somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লা মিজারেবল- ভিক্টর হুগো - মুনশি আলিম

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ফরাসি ভাষায় লা মিজারেবল কথাটির শব্দগত অর্থ দীন দুঃখীরা বা হতভাগারা। উনিশ শতকের ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচের তলার সেসব মানুষের জীবনের এক সকরুণ জীবনচিত্র এঁকেছেন। জা ভালজা এই উপন্যাসের নায়ক। বিশ্বসাহিত্যে এমন চরিত্র সত্যিই বিরল। সে তার জীবনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চারটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসে। যারা তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দেয়। সেই চারটি চরিত্র হল বিশপ মিরিয়েল, ইন্সপেক্টর জেভারত, ফাতিনের মেয়ে কসেত্তে এবং কসেত্তের প্রেমিক যুবক মেরিয়াস।

যে সমাজে চোর ও অপরাধীর জন্যে নির্মম শাস্তির বিধান আছে কিন্তু গরিবদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা নেই সে সমাজের প্রতিই জা ভালজার প্রবল ঘৃণা। উনিশ বছরের কারা দন্ড শেষে জেল থেকে বেরিয়ে সে নিষ্ঠুর সমাজের প্রতি চরম ঘৃণা ও বিদ্রোহাত্মক প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে। এই বিভ্রান্ত মুহূর্তে বিশপ মিরিয়েল এর অপরিসীম দয়ায় জা ভালজার সমস্ত ঘৃণা নিঃশেষ হয়ে যায়। তার ভালোবাসা ও দয়া এক মহাজীবনের পথ দেখায়। টেনে তুলে গভীর হতাশা আর অন্ধকার থেকে।

এরপর তার জীবনে আসে কর্তব্য পরায়ণ ও নীতিবাদী ইন্সপেক্টর জেভারত। ম্নত্রিউল সুর মের অঞ্চলে বিশাল সম্পদ ও মান সম্মান এর অধিকারী হয়। তখন একদিন জেভারত এসে তাকে বলে শ্যাম্পম্যাথিউ নামে এক লোক জা ভালজা নামে দণ্ডিত হচ্ছে। ফলে আবার এক আত্মিক সঙ্কটে পড়ে সে। ভাবতে থাকে এই সম্মান এর জীবন বহন করবে নাকি সত্যটা মেনে নিয়ে শ্যাম্পম্যাথু কে মুক্ত করবে। অবশেসে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারাদণ্ড ভোগ করে সে।

এরপর তার জীবনে আসে ফাতিনের মেয়ে কসেত্তে। যাকে আটবছর বয়সে থ্রেনাদিয়ের দের হোটেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসছিল সে। ... এই কসেত্তের আভিরবা তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আত্মীয়স্বজনহীন জীবনে শিশু কসেত্তে নিয়ে আসে এক আশ্বাস। সে কসেত্তের জন্য রচনা করে পিতা ও ভ্রাতার সমন্বিত এক দুর্ভেদ্য ভালোবাসা । সে ভাবতে থাকে-যা ছিন্ন করে কেউ তাকে তার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।

কিন্তু একসময় সে জানতে পারে কসেত্তে মেরিয়াস নামে এক যুবককে ভালোবাসে। আবারও সে আত্মিক সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু আত্মত্যাগের এক বিরল মহিমায় কসেত্তেকে স্বেচ্ছায় তুলে দেয় মেরিয়াসের হাতে। আত্মত্যাগ, আত্মনিগ্রহ ও স্বেচ্ছা মৃত্যুর দিকে নিজেকে ঠেলে দেয় সে। এভাবেই সমস্ত কামনা-বাসনাকে জয় করে মৃত্যুহীন এক মহাজীবনের আলোকমালা দেখতে পায় এবং মৃত্যুবরণ করে। সমস্ত পড়ে মনে হবে-এ যেনো যাপিত জীবনে এক ট্র্যাজিক মহাকাব্য।


বিস্তারিত কাহিনি

১৮০০ শতাব্দী। দক্ষিণ ফ্রান্সের ব্রাই প্রদেশ। এই প্রদেশের ছোট্ট একটি কুটির থেকে শুরু হচ্ছে আমাদের এই কাহিনি। ব্রাই প্রদেশে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছিল একটি শিশু। নাম জাঁ ভালজাঁ। ভালজাঁর বাবা ছিল বড্ড গরিব। স্ত্রী, ভালজাঁ আর এক মেয়ে—এই নিয়ে ছোটো সংসার। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল; তবু এই ছোট্ট সংসারে ভরণপোষণের ব্যাপারেই ভালজাঁর বাবা হিমশিম খেয়ে যেত।
তার মা যখন অসুস্থ হয়ে মারা যায় তখন জাঁ ভালজা ছিল খুবই ছোটো। অভাবে বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছিল। বাবা ছিল কাঠুরে। স্ত্রীর মৃত্যুর ক’দিন পর গাছ থেকে পরে গিয়ে সেও মারা গেল। সংসারে আপন বলতে একমাত্র বোন ছাড়া জাঁ ভালজাঁর তখন আর কেউ নেই। অসহায় ভালজাঁ বোনের সংসারে আশ্রয় পেল। দারিদ্র্য আর দুর্বিপাকে জাঁ ভালজাঁর কোন লেখাপড়া শিখা হয়নি। বোনের সংসারে উঠে সে সামন্য কিছু রোজগার করতে শুরু করলো। এবং এভাবেই তার দিন চলতে লাগলো।

