somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তরাধুনিকতা ও কবি জফির সেতুর কবিতা (সমালোচনা) পর্ব - ৬

২৫ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে যেমন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের ভাব, ভাষা, ছন্দ অলংকরণ, উপমা, যমক, উৎপ্রেক্ষা, শব্দ গাঁথুনির বিশেষ পার্থক্য নির্ণয় করা যায় তেমনি কবি জফির সেতুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ থেকে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’কেও অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। তবে সেটা যতটা না প্রকরণে তার চেয়ে বেশি ভাব, ভাষা ও চিন্তায়।
এ কালের সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, মহাবিশ্ব ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক তেমনি তাঁর কথার সাথে সাদৃশ্য রেখে বলা যায়, উত্তরাধুনিক সাহিত্যের পরিমণ্ডলও ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। যেহেতু উত্তরাধুনিক সাহিত্য সুনির্দিষ্ট সীমানায় বিশ্বাস করে না, সেহেতু এর পরিধিও সীমিত হতে পারে না।

সময়ের প্রবমানতার সাথে সাথে যেমন ব্যক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়, তেমনি এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যে। একাধারে ক্রমব্যপ্তি অনুসারে মানুষের বিকাশের পর্যায়গুলো হলো- শিশু, কিশোর, তরুণ, পরিপূর্ণ যুবক এবং বৃদ্ধ। একেকটা পর্যায় থেকে উত্তরণে ব্যক্তির যেমন শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তেমনি ঘটে মানসিক পরিবর্তন। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর সাদৃশ্য রয়েছে বলে আমি মনে করি। উত্তরাধুনিক কাব্যসাহিত্যে কবি জফির সেতুর ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থের বিশ্লেষণে বলা যায় তিনি এক উঠন্তি কিশোর! পরিপক্ক হয়েও যেন হয়ে ওঠে নি। তবে তাঁর এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির পথে মাইলফলক স্বরূপ।
শুদ্ধস্বর কর্তৃক তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’। এতে ২৬টি কবিতা স্থান পেয়েছ। ঈশ্বর, স্তন, হৃদয় প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিরা কম লেখালেখি করেন নি- তবে একই নাম থাকলেও ভাব, ভাষা, শব্দ বুনন ও উপস্থাপনে রয়েছ ভিন্নতা। কথাসাহিত্যেও একই নামে বিভিন্ন কথাসাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেছেন এমন নজিরও রয়েছে অহরহ। যেমন ‘জননী’ উপন্যাস নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, আনিসুল হক প্রমুখ সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু একই নামকরণ থাকা সত্ত্বেও বিষয়বস্তু, প্রকরণ ও উপস্থাপনে রয়েছে তাদের ভিন্নতা। আর সেখানেই মূলত তাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে।

জানালা খোলা রাখলে যেমন স্নিগ্ধ বাতাস গৃহে প্রবেশ করে গৃহকে আন্দোলিত করে তেমনি জফির সেতুর নিম্নোক্ত কবিতা পড়লেও উত্তরাধুনিক চেতনায় হৃদয়কে দোলায়িত করে এক নতুন অন্বেষায় জাগরুক রাখে।

“এমন বসন্তদিনে আমি গ্রীস রোম ব্যাবিলন হয়ে
হরপ্পার যুগল মূর্তির কোল ঘেষে প্রেরণাস্বরূপ
দাঁড়িয়েছি নটরাজ। পষ্ট দেখি আমার ছায়ার রং
লেগে আছে তাদের শরীরে-সে শব্দ শুনতে পাই
সিন্ধুর গোপন গান জীবনে খুব কম লোকে শোনে”
(এমন বসন্তদিনে, পৃষ্ঠা: ৯)

তাঁর এই কবিতায় তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন নি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে। ইতিহাস ও পুরাণের উপর চরাট করে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেছেন নতুন করে। আমিত্ববোধকে করে তুলেছেন সার্বজনীন।

