদের বড় বড় অন্যায় করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যে লোক কে কেনা যায় তাকে অন্যায় কাজে সহজেই ব্যবহার করা যায়। ছোট ছোট দশটা লোক কে কিনে নিয়ে তাদের ব্যবহার করে বড় বড় অন্যায় করা যায়। এই বড় বড় অন্যায় গুলো কখনো বিষাক্ত রাসায়নিক হয়ে, কখনো ধবসে পড়া বিল্ডিং হয়ে, কখনো ডুবে যাওয়া লঞ্চ হয়ে আবার কখনো আততায়ীর বুলেট হয়ে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে।

নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে ‘দুর্নীতির পুঁজের সিন্দু’র মধ্যে ‘এক টুকরা তাজা রক্তের বিন্দু’র মতই ফরিদ সাহেব এই সকল হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেছেন।

এক ফোঁটা অক্সিজেনের জন্য হাপরের মত উঠানামা করতে থাকা মেয়ের শুকিয়ে যাওয়া বুকের পাঁজরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফরিদ সাহেবের মনে হল- যে অশ্লীল দূর্নীতি গ্রস্ত সমাজ ব্যবস্থা নৈতিকতা বোধ সম্পন্ন মানুষদের দিন দিন কোনঠাসা করে ফেলতেছে সে কি তাদের হত্যা না করা পর্যন্ত থামবে না?

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×