ভালজাঁর যখন পঁচিশ বছর বয়স ঠিক সেসময় হঠাৎ তার বোনের স্বামী অসুখে মারা গেল। ভগ্নিপতি আর ভালজাঁর আয়ে সংসারটি কোন রকম চলে যেত। ভালজাঁ দিন মজুরি করে সামান্য কিছু রোজগার করতো। এবার ভগ্নিপতির মৃত্যুতে ভালজাঁ যেন সমুদ্রে পড়ল। বিধবা বোন আর ছোটোছোটো সাতটি ছেলেমেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাকে মাথা পেতে নিতে হলো। ভাগ্নেদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির বয়স তখন মাত্র আট। যৌবনের সব স্বপ্নসাধ প্রায় বিলীন হয়ে গেল ভালজাঁর। সংসার চালাবার জন্য সে কঠোর পরিশ্রম করছে। তবু দু’বেলা খাবার জোটে না। ফ্রান্সে তখন খাদ্যের চড়া দাম ও বড্ড অভাব।

বোন আর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য ভালজাঁর সব দুঃখ-বেদনা হাসিমুখে সহ্য করে। বাবার পেশা গাছকাটার কাজকেই বেছে নিয়েছিল ভালজাঁ। তার বোনও টুকটাক কাজ করতে শুরু করলো। কিন্তু দু’জনের যা রোজগার, তাতে দু’বেলা খাবার জোটে না। দিনমজুরি, খেতে-খামারে কাজ, ঘাস শুকানো, গরু চরানোর বাড়তি কাজ শুরু করল ভালজাঁ। এতে সামান্য কিছু রোজগার বাড়লো কিন্তু অবস্থার তেমন কোন হেরফের হলো না। এদিকে বোনও কেমন সব দিন-দিন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। সুযোগ পেলেই ভালজাঁর রোজগারে সব পয়সা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। ভালজারেঁরও তা’ নজর এড়ায় না। বোনের আগের মতো আন্তরিকতা নেই। ভালজাঁ সহসা এর কোন প্রতিবাদ করে না। এদিকে অভাব দিন-দিন বেড়েই চলেছে। অশান্তি বাড়ছে। কঠোর পরিশ্রম, অভাব-অনাটনে ভালজাঁর মাথা ঠিক রাখাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেবার দক্ষিণ ফ্রান্সে খুবই শীত পড়লো। শীতের জন্য বাইরের কাজকর্ম থেমে গেল। কাঠ কেটে আর আগের মতো রোজগার হয় না। অন্য কোন কাজও মিলছে না। অবস্থা দিন-দিন কঠিন হয়ে উঠলো। পর-পর কয়েকদিন ভালজাঁ কোন কাজ পেল না। এক টুকরো রুটি জোগাড় করাও কঠিন অবস্থা। না খেতে পেয়ে বোনের ছোটোছোটো ছেলেমেয়ে নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছে। দরোজায়-দরোজায় ভালজাঁ সাহয্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সবই নিস্ফল চেষ্টা।




রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির এক রাতে মহল্লার মনোহারী দোকানি সবেমাত্র দোকানপাট বন্ধ করে ঘুমাবার আয়োজন করছে—এমন সময় সে চমকে উঠলো। কি ব্যাপার! দোকানের পাশের কাঁচে কিসের যেন আওয়াজ হলো। দোকানি চুপি-চুপি পা টিপে-টিপে বেরিয়ে এলো শোবার ঘর থেকে। বেরিয়ে সে দেখতে পেলো দোকানের কাঁচের একটি বন্ধ জানালার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কাঁচের একটি পাল্লা ভেঙ্গে ফেলেছে লোকটি। ফোঁকরের মধ্যে হাত দিয়ে সে একটি পাউরুটি বের করে নিল। তার হাত কাঁপছে। চারদিকে ভীত-চকতিভাবে তাঁকালো লোকটি, তারপর সে জোরে হাঁটতে শুরু করলো।

দোকানি চুপ করে দাঁড়িয়ে লোকটির কাণ্ড-কারখানা দেখছিল। লোকটি দোকান ছেড়ে পা বাড়াতেই চোর-চোর বলে চিৎকার করে তার পিছু পিছু ধাওয়া শুরু হলো দোকানি। এদিকে লোকটিও দোকানির হাঁকডাক শুনে ছুটতে শুরু করেছে। বার-বার সে হোঁচট খাচ্ছিলো। সে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লো। দোকানি দৌড়ে এসে লোকটির চুল চেপে ধরলো। লোকটি তার হাতের রুটি দূরে ছুরে ফেলে দিলো। ততক্ষণে সেখানে লোকজন এসে জমেছে। এদের মধ্য একজন বলল, ব্যাটা কে হে, আচ্ছা শিক্ষা দিয়ে দাও ওকে!