নিজস্ব সংস্কৃতিকে তিনি তুলে ধরেছেন আপন ভঙ্গিমায়। এতে করে তিনি কোনপ্রকার আতিশয্য করেন নি। একেবারেই নিজস্ব চেতনার ছাঁচে তিনি নিজেদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে, সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। এতে করে যেমন তাঁর দেশপ্রেমের চেতনা মিলে তেমনি মিলে শিল্পবোধ।

“একটা শালিক নেচেছিল স্যাটেলাইটের তারে
তখন ঠিক মধ্যাহ্ন, রান্না ঘরে সর্ষে ইলিশের ঘ্রাণ আর
সকল নগ্নতাকে আড়াল করে তুমি ছুড়ির মতো শীতল ঘুমে”
(চাকা, পৃষ্ঠা ১০)

তুচ্ছের মধ্যেই নাকি বৃহৎ কিছু খুঁজে নিতে হয়। কোন তুচ্ছ বিষয় বস্তুকে কখনো অবহেলা করতে নেই। এতদ্ববিষয়ে অনেক দার্শনিকদের যেমন বাণী রয়েছে তেমনি অনেক কবিও সতর্কতারূপে পদ্য রচনা করেছিলেন এরূপে। যেমন –

“যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখিবে তাই
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন”।

কবি জফির সেতু মনে হয় এ বিষয়টা একটু বেশি আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন। যার প্রকাশ পাই ‘ম্যাটিনি শো’ কবিতায়। কবিতাটিতে তাঁর ভাষার সরলীকরণও চমৎকারভাবে ফুটে ওঠেছে।

“সিনেমা হলের পাশে একটি বাঘ ঘুমিয়ে আছে
সিনেমা হলের পাশে যে বাঘটি শুয়ে তার গায়ের রং সাদা
বাঘটির মুখে মানুষের আকৃতি আঁকা
...................................................
জীবনমুখী সিনেমা দেখতে এসে দর্শকরা এই দৃশ্য দেখে সারা বিকেল
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে দুচোখ মুছতে মুছতে”
(ম্যাটিনি শো, পৃষ্ঠা: ১১)

তাঁর কাব্যগ্রন্থের ‘সার্কাস’, ‘অহেতুক পতঙ্গ’, পক্ষী সংবাদ’ কবিতাত্রয় কাব্যগ্রন্থটিতে যদিও বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে তবুও তা অন্যান্য কবিতাগুলোর মত অতটা পরিপক্কতার পরিচয় বহন করে না।

বৈষ্ণব কবিতাগুলোতে প্রিয়া হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। কিন্তু তা কিছু সীমাবদ্ধতার কারণেই আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিকতার আওয়ায় পড়ে না। যদিও সে সবের চাহিদা এখনো অম্লান। বৈষ্ণব কবিদের প্রিয়াদের সাথে অনেকটা সাদৃশ্য মিলে জফির সেতুর ‘ঘটনাবলি’ কবিতাটির প্রিয়ার। তবে বৈশাদৃশ্য এই যে বাস্তবতার যুপকাষ্ঠে নিজেকে পুড়িয়ে তার প্রিয়া হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। প্রকৃতপক্ষে তার প্রিয়া সময়েরই প্রতীক। মজার বিষয় হলো বৈষ্ণব পদাবলীতে পদ্যের ছাঁচ থাকলেও আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর কাব্যে এর লেশ নেই বললেই চলে। উপস্থাপন, প্রকরণে ও শব্দ শিল্পে তাঁর এ কাব্যটি হয়ে ওঠেছে অনন্য।

“এইসব কাঠবাদামের গাছ আর সমুদ্রের ফেনিল জল
লাল পিঁপড়া, কাঠঠোকরা ময়ূর কিংবা নারীর প্রকট হৃদয়
অতিকায় পৃথিবীর বালিয়ারিতে কত তলিয়ে গেছে, শোনো
সে খবর শুধু অতি নায়িকাদের বগলের ক্ষারে, আমরাই রাখি না!”

কবিতায় ভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষভাবে কৃতিত্বের দাবিদার। উপমাগুলোও তাঁর কবিতায় লেপ্টে থাকে কাব্য শরীর হয়ে, শব্দ শরীর নয়।

(চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×