সমানে কিলঘুষি পড়তে লাগলো। লোকটির ডান হাত দিয়ে তখনো রক্ত ঝরছে। কাঁচের জানালা ভাঙ্গতে গিয়ে তার হাত স্থানে-স্থানে কেটে গেছে। রক্তমাখা সেই হাত তুলে সে বললো, আজ তিন চার দিন থেকে কিছু খেতে পাই নি। ঘরে সাতটি ছোটোছোটো ছেলে-মেয়ে। আমি তাদের বলেছি, আজ তাদের জন্য রুটি এনে দেবই। তার কথায় কেউ কান দিল না। উলটো আরও বেশি কিলঘুসি পড়তে লাগলো তার ওপর। এ লোকটিই জাঁ ভালজাঁ। চুরি করার অপরাধে ভালজাঁকে আদালতে হাজির করা হলো । তার পাঁচ বছরের সাশ্রম কারাদণ্ড হলো ।
ভালজাঁর স্বভাব ছিল অদ্ভুত। কোমলে-কঠোরে গড়া তার মন। খুব চিন্তিত থাকলেও তাকে দেখে তা বুঝা যেত না। সে যে খুব বেশি উদ্বিগ্ন বা বিষণ্ন হয়ে পড়েছে, তাও কখনো মনে হতো না। মনে হতো, কোন কিছুতেই বুঝি তার উৎসাহ নেই। সাধারণ চেহারা, তাতে নেই কোন বুদ্ধির প্রতিফলন। কিন্তু কারাদণ্ডের আদেশ শোনার সময় তার চোখ দুটো যেন একবার জ্বলে উঠেছিলো। তুলোঁই কারাগারে পাঠানো হবে ভালজাঁকে। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কারাগারে পাঠানোর আগে ভালজাঁর শরীরে যখন লোহার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন আকুল কন্ঠে কেঁদে উঠেছিলো সেই গরিব। তার জীবনে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে, তার ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে সে বারবার শিউরে উঠছিল। কান্নায় তার কন্ঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সে বলেছিল, সে সামান্য এক গরিব কাঠুরে। ফেবারুলে সে কাজ করতো। ভালজাঁ তার ডান হাত শূন্যে উঠিয়ে কি যেন বলতে চাচ্ছিলো। শূন্যে অদৃশ্য বস্তুর ওপর সে যেন হাত বুলাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো, সে যেন সাতটি ছোটোবড়ো ছেলেমেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে চাইছে, আমি অন্যায় করেছি সত্যি, কিন্তু তা আমার নিজের জন্য নয়—অন্যায় করেছি আমার বোনের সাতটি ক্ষুধার্ত অবুঝ ছেলেমেয়েদের জন্য।

সাতাশদিন পর তুলোই কারাগারে পৌছালো ভালজাঁ। গলায় লোহার শিকল, গায়ে লাল জামা। কয়েদি নং ২৪৬০১। জাঁ ভালজাঁর শুরু হলো কারাজীবন। ভালজাঁর বোনের কী অবস্থা হলো, আমরা কেউ তা জানি না। সহায় সম্বলহীন সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালজাঁর আশ্রয়কেই সে আঁকড়ে ধরেছিল। তার সে আশ্রয় টুটে গেল। তারা দেশান্তরী হলো। ভালজা সেটা জানতেও পারলো না—তারা কোথায় গেল। কারাগারের কঠিন দেওয়ালে ভালজাঁর সব দুঃখ, বেদনা, কামনা, আর্তি মাথা কুটতে লাগলো। কারাগারের দেয়াল ভালজাঁর মনের দুয়ারও এঁটে দিতে লাগলো। মন থেকে তার বোন আর তার ছেলেমেয়েদের স্মৃতি মুছে যেতে লাগলো দিন-দিন।

কারাবাসের চতুর্থ বৎসর চলছে, ভালজাঁ খবর পেল, তার বোন তখন পুরনো প্যারিসে রয়েছে। প্যারিসের এক অতি সাধারণ বস্তিতে সে বাস করে। তার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলেটির কোন খোজ-খবর নেই। জীবনসংগ্রামে ছ’টি ক্ষুদে ছেলেমেয়ে যে কোথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে, তা কেউ বলতে পারে না। কেবল ছোটো ছেলেটি তার মায়ের কাছে থাকে। ছোটো ছেলেটির বয়স তখন সাত বছর। ভালজাঁর বোন এক ছাপাখানায় কাজ করে। ছেলেটিকে ছাপাখানার পাশে একটি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে।

বোনের খবর পেয়ে তার মনের মধ্যে পুরনো ব্যথা আবার মাথা চড়া দিয়ে উঠলো। কারাবাসের চতুর্থ বছরের শেষের দিকে সে কিছু কয়েকদিনের সাহায্যে জেল থেকে পালালো। দুটো দিন সে ভীতসন্ত্রস্তভাবে এখানে-সেখানে সে পালিয়ে বেড়ালো। এই দু’দিন সে কিছু খাইনি, একটুও ঘুমায়নি। এই দুইদিন তার দারুণ ভয়ে-ভয়ে কেটে গেল। সামান্য শব্দ, কুকুরের ঘেউ-ঘেউ, ঘোরার ক্ষুরের আউয়াজ, উদগত চিমনীর ধোঁয়া—সব কিছুতেই সে সম্ভ্রস্ত উঠতো। অবশেষে পালানোর পর তৃতীয় দিন সন্ধায় সে ধরা পড়ে গেল। জেল থেকে পালানোর অপরাধে বিশেষ বিচার হলো তার।

কারাবাসের মেয়াদ আরো তিন বছর বাড়িয়ে দেওয়া হলো, সবমিলিয়ে তার মেয়াদ দাঁড়ালো আট বৎসর। ছ’বছরের মাথায় সে আবার পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সন্ধায় হাজিয়া ডাকার সময় রক্ষিরা টের পেয়ে গেল। কারাগারে পড়ে গেল পাগলা ঘণ্টি। খোঁজ চললো। রাতের বেলাতেই ধরা পড়লো ভালজাঁ। সে এক জাহাজের মধ্যে লুকিয়ে ছিল; রক্ষিরা তাকে যখন ধরতে যায়, তখন সে আবার পালাবার চেষ্টা করে। কিন্ত নিরুপায় হয়ে সে প্রহরীদের হাতে ধরা দিতে বাধ্য হলো। বিচারে তার কারাবাসের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এ ছাড়া বাড়তি শাস্তিস্বরুপ দুটি প্রকাণ্ড লোহার বেড়ি দু’বছরের জন্য তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো।

কারাবাসের যখন দশ বছর চলছে, তখন তৃতীয়বার ভালজাঁ পালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবারও সে ধরা পরে গেল। শাস্তিস্বরুপ কারাবাসের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে দেওয়া হলো ভালজাঁর। কারাবাসের ত্রয়দশ বছরে আবার পালাবার চেষ্টা করলো জাঁ ভালজাঁ। কিন্ত বরাবরের মতই এবারো ব্যর্থ হলো । পালানোর চার ঘণ্টার মাথায় রক্ষিদের হাতে ধরা পড়ে গেল সে। নিয়ম অনুযায়ী কারাবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হলো আরো তিন বছর। সব মিলিয়ে উনিশ বছর। উনিশ বছর কারাবাসের পর ১৮১৫ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এলো জাঁ ভালজাঁ। সে বেরিয়ে এলো নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে। ক্লান্তি আর আবসাদে তার আচ্ছন্ন দু’চোখ। তার মুখে গাম্ভীর্য, হৃদয়ে সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের প্রতি প্রবল ঘৃণাবোধ। ভালজাঁর বয়স তখন চল্লিশ। কারাগারে থাকাকালে ভালজাঁ লেখাপড়া শিখেছে। সে কয়েদীদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল।


১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসের একটি দিন । সূর্য তখন ডুবু-ডুবু করছে। ফ্রান্সের ছোটো একটি শহর ‘ডি’র একটি পথ দিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি লোক। মনে হয় ভীষণ পরিশ্রান্ত। লোকটির মজবুত বাঁধুনির শরীর। বয়সে প্রৌঢ়। জীর্ণ মলিন বিচিত্র রঙের তালিযুক্ত তার পরনের পোশাক। পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে একটি প্রকাণ্ড লাঠি। লোকটির সারা গায়ে ভল্লুকের মত ঘিচঘিচে লোম। থ্যাবরা নাক। চ্যাপ্টা মুখে এক বোঝা দাড়ি। মাথার চুলগুলো কদম ফুলের মতো ছাঁটা। সবমিলিয়ে অদ্ভুত। লোকটির পিঠে একটি মাঝারি ধরনের পোটলা। পথ চলতে-চলতে একটি হোটেল দেখে দাঁড়ালো সে। কি যেন ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর দরোজা ঠেলে হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়ল। যে ঘরে প্রবেশ করলো, সেটাই হোটেলের খাবার ঘর, হোটেলওয়ালা ক্যাশবাক্স নিয়ে এই ঘরে বসে সব জিনিসের তদারকী করে। ঘরটির একপাশে চুলো। গনগনে আগুন জলছে, পাশের আরেকটি ঘর থেকে কিছু লোকের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

বিচিত্র এক আগন্তুককে দেখে হোটেলওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কি চাই তোমার?
—আজ রাতের মতো আপনার হোটেলে থাকার ও খাবার মতো কোন ব্যবস্থা হবে? আগন্তুক জানতে চায়।
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় হোটেলওয়ালা। বলে, হুঁ! ট্যাঁকে কিছু আছে তো?
–হ্যাঁ, তা হবে, নইলে কি আর এমনি-এমনি এসেছি—
আগন্তুকটি পকেট থেকে একটি চামড়ার থলি বের করে টাকা দেখায়। তখন হোটেলওয়ালা বলে, –আচ্ছা বেশ, ওই টুলটায় বসো, রান্না এখনো শেষ হয়নি।
আগন্তুকটিও যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয়। দরোজার পাশে টুলটা টেনে বসে হাতের লাঠির উপর থুতনিতে ভর দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, খাবার তৈরি হতে কি বেশি দেরি হবে ভাই?
–না না, বেশি দেরি হবে না। একটু অপেক্ষা করো বাপু। হোটেলওয়ালা জবাব দেয়।

তারপর হোটেলওয়ালা পুরোনো একটি খবরের কাগজের পাশ থেকে এক চিলতে কাগজ ছিড়ে পেন্সিল দিয়ে কী যেন লিখল। লেখা শেষ হলে হোটেলের একটি বেয়ারার হাতে কাগজটি দিয়ে হোটেলওয়ালা তাকে ফিস-ফিস করে কি যেন বলে। বেয়ারা সেই কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বেয়ারাটি ফিরে আসে। হোটেলওয়ালার হাতে সে ছোট্ট একটি চিরকুট এগিয়ে দেয়, আর সেটা পড়ে হোটেলওয়ালার চোখমুখ কুঁচকে উঠলো। আগন্তুকটি কোণের টুলে বসে তখন ঢুলছে, হোটেলওয়ালা এগিয়ে গিয়ে তার ঘার ধরে নাড়া দেয়, আগন্তুকটির তন্দ্রা ভেঙ্গে যায় এবং ধড়মড় করে উঠে বসে।

হোটেলওয়ালা বলে, কিহে! বসে-বসে ঘুমাচ্ছিলে নাকি? উঠ, কথা আছে।
আগন্তুকটি বলে, খাবার তৈরি হয়ে গেছে? এই আসছি।
— শোন। তুমি খাবার পাবে না। কঠিন কন্ঠে বলে হোটেলোয়ালা।
— খাবার পাব না! কেন? কি হয়েছে? আমি কি পয়সা দিব না নাকি?
— না, সে জন্যে নয়। পয়সা দিলেও আমি তোমায় খাবার দিচ্ছি না।
— কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? আগন্তুকটি টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ঘরের এককোণে টেবিলের উপর সাজানো ছিল সার-সার পাত্র, সেদিকে এগিয়ে যায় সে, পাত্রের ঢাকনাগুলো উঠিয়ে ফেলে। সে ক্ষিপ্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, এই এতগুলো খাবার দিয়ে তুমি কি করবে? এগুলো কার জন্য? আমি কেন খাবার পাব না? হোটেলওয়ালা বলে, তুমি ছাড়া আরো অনেক লোক রয়েছে, আর তা ছাড়া খাবার থাকলেও আমি তোমাকে দিতে পারব না।

এবার আকুলভাবে হাত জোর করে আগন্তুক বলে উঠল—সাহেব, আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত, আমি আজ প্রায় ১২মাইল পথ হেঁটেছি। সারাদিন কিছু খাইনি। খাবার না দিন, আপনার আস্তাবলের কোণে আজকের রাতে থাকবার মতো একটু জায়গা দিন। বাইরে দারুন শীত। এখানে আমি কাউকে চিনি না। এই রাতে কোথায় যাব। আপনি ভেবেছেন, আমার টাকা নেই? এই নিন টাকা, আমি আপনাকে এগুলো আগাম দিয়ে দিচ্ছি।

হোটেলওয়ালা এবার বলে, দেখো বাপু, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি লোকটি নেহাতই ভালো মানুষ। ওসব ঝামেলা পচ্ছন্দ করি না। প্রথমেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। ফাঁড়িতে খবর নিয়ে জানলাম, আমার অনুমান সত্যি। বুকে হাত দিয়ে বলো দেখি, তুমি সে দাগী আসামী জাঁ ভালজাঁ নও? আগন্তুকের মুখ করুণ হয়ে উঠে, মাথা নেড়ে সে জবাব দেয়, হ্যাঁ, আমিই জাঁ ভালজাঁ। — ব্যাস, হয়ে গেল। শোন দাগী আসামিদের আমি হোটেলে জায়গা দিই না। যাও।

হোটেল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো ভালজাঁ। কি যেন ভাবলো সে, তারপর আবার পথ চলতে শুরু করলো। কিন্তু তার পা যে আর চলতে চায় না। চলতে-চলতে পথের ধারে ছোট একটি হোটেলে গিয়ে উঠলো ভালজাঁ। সেখানেও তার জায়গা হলো না। পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে আবার শুরু হলো তার পথ চলা। পথ চলতে-চলতে সে একসময় শহরের কারাগারের কাছে এসে দাঁড়ালো। কারাগারের প্রকাণ্ড ফটকের গায়ে একটি লোহার শিকল লাগানো। জোরে-জোরে শেকলটা টানতে লাগলো ভালজাঁ। ফটকের ওপাশে শিকলের মাথায় বাঁধা ঘণ্টার ঠন-ঠন করে শব্দ হলো। ঘণ্টার শব্দ শুনে কারাগারের এক রক্ষী বেরিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার! শিকল টেনেছো কেন?— জ্বী, আমার নাম জাঁ ভালজাঁ। দাগী আসামি। খুবই অসহায় অবস্থায় পড়েছি, থাকা-খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। আপনাদের কারাগারে আজ রাতের জন্য আমাকে একটু জায়গা দেবেন?

অবাক হয়ে রক্ষীটি ভালজাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলো। লোকটি পাগল নাকি? সে বললো, যাও এখান থেকে, পাগল কোথাকার, কারাগার তোমার শ্বশুরবাড়ি নাকি, যে ইচ্ছে হলেই থাকতে পারবে। যদি থাকবার শখ হয় ত যাও গিয়ে একটা চুরি-ডাকাতি করো। বলে রক্ষীটি চলে গেল। আবার সেই পথ চলা শুরু হলো ভালজাঁর। এই গলি সেই গলি চলতে চলতে লাগলো সে। পথের দু’পাশে কি সুন্দর সাজানো বাগান। দু’পাশে সুন্দর ছোটোবড়ো ছিম-ছাম স্বপ্নপুরীর মতো বাড়ি। এমনি একটি বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো ভালজাঁ। একতলা সে বাড়ি। ছবির মতো। সাজানো ফুলের বাগান। জানালার দামি পর্দা। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে কথাবার্তা। জানালার পর্দা একপাশে গুটানো। ভালজাঁ দেখতে পেল, একজন ভদ্রলোক এক শিশুকে আদর করছেন। পাশে এক যুবতী মহিলা। শিশুটি তার কচি-কচি হাত-পা নেড়ে খিল-খিল করে হাসছে। মহিলার কোলেও একটি শিশু। সেই শিশুটিও মিট-মিট করে হাসছে। ভালজাঁ ভাবলো, ভদ্রলোকটি নিশ্চয়ই ছেলেটির বাবা আর মহিলাটি তার মা। এত সুখ এত আনান্দ যেখানে, সেখানে নিশ্চয় তার মতো হতভাগ্যের আশ্রয় মিললেও মিলতে পারে। বাড়ির দড়জার দিকে এগিয়ে যায় ভালজাঁ। খট-খট করে কড়া নাড়ে।

–কে? ভেতর থেকে রাশভারী এক কন্ঠস্বর ভেসে এল।
— আমি একজন অসহায়, দয়া করে দরজাটা খুলুন।
দরজা খুলে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, –কি ব্যপার, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
–আমি একজন বিদেশি আগন্তুক। আজকে ১২ মাইল পথ হেঁটে এই শহরে এসে পৌঁছেছি, খুবই ক্লান্ত। তাছাড়া বাইরে দারুন বরফ পড়ছে। আমাকে আজকে রাতের জন্য একটু আশ্রয় দিন। এজন্য আপনাকে যদি টাকা-পয়সা দিতে হয়, আমি তাও দিতে রাজি আছি। ভালজাঁর আপাদমস্তক জরিপ করে ভদ্রলোক কৌতূহলের সুরে বললেন, কোন হোটেলে যাচ্ছেন না কেন? পয়সা যখন খরচ করবেন, তখন …
–স্থানীয় কোন হোটেলেই আমার জায়গা পেলাম না। ভালজাঁ জবাব দেয়।
–কোন হোটেলেই জায়গা পেলেন না? বলেন কি! ওই যে কি নাম ওই আস্তাবলওয়ালা বড় হোটেলটায় গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে খেতে দিল না। আশ্রয় চাইলাম, তাতেও রাজী হলো না।
লোকটির মনে এবার পুরোপুরি ভাবে সন্দেহ জেগে উঠলো। তিনি জিজ্ঞেস করেন, দেবে না কেন? আপনার পরিচয় কি? কোথা থেকে এসেছেন? হাতের হারিক্যান ভালজাঁর মুখের কাছে তুলে ধরে কুঞ্চিত চোখে তাকালেন ভদ্রলোক।
ভালজাঁ ততক্ষন দরজার সামনে বসে পরেছে। খানিক্ষন চুপ থেকে সে বললো,–ভীষণ ক্ষুধার্ত আমি। দয়া করে আমায় কিছু খেতে দিন। আমি আপনার কাছে সব খুলে বলবো। আমার বুক জ্বালা করছে। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমাকে একটু দয়া করুন।

টেনে-টেনে চিবিয়ে-চিবিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ব্যাস, হয়েছে। তোমায় আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল, অনেক দিন আগে এক রাজকীয় প্রচার পত্রে তোমার ছবি দেখেছিলাম। তুমিই সেই জাঁ ভালজাঁ? ভালজাঁ লোকটির পা জরিয়ে ধরতে চাইলো। ভদ্রলোক যেন আঁতকে উঠলেন। ঘরের মধ্যে ঢুকে দেয়ালে লটকানো বন্দুকটি টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ভালজাঁর দিকে বন্ধুক উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, খবরদার বলছি, আর এক পাও এগিয়ো না। গুলি মেরে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো বদমাশ কোথাকার!

ভদ্রমহিলার হাঁক-ডাক শুনে ভদ্রমহিলাও ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। বাচ্চা দুটোও আর্তনাদ করে উঠলো, মুহূর্তের মধ্যে ঘরের আবহাওয়া বদলে গেল। ভালজাঁ তখোনো বলে চলেছে, আমাকে দয়া করুন হুজুর। কিছু অন্তত খেতে দিন। আমি আর সইতে পারছি না। আমায় এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন? আমার কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসছে। –পানি খাওয়াবো না ছাই। বন্দুক উঁচিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন ভদ্রলোক। –যাও বলছি এখান থেকে। ক্লান্ত পায়ে টলতে টলতে বেরিয়ে যায় ভালজাঁ। দরোজা এটেঁ দেন ভদ্রলোক। জানালাগুলোর পর্দা পর্যন্ত এটেঁ দেন তিনি।

ধীর পায়ে এগুচ্ছে ভালজাঁ। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে হু-হু করে। খানিক দূর এগিয়ে ভালজাঁ রাস্তার পাশে একটি ছোটো তিরপাল ঢাকা জায়গা দেখতে পেল। রাস্তা মেরামতের কাজ হয়েছে ওখানে দিনের বেলায়। জায়গাটির এপাশে-ওপাশে ইট-সুরকি বালি ছড়ানো। মনে-মনে খুশি হয় ভালজাঁ। তিরপালের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যায়। খানিকটা খরও বিছানো রয়েছে। ঝোলাটা নামিয়ে রাখে সে। তারপর ধীরে-ধীরে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করে। আর অমনি ঘেউ-ঘেউ করে তেড়ে আসে বড় একটি বাঘা কুকুর। কুকুরটি গর্তের এক পাশে খড়ের গাদায় শুয়ে আয়েশ করছিল– ভালজাঁর অনাধিকার প্রবেশে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছে হয়তো। সামান্য পথের কুকুরও তাকে দয়া করলো না। দুর্বল হাতে একবার লাঠি উঁচিয়ে তেরে গিয়েছিল ভালজাঁ। কিন্তু কুকুরটি তাকে কামড়াতে আসে। ভয়ে বেরিয়ে আসে ভালজাঁ।

পথ চলতে-চলতে সে শহরের বাইরে চলে এলো। শীতের হিমেল হাওয়ায় যেন হাত-পা জমে যাচ্ছে। শহরের বাইরে খোলামেলা জায়গায় শীত যেন আরও বেশি জেকে বসেছে। হিমেল হাওয়ার কাঁপনে অস্থির অবস্থা ভালজাঁর। ঘুরতে-ঘুরতে সে একটি গীর্জা দেখতে পেল। গীর্জার আশে-পাশে ছোটোছোটো কয়েকটি বাড়ি। আকাশ থেকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে রয়েছে। ফিঁকে আলোয় একটি বাড়ির সামনে একটি পাথরের বেদী দেখতে পেল সে। সেই বেদীর উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো ভালজাঁ। কয়েক মিনিট হয়তো পেরিয়ে গেছে। ক্লান্তির অবসদে সে তখন ঘুমে অচেতন। দূর থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করলো, –তুমি কে হে, ওখানটায় শুয়ে আছো?





ধীরে ধীরে তন্দ্রার মোড় কেটে যায়। বাড়ির ব্যালকনি থেকে কে যেন তাকে দেখছে। ভালজাঁ দেখল একজন অভিজাত পৌর ভদ্রলোক, পরনে বিশাল আলখাল্লা, গলায় ক্রূশ, আর তার ডান কাঁধে একটি সুন্দর শাল বিশেষ ভাবে ঝোলানো রয়েছে। পরনের পোশাক আর বেশভূষা দেখেই ভালজাঁ বুঝে গেল যে, ইনি গীর্জার বিশপ। আর এটি তারই বাড়ি। ভালজাঁ ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো। বিশপ আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই শীতের রাতে তুমি ওখানটায় কি করছিলে হে?

ভালজাঁ বলতে শুরু করলো, জনাব, আমি ভীষণ ক্লান্ত। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছি। আজ চারদিন থেকে না খেয়ে আছি। আমি ক্ষুধার্ত। এই শহরে কেউ আমাকে খেতে দেয়নি, কোন থাকার জায়গা হয়নি। দয়া করে আমায় তাড়িয়ে দিবেন না। একটু দয়া করুন। আজ রাতটা এখানে কাটাতে দিন। কথা দিচ্ছি, কাল ভোর হওয়ার আগেই আমি এখান ছেড়ে চলে যাব। ভালজাঁ কাঁদতে আরম্ভ করলো এবং জোরহাত করে বসে পড়ল। বিরবির করে বলতে থাকলো, দয়া করুন জনাব, দয়া করুন। আমি আর পারছি না। বাইরে প্রচন্ড শীত। ভিতরে আসো। এসে বলো কি হয়েছে তোমার? এই বলে বিশপ ভিতরে চলে গেলেন।

বিশপের কথা শুনে ভালজাঁ একেবারে থ হয়ে গেল। তার শুনতে ভুল হয়নি তো, সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর কিছুটা ইতস্ততবোধ করে সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজাটি ভিতর থেকে বন্ধ। তাই সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। রাত তখন সাড়ে আটটা। রাতের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। বিশপের খাবার টেবিলে খাবারের আয়োজন করা হচ্ছিল। টেবিলের একপাশের চেয়ারে বিশপের বোন বসেছিলেন। বিশপ একটি চেয়ার টেনে তার বোনের পাশই বোসলেন। বুড়ি ঝি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। এমনি সময় দরোজায় শব্দ হলো ঠক-ঠক করে। –ভেতরে আসুন– বিশপ বললেন।

বুড়ী ঝি দরোজা খুলতেই ভালজাঁ ঘরে ঢুকে পড়লো। ঝি আগুন্তুককে দেখে, তার দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আগন্তুকের বেশভূষা দেখে আর ধরন-ধারণ দেখে বিশপের বোনও কম অবাক হননি। কিন্তু বিশপ খুব শান্তভাবেই বসে ছিলেন। তাকে দেখেই ভালজাঁ বলতে আরাম্ভ করলো– জনাব, আপনার বহুত দয়া। আমার নাম জাঁ ভালজা। আমি একজন দাগী আসামি-কয়েদী। উনিশ বছর জেল খেটেছি। কিন্তু আমিও আর সবার মতো একটি মানুষ। আমারো ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে। মাথা গুঁজাবার মতো ঠাঁই-এর দরকার রয়েছে। চার দিন হলো আমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। আরপর থেকে আমার স্বস্তি নেই। সমাজের চোখে আজ আমি অবহেলার বস্তু। পোড় খাওয়া কুকুরের মতো এই চারদিন আমি এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছি। বার-তের মাইল পথ হেঁটে আজ আমি এই শহরে এসেছি। কিন্তু কোন হোটেলে জায়গা পেলাম না, কোথাও কিছু খেতে পেলাম না। কোথাও জায়গা পেলাম না। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ আমকে পয়সা দিয়েও আশ্রয় দিতে চায় না। সবখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। তারপর আপনার বাড়ির সামনের বেদির ওপর এসে শুয়ে ছিলাম। একটু আগে আপনি ভিতরে ডাকলেন তাই আপনার সামনে চলে এলাম।

–ভালো করেছেন। বিশপের জবাব। তারপর তিনি ঝিকে বললেন, –টেবিলে আরো একজনের জন্য প্লেট, কাঁটা-চামুচ সাজাও। আজকে আমাদের সাথে এই নতুন অতিথিও আহার করবেন। ভালজাঁ হতবাক। তার সাথে আবার তামাশা করা হচ্ছে না তো। ঝি আরেক প্রস্থ প্লেট, কাঁটা-চামচ আনার জন্য আলমারির দিকে যাচ্ছিল। ভালজাঁ বাধা দিয়ে বললো, দাঁড়াও। তারপর বিশপকে বললো, জনাব, আমি সত্যি খুব সাংঘাতিক লোক। কয়েদী। উনিশ বছর জেল খেটেছি। চারবার জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করেছি। এই দেখুন, আমার ছাড়পত্র। ভালজাঁ তার ঝোলা থেকে একটি হলুদ কাগজ বের করে দেখালো।

তারপর বিশপকে বললো, এবার বলুন, ঠিক করে বলুন –আপনি আমাকে খেতে দেবেন নাকি তাড়িয়ে দেবেন?
–আপনি অনেক ক্লান্ত। চুলোর পাশে ঐ চেয়ারটার পাশে বসে গা গরম করে নিন। বাইরে দারুণ শীত পরেছে।

এরপর ঝিকে উদ্দেশ্য করে বিশপ বললেন, –বুঝলে, আমাদের খেতে দিয়ে তুমি মেহমানের বিছানাটা ঠিক করে দিও। ঝি টেবিলে আরেকপ্রস্থ কাঁটা-চামচ রেখে গেলো। বিশপ ভালজাঁকে বললেন, আজকে দারুণ শীত, তাই না? ঘরে আগুনের পাশে বসে রয়েছি, তবু মনে হচ্ছে, হাত বুঝি সিঁটিয়ে যাচ্ছে।…একি আপনি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আরে বসুনতো, জামা-কাপড় বদলাবেন না? না, না, আর তো অবিশ্বাস নয়। তাহলে সে সত্যি-সত্যি খেতে পাচ্ছে। শোবার জায়গা পাচ্ছে। ভালজাঁ বিশপের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আর বলতে থাকলো—আপনি বড্ড দয়ালু। আপনার তুলনা হয় না। বিশপ বললেন —একি করছেন আপনি? আমাকে অযথা লজ্জা দিচ্ছেন। উঠুন দেখি। আমি এই গির্জার বিশপ। আমার নাম বিশপ মিরিয়েল। এটা আমার কর্তব্য। আপনি কয়েদী ছিলেন, উনিশ বছর জেল খেটেছেন, তাতে কি হলো? আপনিও তো একটা মানুষ? চলুন, চুলোর কাছটায় বসা যাক।

ভালজাঁ বিশপকে বললো, —দয়া করে আমাকে আর আপনি ডাকবেন না। আমি পাপী-তাপী মানুষ। কিন্ত আপনার কথা শুনে আমি এখন আর কোন অনুতাপ অনুভব করছি না। সবাই আমাকে দূর-দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলেবেলা থেকে দারুণ কষ্টভোগ করে চলেছি। বিধবা বোনের সাত ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য একটুকরা রুটি জোগার করতে গিয়ে উনিশ বছর জেল খাটলাম। আমার চাইতে একটা জানোয়ারের জীবনো ঢের ভালা। আপনি অনেক দয়ালু বিশপ। বলতে বলতে টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে ভালজা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বিশপ ভালজার পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, শন্ত হও। এত বিচলিত হয়ে পড়ছো কেন? ঈশ্বরকে স্মরণ করো। টেবিলে আলো হচ্ছে না বলে ঝি অন্য ঘর থেকে রুপার দু’টো বাতিদান এনে তাতে মোম জ্বালিয়ে রেখে গেল। বিশপ বললেন, এসো ভাই, শুরু করা যাক আমাদের খাবার।

অনেকদিন পর পরম তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করলো ভালজাঁ। এবার একটু ঘুম। বড্ড ক্লান্ত সে। দু’চোখে তার নেমে আসছে ঘুম। ভালজাঁর শোবার ব্যবস্থা হয়েছে বিশপের ঘরের ঠিক পাশের ঘরে। আসলে এটা একটা প্রার্থনা ঘর। ঘরের এককোণে পর্দার দেওয়াল দেয়া একটি কামরা। সেই ঘরটিই দেয়া হলো ভালজাঁকে। ঘরের একপাশে ছোট একটা খাট। তার উপর ধবধবে বিছানা। খাটের কোণে একটা টেবিল। টেবিলের উপর রুপোর বাতিদানে মোমবাতি। ঘরে ঢুকে ভালজাঁ চারদিকে অবাক চোখে তাকাতে লাগলো। এতো সুন্দর একটা ঘরে তাকে ঘুমুতে দেয়া হয়েছে। বিশপও ভালজাঁর সাথে এ-ঘরে এসেছিলেন। ভালজাঁকে তিনি বললেন, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না! তুমি বড্ড ক্লান্ত। তোমাকে এবার বিশ্রাম নিতে হবে। এবার শুয়ে পড়ো দেখি।

বিশপ চলে যাচ্ছিলেন, তারপর থেমে আবার ভালজাঁকে বললেন, আর হ্যা, শোন, কাল ভোরে এখান থেকে যাবার আগে কিছু না খেয়ে চলে যেও না। টাটকা দুধ থাকবে ঘরে। আমার নিজের গাই-গরু রয়েছে। যাও এখন ঘুমিয়ে পড়ো। এই বলে বিশপ চলে গেলেন। বিশপ চলে যেতেই ভালজাঁ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরম নিশ্বিন্তে চোখ বুজলো।


তথ্য সহায়ক ও ছবি : গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ৯:০২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×